রিমিঝিম বৃষ্টি, মাঝে মাঝে বজ্রপাত। তার মানে এই নয়, বর্ষা এসে গেছে। লাগাতার তাপপ্রবাহ (Heat wave in summer) থেকে সাময়িক প্রাণজুড়ানো স্বস্তি। গোটা জ্যৈষ্ঠ মাস কাঁঠালপাকা গরমে আবারও অসহ্য হয়ে উঠবে। তাপপ্রবাহে আমরা কী করব বা না-করব, সেই নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।
ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের শরীর ‘মহাশয়, যা সওয়াবেন তাই সয়’। অর্থাৎ, এই তাপপ্রবাহের সাথে যুঝবার নানারকম ব্যবস্থা প্রকৃতি আমাদের দিয়েছেন। মানুষের এবং অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের শরীরের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। এবং পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যের সাথে সাথে নিজস্ব নিয়মে সেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে—অনেকটা ফ্রিজের থার্মোস্ট্যাটের মতো। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের একটা প্রধান যন্ত্র হল আমাদের ত্বক, যা কিনা বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে থাকে।
তাহলে কি উপায় নেই? ওই যে বললাম ‘শরীরের নাম মহাশয়’। উপায় হচ্ছে ঘাম। যদি বাইরের তাপমান শরীরের স্বাভাবিক তাপমানের থেকে বেশি হয় তাহলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রচুর ঘাম হয়। সেই ঘামের বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীর ঠাণ্ডা হয় — অনেকটা কুঁজোর জল ঠাণ্ডা হওয়ার মতো। প্রয়োজনে প্রায় এক লিটারের মতো ঘাম হতে পারে।
এক্ষেত্রে যেটা নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার, সেটা হচ্ছে ত্বকের রক্তপ্রবাহ এবং তার সূত্র ধরে আমাদের ত্বকের অসংখ্য গ্রন্থি, যা দিয়ে ঘাম হয়।
রক্তনালী প্রসারিত হলে অভ্যন্তরীণ তাপ শরীরের বাইরের অংশে আসে। এটি হয় গ্রীষ্মকালে। আর সংকুচিত হলে অভ্যন্তরীণ তাপ বাইরে আসার সুযোগ পায় না। এটি হয় শীতকালে বা শীতপ্রধান দেশে। কিন্তু এই ব্যবস্থা কার্যকরী হবে তখনই যখন বাইরের এবং শরীরের তাপমানের ফারাক থাকবে।
স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের শরীরের তাপমান 99 ডিগ্রি F (বা 37.2 ডিগ্রি C) থাকে। কাজেই, যখন বাইরের তাপমান 40 ডিগ্রি C বা তার বেশি হয়ে পড়ছে, শরীরের এই ব্যবস্থা কিন্তু অকেজো হয়ে পড়বে।

তাহলে কি উপায় নেই? ওই যে বললাম ‘শরীরের নাম মহাশয়’। উপায় হচ্ছে ঘাম। যদি বাইরের তাপমান শরীরের স্বাভাবিক তাপমানের থেকে বেশি হয় তাহলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রচুর ঘাম হয়। সেই ঘামের বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীর ঠাণ্ডা হয় — অনেকটা কুঁজোর জল ঠাণ্ডা হওয়ার মতো। প্রয়োজনে প্রায় এক লিটারের মতো ঘাম হতে পারে।
এই যে এত কথা বললাম, তার একটাই উদ্দেশ্য—এই কথা বলা যে এই গরমে প্রচুর জল খাবেন। ঘামের সাথে শরীরে লবণও বেরোয়, তাই একটু নুন-লেবু বা ইলেকট্রাল জল (অবশ্যই সঠিক মাপে) খেতে পারেন। কতটা খাবেন? ৩-৪ লিটার খেতে পারেন। তবে একটা সাবধানতা — বয়স্ক মানুষ, বা যাদের হার্টের বা কিডনির অসুখ আছে বা ডায়বেটিস আক্রান্ত মানুষের জন্য কিন্তু এই নিয়ম খাটবে না।

কাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা দরকার? শিশু, প্রৌঢ় বা বয়স্ক, মনোরোগী, মদ্যপায়ী, যাদের হার্টের ও কিডনির অসুখ আছে, যারা বিভিন্ন অসুখের জন্য নানারকম ওষুধ (বিশেষত প্রস্রাব বেশি হবার ওষুধ খেয়ে থাকেন) বা যে কোনও ধরনের আনুষঙ্গিক অসুস্থতা (কো-মর্বিডিটি) আছে, তারা বিশেষভাবে সতর্ক থাকবেন।
কী সতর্কতা? বারে বারে স্নান করবেন, প্রচুর জল খাবেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিশ্রম করবেন না, রোদে বেরোনোর থেকে বিরত থাকবেন (সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পারতপক্ষে বেরোবেন না), বেরোলে ছাতা নেবেন, পাতলা ঢিলেঢালা সুতির পোশাক পরবেন।

