ফুলগাছ নিয়ে চর্চা বেশ কিছুদিন ধরেই করছি, কিন্তু জবার প্রতি আলাদা কোনও আকর্ষণ অনুভব করিনি। জবা ফুলের স্বল্প আয়ু তার অন্যতম একটা কারণ। কানাইদা (আমার ফুলগাছের শিক্ষাগুরু) যখন জবার সংকরায়ন শুরু করলেন তখন কিছুটা কৌতূহল জাগল। উনি প্রায় ১২ ধরনের নতুন জবা তৈরি করেছেন, কিন্তু নামকরণ করেছেন মাত্র কয়েকটার। যেমন, ‘নিবেদিতা’, ‘স্বপ্না’ আর ‘অয়ন’। কানাইদা ক্রমে আমার মধ্যেও সেই সংকরায়নের রোগ সংক্রমিত করলেন। তৈরি হল জবার দুটো নতুন প্রজাতি– ‘বিষ্ণু’ আর ‘মনোরঞ্জন’; শেষেরটা আমার বাবার নামে। ক্রমে খোলা বাজারে নানা প্রজাতির অনেক জবার আমদানি হতে লাগল। কি তাদের রঙের বাহার আর আকার। দর্শনেই প্রেম। এভাবেই শুরু জবার সঙ্গে আমার অনুরাগপর্ব।
জবা অর্থাৎ হিবিস্কাস (Hibiscus) একটা ‘গণ’ (genus), যার দুটো প্রজাতির (Hibiscus) দেখা মেলে আমাদের বাংলার ঘরে ঘরে। একটা ‘জবা’ (Hibiscus rosa sinesnis) আর অন্যটা ‘স্থলপদ্ম’ (Hibiscus mutabilis)। এই প্রতিপাদ্যের বিষয় ‘জবা’।
একদিন আমাদের বাড়িতে এসে কাঞ্চনের মুখেচোখে কেমন যেন একটা বিস্ময়ের ঘোর। ওর দোষ নয়, অনেকদিন বাদে এল, তাই। এর মধ্যে বেশ কিছু নতুন জবার আগমন ঘটেছে আমার বাড়িতে।

দেখতে পাচ্ছি।“
— “দেখ কাঞ্চন, ফুলের মধ্যে সাধারণ, অসাধারণ কিছু হয়না। ভাল লাগলেই হল। তা ছাড়া দেখো, দেশজ জবা, যাকে তুমি সাধারণ বলছ, তারও একটা সোঁদা সৌন্দর্য আছে। তা ছাড়া ওটা পুজোতেও লাগে।।“
— “বুঝলাম। তোমার জবা দেখে আমার মনেও জবাফুল ফোটানোর ইচ্ছে জাগছে।“
— “ঠিক তাই। জবার মতো এমন কিছু স্থায়ী ফুলগাছ করা উচিত যাতে মরসুমি ফুল শেষ হয়ে যাবার পরেও তোমার ছাদ-বাগান যেন ন্যাড়া না লাগে।“
— “এক্কেবারে ঠিক বলেছ। এবার জবা করার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দাও।“
— “দেখ কাঞ্চন, ডালিয়া করার ফলে, জল-নিকাশী ব্যাপারের বেসিকটা তোমার জানা হয়ে গেছে। এক্ষেত্রেও অনেকটা একইরকম। জবা সূর্যের আলো খুব পছন্দ করে, সারা দিনে ৬-৮ ঘন্টা রোদ তার চাই।“

— “জবার মাটি কীভাবে তৈরি করব?”
— “এটাই মূল এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দেখ, আমি বহু উপদেশ আর পরামর্শ পরিপাক করে আমার নিজের মতো একটা মিশ্রণ তৈরি করি, সেটা এইরকম:
দোআঁশলা মাটি: ৫ টব ভর্তি (৮ ইঞ্চি ব্যাসের টব)
ভার্মি কম্পোস্ট: ২৫০ গ্রাম
হাড়ের গুঁড়ো: ১০০০ গ্রাম
শিং কুঁচো: ২৫০ গ্রাম
সর্ষের খোল: ২৫০ গ্রাম
নিম খোল: ২৫০ গ্রাম
সুপার ফসফেট: ২৫০ গ্রাম
অণুখাদ্য (যেমন Tracel/Mobomin): ২৫ গ্রাম
ছত্রাক-নাশক (যেমন Blitox/Saaf): ৫০ গ্রাম
এই মিশ্রণটা ভালভাবে মিশিয়ে পলিথিনের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখবে, জলের ছিটে দিয়ে ভিজে ভাব বজায় রাখবে আর মাঝে মাঝে উলটে পালটে মিশিয়ে দেবে। এই ভাবে অন্তত ১৫ দিন রাখবে ব্যবহার করার আগে।“
— “আচ্ছা বাবুদা, তুমি কোকোপিট ব্যবহার কর না?”
— “আগে করতাম, এখন করি না। কোকোপিট দিলে বর্ষাকালে মাটিতে জল জমে। আমার বেশ কিছু জবা গাছ নষ্ট হয়েছে এই কারণে।“
— “টবে গাছ লাগাবার সময়ে কি আর কোনও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে?”
— “হ্যাঁ। কিছু জবা গাছ তুমি নেটপটে পেতে পার। কেউ কেউ নেটপট কেটে গাছ লাগায়, আমি করি না। আমার মনে হয়, না করাই ভাল। নেটপট কাটতে গিয়ে শেকড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া, নেটপট শুদ্ধু গাছ বেশ ভালই আছে আমার কাছে। প্রথমে ৬ ইঞ্চি ব্যাসের টবে লাগানো ভাল। পরের বছর প্রয়োজনে বড় টবে রি-পট করা যেতে পারে।”

— “গাছে জল দেবার ব্যাপারে আলাদা কিছু বলবে?”
— “না, আলাদা তেমন কিছু নেই। অন্যান্য গাছের মতো জল দেবে সকালে অথবা সন্ধ্যে ৭ টার পর। জল এমন ভাবে দেবে যেন টবের মাটি নীচ অবধি ভেজে। প্রত্যেক দিন গাছকে ঝারি দিয়ে চান করাবে, ধুলো ময়লার সাথে পোকামাকড় থাকলে তারাও ধুয়ে যাবে।“
— “শুনেছি রতনদা গরমকালে বিকেলে গাছকে ঠাণ্ডা জলে চান করায়। জল গরম থাকে বলে, ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে চান করায়। এই নিয়ে বৌদির সাথে ঝামেলাও লাগে।“
— “আর এই ভালবাসার দাম দেয় গাছ। রতন বাড়ি থাকলে ফুলে ভরিয়ে দেয় ।“
— “এও তো শুনেছি যে, ফুল শুকিয়ে গেলে সেটাকে কেটে ফেলতে হয়।“
— “হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। শুকনো ফুল কাটতে হবে পরবর্তী গাঁট থেকে। এতে গাছ আরও ভাল থাকবে। আর একটা ব্যাপার, জবাগাছের ডাল বছরে অন্তত একবার ছাঁটতে হয়। এতে ডাল পালা ঠিকমত থাকে, গাছের আকার ভাল হয়। তরতাজাও হয়।“

— “ডাল ছাঁটব কখন?”
— “আমি জবা গাছের ডাল ছাঁটি সাধারণত রি-পট করার ১-২ মাস পর। শীতকালের পর, ফেব্রুয়ারির শেষে অথবা মার্চে আমি রি-পট করি। রি-পট করার সময় আগের টব থেকে পুরো গাছটাকে মাটি শুদ্ধু বার করে প্রায় অর্ধেক মাটি সরিয়ে দিই। তারপর আলগা শেকড়কে ‘সিকেটার’ দিয়ে কাটার পর নতুন মাটির মিশ্রণ দিয়ে টবে লাগাই। রি-পট করা গাছ আধো ছায়ায় কিছুদিন রাখি। গাছকে চান করাই জলে ছত্রাক-নাশক গুলে।“
— “তার মানে এপ্রিল মে মাস নাগাদ তুমি ডাল ছাঁটাই কর?”
— “হ্যাঁ। শুকনো আর দুর্বল ডাল সব কেটে দিতে হবে প্রথমে। অন্যান্য ডাল ছাঁটতে হবে এমনভাবে যাতে পরবর্তী নতুন ডাল গাছটাকে সুন্দর রূপ দেয়। তবে দুর্বল গাছের ডাল ছাঁটাই না করাই ভাল। ডাল কাটার পর কাটা অংশে ছত্রাক-নাশক ওষুধ লাগাতে কিন্তু ভুলো না।“
— “আচ্ছা বাবুদা, যদি কোনও কারণে আমি রি-পট করতে না পারি, তাহলে কি আলাদা করে সার দিতে হবে?”
— “আমি সাধারণত চাপান সার আগে থেকে তৈরি করে রাখি। ভার্মি কমপোস্ট (৫০০ গ্রাম), হাড়ের গুঁড়ো (২৫০ গ্রাম), শিং কুঁচো (২৫০ গ্রাম), সর্ষের খোল (২৫০ গ্রাম), নিম খোল (২৫০ গ্রাম), N:P:K::0:0:50 (২০ গ্রাম), অণুখাদ্য (২০ গ্রাম), ছত্রাক-নাশক (২৫ গ্রাম)। এগুলো মিশিয়ে দিন ১৫ রেখে দিই। টবের চারপাশের মাটি খুঁচিয়ে আলগা করে ১ মুঠো পরিমাণ চাপান সারের মিশ্রণ দিয়ে আলগা মাটিতে সেটা মিশিয়ে দিই।“

— “মাঝেমধ্যে কি আর কোনও কিছু খাবার হিসেবে যোগান দিতে হবে?”
— “রি-পট করার কিছু দিন পর থেকে দিন ১৫ অন্তর তরল সার দিতে পার। ১০০ গ্রাম সর্ষের খোল ১ লিটার জলে ৩-৪ দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে, তার পর সেটা ছেঁকে নিয়ে ৯ লিটার জলে মিশিয়ে মাটিতে দিতে পারো।“
— “গাছকে রক্ষা করার জন্যে কি কোনও ওষুধপত্র প্রয়োগ করতে হবে?”
— “হ্যাঁ, সেটাও জানা দরকার। অন্তত দু’ধরনের পোকা মারার ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। আমার পছন্দ Confidor (0.75 ml/litre) এবং Rogor (2 ml/litre)। ১৫ দিন অন্তর একবার স্প্রে করতে হবে। এর সঙ্গে ছত্রাক-নাশক ওষুধও ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে ডাল ছাঁটার আর রি-পট করার পর।“
— “মিলি বাগ (mealy bug) এর জন্যে আলাদা কিছু করার দরকার আছে?”
— “যখনই দেখবে সাদা তুলোর মতো কিছু লেগে আছে কাণ্ডে অথবা পাতায় তখনই বুঝবে তোমার দুয়ারে ‘মিলি বাগ’। এরা সংখ্যায় কম হলে সাবানজলে তুলো ভিজিয়ে ওদের রগড়ে তুলে দাও। দলে ভারী হলে, ডাল কেটে পুড়িয়ে ফেলো। Aktara নামের ওষুধটাও তুমি স্প্রে করতে পারো। এ ছাড়াও অ্যালকোহলিক স্যানিটাইজার স্প্রে ভাল কাজ করে।”

— “বাবুদা, বাজারে এত ধরনের যে জবা দেখতে পাই, সেগুলো কি বিদেশি?”
— “কিছু বিদেশি। সাধারণ দেশি বলে আমরা যেগুলোকে জানি, সেগুলো ছাড়াও ট্রপিকাল, ব্যাঙ্গালোর, পুনে আর অস্ট্রেলিয়ান জবা এখানে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কিছু জোড়কলমের গাছও আছে। প্রচণ্ড গরমে এদের সবাইকে ছায়া দিতে হবে, সবুজ মেশ জাল ব্যবহার করে।“
— “আমাদের হালিশহরের বাড়িতে কিছু লাল জবা আছে, যেগুলোর পুংকেশর দণ্ড পাপড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে ফলে ঝুঁটির মতো দেখায়। আমরা ঝুঁটি জবা বলি।“
— “হ্যাঁ, এরকম জবা আমি দেখেছি, হলুদ রঙেরও দেখেছি। তুমি কি ওই গাছের কিছু ডাল আমাকে দিতে পার?”
