দুঃস্বপ্নের আসানো পার্ক
দুঃস্বপ্নের এটি ট্রেলার ছিল মাত্র। যত দিন গড়াতে লাগল, দুঃস্বপ্নের মাত্রা তত বেড়েই চলল। শহরের আসানো পার্ক বিস্ফোরণস্থল থেকে মাইল তিনেক দূরে। তখনও পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পার্কে এসে পড়েনি। ফলে ঘন সবুজ গাছগাছালি ভরা উদ্যান তখন আতঙ্কগ্রস্থ হিরোশিমাবাসীর (Hiroshima) কাছে মরুদ্যান স্বরূপ। অনেকে আবার ভাবছে মার্কিন বোমারু বিমান যদি ফিরে আসে তাহলে পার্ক অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কারণ বোমা পড়লে শহরের সেনা ছাউনির দিকেই পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
একটু বেলার দিকে তানিমোতো যখন পার্কে এসে পৌঁছলেন, পার্কে তিলধারণের জায়গা নেই। শয়ে শয়ে আহত পরিশ্রান্ত মানুষ পার্কে শুয়ে। তাদের মধ্যে অনেকেই তখন আর জীবিত নেই। কিন্তু সেই জনসমষ্টির মধ্যে জীবিত আর মৃতের ভাগ করা দুঃসাধ্য।
ভয় এসেছিল ৬ আগস্ট সকাল সোয়া আটটায় : কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়
আর সেই অতীন্দ্রিয় পরিবেশের মাত্রা কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল এক সর্বব্যপী নিস্তব্ধতা। গাছের পাতার মধ্য দিয়ে হাওয়া যাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ বাদে পার্কে আর কোনও শব্দ নেই। কয়েক হাজার মানুষ শুয়ে আছেন, অনেকেরই বিষ্ফোরণে ঝলসে গিয়েছে শরীর, বোঝাই যাচ্ছে মৃত্যু যন্ত্রণা তাঁদের গ্রাস করছে, তবু যন্ত্রণার কোনও বিষ্ফোরণ নেই জনতার। এমনকি শিশুরাও নির্বাক হয়ে গিয়েছে। তানিমোতো আমৃত্যু এই ভয়াবহ দৃশ্য ভুলতে পারেননি।

আসানো পার্কের পাশেই নদী। তানিমোতো ভাবলেন পার্কের কিছু লোককে যদি জলপথে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। এই সিদ্ধান্তের পিছনে একটা কারণ ছিল।
বোমার পরে বিভিন্নভাবে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আগুন ধরে গিয়েছিল। শহরে আগুন নেভানোর মতো কেউ নেই। ফলে বেলা যত বাড়তে লাগল আগুন তত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। শেষে আগুনের লেলিহান শিখা যখন পার্ককেও গ্রাস করা শুরু করল, তখন তানিমোতো প্রমাদ গুনলেন। যত জন সম্ভব মানুষকে পার্ক থেকে বার করতে হবে। পার্কের বেরোনোর গেট ততক্ষণে আগুনের গ্রাসে। ফলে জলপথই একমাত্র ভরসা।
তবে তার জন্য দরকার নৌকা। তাও তীর বরাবর একটু খোঁজাখুঁজির পর মিলে গেল। কাছে গিয়ে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পেলেন তানিমোতো। পাঁচজন যুবকের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে নৌকার উপর। বোঝাই যাচ্ছে বিষ্ফোরণের সময় এরা নৌকাটাকে নিয়ে নদীতে ভাসানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বিষ্ফোরণের তীব্রতায় তা আর করা হয়ে ওঠেনি। মনে মনে মৃতদের কাছে ক্ষমা চেয়ে লাশগুলি নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। তারপর নৌকা নিয়ে ভেসে পড়লেন উদ্ধারের কাজে।
কিছুদূরে তীরে জনাকুড়ি নরনারীকে চরে বসে থাকতে দেখে তানিমোতো নৌকা সেদিকে ঘোরালেন। কিন্তু চরে বসে থাকা কারুরই চলৎশক্তি নেই। এক মহিলার হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করলেন, মহিলার হাতের চামড়া রবারের মতো খুলে এল।

চল্লিশ বছর বা তানিমোতোর লড়াই
চল্লিশ বছর বাদে, ১৯৮৫ সালে সাংবাদিক জন হার্সে ফের গিয়েছিলেন হিরোশিমা। তাঁর কাহিনির ছয় চরিত্রের হাল হকিকৎ জানতে। সেই নব্য জানার অংশটি ‘দ্য আফটারম্যাথ’ নামে এক নতুন পরিচ্ছেদ হিসাবে তাঁর ‘হিরোশিমা’ বইয়ের সঙ্গে জুড়েও দিয়েছেন হার্সে।
সেই নতুন অংশেই হিরোশিমা মেথডিস্ট চার্চের রেভারেন্ড কিয়োশি তানিমোতোর উত্তরণের এক অত্যাশ্চর্য কাহিনি শুনিয়েছেন হার্সে। তানিমোতোর কাহিনি কিন্তু সেই অভিশপ্ত দিনেই আবদ্ধ থাকেনি। যাজক ওই দিন কয়েকজনকে উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হননি। ক্রমে তিনি নিজেকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মেলে ধরেছেন। একদিনে তা হয়নি। পদে পদে বাধা, পদে পদে বিপত্তি। কিন্তু কোনও বাধাই শেষমেষ তানিমোতোকে আটকাতে পারেনি।
শুরুটা করেছিলেন নিজের এতদিনের কর্মক্ষেত্র হিরোশিমার মেথডিস্ট গীর্জাটাকে নিয়ে। বোমার ঘায়ে গীর্জার বেশিরভাগ অংশই ভেঙে পড়েছে। তাই তানিমোতো প্রথমেই গীর্জা সারানোর দিকে মন দিলেন। কিন্তু বলা যত সোজা করাটা ততটাই কঠিন। কাজে নেমে তা হাড়ে হাড়ে মালুম হল তাঁর। গীর্জা মেরামত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু যুদ্ধবিধস্ত জাপানে কে দেবে এই অর্থ? ফলে তানিমোতো গীর্জা সংস্কারের কাজ নিয়ে খুব বেশিদূর এগোতে পারলেন না।