এটা দেখে গেছে যে তাপপ্রবাহের প্রাথমিক অবস্থায় যখন শরীর মানিয়ে নেওয়ার সময় পায় না, মানুষ অসুস্থ হন বেশি মাত্রায়। যতক্ষণ পর্যন্ত পর্যাপ্ত ঘাম হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় জল ও লবণ সরবরাহ করা হচ্ছে, আমাদের শরীর অনেকটা তাপমাত্রা মানিয়ে নিতে পারে।
এইবার আসি এই গরমে কী কী ধরনের অসুবিধা হতে পারে—
(১) তাপজনিত কারণে পেশীর খিঁচুনি (muscle cramp) — এটা এতটাই মারাত্মক যে পেটের পেশীর খিঁচুনির ফলে সার্জন ভুল করে অপারেশন অবধি করেছেন — যেখানে যথাযথভাবে স্যালাইন দিলেই হয়তো মিটে যেত। আবার বলি, প্রচুর জল খাবেন। খুব বেশি ঘাম হলে বা হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে ব্যায়ামের ফলেও এটা হতে পারে।

(২) তাপজনিত অবসন্নতা — তাপজনিত কারণে শ্রান্তি ও আচ্ছন্নতা সব থেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এই অবস্থা বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তার আগে অবশ্য দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, মাথা ধরা, খিদে না হওয়া, বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া এবং মলত্যাগের বেগ হওয়া — এগুলি হতে পারে। সাধারণত রোগীকে ঠাণ্ডা জায়গায় স্থানান্তরিত করলেই ফল পাওয়া যায়। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
আরও পড়ুন: স্ট্রোক সম্পর্কে আর কোনও ভুল ধারণা নয়
(৩) তাপজনিত শারীরিক ক্ষতি — ম্যারাথন দৌড়ের যথাযথ ট্রেনিং ছাড়া প্রতিযোগিতা যদি ২৭ ডিগ্রি-এর ওপর তাপমাত্রায় এবং সকালে রোদ ওঠার পর শুরু হয় আর জল কম খাওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এরকম হতে পারে।
এই অবস্থায় ঘাম হয় এবং শারীরিক তাপমাত্রা ১০২-১০৪ ডিগ্রি F পর্যন্ত হয়ে থাকে। গায়ের চামড়া, বিশেষত বুকের এবং হাতের ওপরের দিক, কাঁটা দিয়ে উঠতে দেখা যায়। রোগীর ঘন ঘন শ্বাস পড়ে, বমি বমি ভাব ও বমি হয়, মাংসপেশীর খিঁচুনি, চলাফেরায় টলে যাবার ভাব এবং কথাবার্তার অসংলগ্নতা দেখা যায়।

এখানে সময়টা খুব জরুরি—খুব দ্রুত রোগীর শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমানোর জন্য ঠাণ্ডা টাওয়েল বা চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে; হাত-পায়ের ম্যাসেজ করতে হবে যাতে রক্ত শরীরের প্রান্তভাগে চলে এসে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমাতে পারে। তবে, খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন।
এই অবস্থা প্রতিরোধ করতে হলে –
- সকাল ৮টার আগে (যখন তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা কম থাকে) দৌড় শেষ করতে হবে
- ভাল করে জল খেয়ে (নুন, চিনি বা ইলেকট্রাল মেশানো নয়) শুরু করতে হবে — রেসের ১০ মিনিট আগে ৩০০ মিলি জল খেতে এবং প্রত্যেক ৩-৪ কিমি অন্তর ২৫০ মিলি জল খেতে হবে
- প্রত্যেক ৫ কিমি অন্তর সহযোগী কেন্দ্র বন্দোবস্ত করতে হবে
- হঠাৎ করে দৌড়ের গতি না বাড়ানো, এবং
- দৌড়ের আগে মদ্যপান না করা।

(৪) হিট স্ট্রোক (Heat stroke)—এটি কিন্তু একটি অত্যন্ত সঙ্কটময় প্রাণঘাতী অবস্থা। অত্যন্ত পরাক্রমী চিকিৎসার প্রয়োজন, যা হাসপাতালেই সম্ভব। ‘সময়’ একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। বেশিরভাগ লোকেরই ঘাম হয় না, তবে কারও কারও হতে পারে। শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রি F থেকে ১১২-১১৩ ডিগ্রি F অবধি উঠে যেতে পারে।
রোগী প্রথমেই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তবে মাথা ধরা, মাথা ঘোরা, জ্ঞান হারানো, পেটের মধ্যে অস্বস্তি, চিন্তার বিভ্রম (Confusion) বা ভুল বকা দেখা দিতে পারে।

এই অবস্থায়, যে কোনও উপায়ে শরীরের তাপমাত্রা কমাতে হবে—দরকার হলে জলে চুবিয়ে দিতে হবে — তবে তা হাসপাতালেই করতে হবে। প্রাথমিকভাবে, রোগীর জামাকাপড় যথাসম্ভব সরিয়ে, ঠাণ্ডা জায়গায় রেখে, ঠাণ্ডা চাদর, তোয়ালে বা বরফ-প্যাক দিয়ে ঠাণ্ডা করা যেতে পারে, যতক্ষণ না হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আবার বলি এটি কিন্তু একটি প্রাণঘাতী অবস্থা। কাজেই, যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। নইলে বিপদের সম্ভাবনা খুব বেশি।
পরিশেষে বলি, তাপজনিত অসুখ প্রতিরোধ করুন; বয়স্ক, শিশু এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের দিকে বিশেষ নজর দিন। প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা গেলেই সাবধান হয়ে ব্যবস্থা নিন। আর আমরা কি প্রত্যেকে একটা করে গাছ লাগাতে পারি না?
ছবি সৌজন্য: Head & Shoulders, Wikimedia Commons, STORE NORSKE LEKSIKON, flicker
প্রফেসর ডক্টর দেবাশিস বসু কলকাতার বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।