— “ওমা, সে কি কথা! না দেবার কি আছে? তুমি নিশ্চয় চারা তৈরি করবে?”
— “সঠিক আন্দাজ করেছ। তুমিও চারা তৈরি করে গাছের সংখ্যা বাড়াতে পারো। একটু পুরনো ডালের এক টুকরো কেটে নাও, নিচের দিকের ছালটা ছাড়িয়ে সেখানে শেকড় তৈরির পাউডার লাগিয়ে বালিতে অথবা সাধারণ মাটিতে লাগিয়ে দাও। ছায়া আছে এমন জায়গায় রাখবে, মাটি ভিজে রাখবে, ১৫-২০ দিনের মধ্যে শেকড় গজাবে। তুমি কাটিং যে কোনও সময়ে করতে পারো, তবে বর্ষাকালে সহজে শেকড় গজায়।“
যখনই দেখবে সাদা তুলোর মতো কিছু লেগে আছে কাণ্ডে অথবা পাতায় তখনই বুঝবে তোমার দুয়ারে 'মিলি বাগ'। এরা সংখ্যায় কম হলে সাবানজলে তুলো ভিজিয়ে ওদের রগড়ে তুলে দাও। দলে ভারী হলে, ডাল কেটে পুড়িয়ে ফেলো। Aktara নামের ওষুধটাওতুমি স্প্রে করতে পারো। এ ছাড়াও অ্যালকোহলিক স্যানিটাইজার স্প্রে ভাল কাজ করে।
— “বাবুদা, হালিশহরের বাড়িতে একবার এসো, ভাল লাগবে, আর তোমার মনের মতো কাটিং-এর ডালও নিতে পারবে।“
— “তুমি বললে যখন, তখন তো যেতেই হবে। মাসিমার হাতের রান্নার স্বাদগ্রহণের সুযোগ কি ছাড়া যায়? তবে সেদিন মাসিমাকে পায়েস করতে হবে। মাসিমার হাতের পায়েস পরম উপাদেয়।“
এই সময়ে গৃহে অমরনাথদার প্রবেশ। “রান্নাঘর থেকে তো মনমাতানো সুবাস ভেসে আসছে। চিত্রিতা, কী রান্না করছ? ও, পটলের দোলমা। আমার খুব পছন্দের।“ ভোজনরসিক অমরনাথদার এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি আছে, সঠিক সময়ে আর সঠিক জায়গায় ঠিক হাজির থাকেন। রান্নাঘরের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বললেন, ”যেটুকু শুনতে পেলাম তাতে বুঝলাম তোমরা জবার ব্যাপারে আলোচনা করছিলে। সুন্দর ফুল। জান কি যে লাল জবা হল মালয়েশিয়ার জাতীয় ফুল? লাল রঙ নির্দেশ করে মালয়েশিয়াবাসীদের সাহস আর বীরত্বের। পাঁচটা পাপড়ি নির্দেশ করে দেশের পাঁচ ‘রুকুন নেগারা’ (Rukun Negara ) বা জাতীয় আদর্শ। ভগবানে বিশ্বাস, রাজা আর দেশের প্রতি আনুগত্য, সংবিধানের আধিপত্য, আইনের প্রতি মান্যতা, ভাল ব্যবহার এবং নৈতিকতা। ভেবে দেখ, মালয়েশিয়ার জাতীয় ফুল দিয়ে আমরা এখানে মা কালীর পুজো করি। দারুণ ব্যাপার, তাই না!” তারপর একটু থেমে গেয়ে উঠলেন, “মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ্ না ফুটে মন”।
অতিথির গান থামিয়ে দিয়ে চিত্রিতা বলল, ”আপাতত বসুন অমরনাথদা, মায়ের পায়ের বদলে প্লেটে মাছের পুর দেওয়া পটলের দোলমা আসছে। জবার গন্ধ না থাকলেও, আপনি এর সুবাস আগেও পেয়েছেন। গরম গরম খেয়ে নিন, ঠাণ্ডা হওয়ার আগে।”
ছবি সৌজন্য: অশোক কুমার ঘোষ ও জয় বিশ্বাস
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।