সমস্যা জানিয়ে চিঠি লিখলেন তাঁর এককালের সহপাঠী মার্কিন যাজক রেভারেন্ড মার্ভিন গ্রিনকে। মার্কিন রাজ্য নিউ জার্সির উইহকিনের পার্ক চার্চের যাজক হলেন এই গ্রিন সাহেব। তিনি তানিমোতোকে আমন্ত্রণ জানালেন আমেরিকায় আসার জন্য। উদ্দেশ্য বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা দিয়ে গীর্জা মেরামতের অর্থ যোগাড় করা।
তাই হল। ১৯৪৮ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন রণতরী ইউএসএস গর্ডনে চেপে সান ফ্রান্সিস্কো গেলেন তানিমোতো। জাহাজ যাত্রার সময়ই তাঁর মাথায় এল হিরোশিমাতে বিশ্বশান্তির এক কেন্দ্র করার কথা। সেই চিন্তাকে সামনে রেখেই তৈরি করলেন “ফেইথ দ্যাট গ্রিউ আউট অফ অ্যাসেজ” বক্তৃতা যা তিনি বিভিন্ন মার্কিন শহরের গীর্জায় বলতে লাগলেন। এই বক্তৃতা সফরের মাঝেই নিউ ইয়র্কে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল নোবেল জয়ী বিশ্ববিশ্রুত মার্কিন লেখিকা পার্ল এস বাকের সঙ্গে। পরবর্তীকালে তানিমোতোর কর্মকাণ্ডের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ান বাক।
এখানেই শেষ নয়। মার্কিন সাহিত্য পত্রিকা দ্য সাটারডে রিভিউ অফ লিটারেচারের সম্পাদক নর্মান কাজিন্সের সহায়তায় পত্রিকার ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ তারিখের সংখ্যায় তানিমোতোর লেখা “হিরোশিমাস আইডিয়া’ প্রকাশিত হল। চারিদিকে জাপানি যাজকের নাম ছড়িয়ে পড়ল।
তানিমোতো তাতে আশাতীতভাবে সফল। প্রায় দেড় বছর ধরে আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূল চষে ফেলেছেন তিনি, বক্তৃতা দিয়েছেন নয় নয় করে ৩১ রাজ্যের ২৫৬টা শহরের গীর্জায়, সংগ্রহ হয়েছে হাজার দশেক ডলার। জাপান ফেরার সময় কাজিন্স তাঁর ক্যাডিলাক গাড়িটাও তানিমোতোর গীর্জাকে দান করে দিলেন।
অবশ্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরোধিতায় হিরোশিমাতে তানিমোতোর সাধের ‘বিশ্বশান্তি কেন্দ্র’ তক্ষুনি করা হল না। পরে তাঁর কাজ সহজ করে দেন কাজিন্স। নিউইয়র্কে ‘হিরোশিমা পিস সেন্টার ফাউন্ডেশন’ স্থাপন করেন কাজিন্স আর হিরোশিমাতে তানিমোতোর মেথডিস্ট চার্চ হয় ফাউন্ডেশনের মূল কেন্দ্র। অর্থ্যাৎ ঘুরপথে হলেও তানিমোতোর স্বপ্ন সাকার হতে শুরু করল।

কাজিন্সের আমন্ত্রণে ১৯৫০ সালে ফের আমেরিকা যাত্রা করলেন তানিমোতো। এ বারের মাস আষ্টেকের সফরে ছিল ২৪টা রাজ্যের ২০১টা শহর। ১৯৫১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন বিদেশ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁর ভাষণ শুনে মুগ্ধ মার্কিন সাংসদকূল। ভার্জিনিয়া রাজ্যের সেনেটর উইলিস রবার্টসন তো বলেই ফেললেন, ”যে মানুষটাকে আমরা পারমাণবিক বোমা ফেলে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম, সেই আজ সেনেটে দাঁড়িয়ে আমাদের মঙ্গল কামনা করলেন।“
১৯৫৪ সালে রালফ এডওর্য়াড উপস্থাপিত জনপ্রিয় টেলিভিশন শো ‘দিস ইজ ইয়োর লাইফ’ অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলা এনোলা গে বোমারু বিমানের সহ চালক ক্যাপ্টেন রবার্ট লুইসের। এডোয়ার্ড লুইসকে জিজ্ঞাসা করেন, ”লগ বুকে কিছু লিখেছিলেন?” লুইস জবাব দেন, ”হ্যাঁ। লিখেছিলাম হা ঈশ্বর, এ কী করলাম আমরা?”
ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকার সঙ্গে লড়েছিলেন তানিমোতো। সেটাই ভয়কে জয় করার একমাত্র রাস্তা।
তথ্য সূত্র: জন রিচার্ড হার্সে-‘হিরোশিমা’
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে