চোখ বুঁজে ফেলেছিলেন আহসান খাঁ। শরীর থেকে জ্যা মুক্ত তীরের ফলার মতো মন ছুটে গিয়েছিল যৌবনের দৃশ্যে।
বাংলার এই পুষ্পপল্লবিত জ্যোৎস্না বড় প্রিয় ছিল আহসানের। ঘোড়ার নাল পশ্চিমের কঠিন পাথরে যে তীব্র ধ্বনি তোলে তার চেয়ে নরম মাটিতে পা চেপে চলার আওয়াজ অনেক বেশি শ্রুতিমধুর। যেন শ্রীরাধা পায়জোড় রেশমে মুড়ে কর্দমপিচ্ছিল পথে অভিসারে চলেছেন।
এক বর্ষার দিনে তাকে প্রথম দেখেছিলেন যুবক আহসান।
প্রথমবার বুড়িগঙ্গার তীরে পা রেখেছে সে। গঙ্গার ঘাটে বসে দেখেছিল দুটি গেহু-রঙা পায়ে পায়জোড়ে ঝমঝমিয়ে জল থেকে উঠে আসছে সেই নারী। সিক্ত অঙ্গ দিয়ে জলধারা নুপুর ধুয়ে আলতার রঙে মিশে যাচ্ছে। তাহলে হিন্দু রমণী!
দ্রুত সেই ভরন্ত শরীর ছাড়িয়ে সীমন্তের দিকে তাকায়। কই সেই রক্তাক্ত নদী রেখার চিহ্ন কই? তাতার সেনার লাশে বমি ওগরাতে ওগরাতে মুসাব্বির আহসান যখন দূর অজানা দেশে পাড়ি দিয়েছিল, প্রথম প্রথম অবাক হয়েছিল কপাল ফাটানো চিহ্ন দেখে! পরে বুঝেছিল এদেশের বিবাহিতা নারীর সীমন্তে রক্ত-রেখায় এক নিষেধ চিহ্ন থাকে। কিন্তু এই নারীর সিঁথিতে সেই চিহ্ন নেই। তার মানে এ শাসন মুক্ত!
সেই মুহূর্ত থেকে মুগ্ধ তুর্কির চোখে চোখ রেখে যে কষাঘাত দিয়ে গেছিল চম্পা, তা যেন কীলক খণ্ডের মতো মাটিতে গেঁথে দিয়ে গেল তাকে। প্রতিটি ক্ষণ প্রতিটি বল মনে আছে আহসানের। পূর্বজীবনে যে ছিল সন্ধ্যামণি তারই মুখে চম্পারানি হয়ে ওঠার গল্প শুনেছিল।
সাধারণ এক শিষ্যের স্ত্রীকে এক পণ্ডিতের ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া আর অচিরেই তাকে পরিত্যাগ করে আস্তাকুঁড়ে নামিয়ে দেওয়ার গল্প। আমোদগলির চম্পারানির প্রতি যুবক আহসানের পার্বত্য ঝোরার মতো প্রেম দুই বর্ষাকাল টিকে গিয়েছিল। অনিচ্ছুক চম্পার তুর্কির দুর্দমনীয় আবেগের কাছে হার মানার কথাও মনে আছে। তাঁর তো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মতো জাতপাতের বোঝা ছিল না, তিনিই বা পারলেন কোথায় চম্পাকে বিবাহ করে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে? তাকে বিবাহ করতে আভিজাত্যে লেগেছিল তাঁর।
রাগলেখা জানিয়েছে শ্মশানে নয় বৈষ্ণব হিসেবে সন্ধ্যামণি সমাধি লাভ করেছেন।
আহসান খাঁ গুন গুন করে বন্ধু আকবর আলীর এক বৈষ্ণব পদ গাইতে থাকেন, এক ঘরে শুইয়া থাকি
সুদিন স্বপন দেখি,
আমার কর্ম দোষে
না পাইলাম জায়গা-
সন্ধ্যামণি মৃত্যুকালে জানিয়েছিলেন আহসান খাঁর কাছে তাঁর কিছু দুর্বল মুহূর্তের সাক্ষ্য থেকে গেছে। তাই তাকে পত্র লিখে ডেকে আনা।
মুক্ত হয়েছেন আজ খাঁ সাহেব। সমর্পণ করেছেন তাঁর চিত্র পেটিকা। পাপ স্বীকার করেছেন নিজমুখে। দোজখে যে যাবেন, তা নিশ্চিত! তাই দোজখের ভয় নেই তাঁর। এখন শুধু অতীত উড়িয়ে মণিমঞ্জুলার কাছে ছুটে যাওয়া। শেখ হিঙ্গানদের সঙ্গে দেখা না করে খবর পাঠালেন যে তিনি জরুরী কাজে মুর্শিদাবাদে ফিরে যাচ্ছেন। নওকরদের ঘোড়া প্রস্তুত করার আদেশ দিলেন আহসান খাঁ।
দর্পণের সামনে স্থির বসে থাকে রাগলেখা। তার এই ক্ষুদ্র জীবন যেন সাগরের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তার নবীন ত্বক যেন কোন সংবাদই রাখে না প্রায়-বৃদ্ধ অন্তরের। প্রকৃত বৈষ্ণবী সে হল কই? এত অস্থিরতা, এত ঘৃণা পুষে সে কীভাবে শান্তি লাভ করবে?
তার জীবনে তো সন্ধ্যামণি ওরফে চম্পার ব্যর্থতা নেই কিন্তু ছায়া আছে। দর্পণে বিম্বিত উজ্জ্বল মসৃণ ত্বকে, কাচের মতো স্বচ্ছ গাত্রবর্ণে, বঙ্কিম দুই আঁখি পল্লবে ছেয়ে আছে চম্পার হুবহু আদল!
মন যতই বিপ্রতীপে যাক শরীর তার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এই শরীরেই পুনর্জন্ম ঘটেছে পণ্ডিত ব্রজদেবের নিয়তির। আহসান খাঁ সাহেবের স্মৃতিকাতরতার। অজান্তেই যেন সফল হয়েছে তার প্রতিহিংসা। ব্রাহ্মণ ও তুরুকের আর্য রক্তে যেন এতদিন পর সন্ধ্যামণির ক্ষুব্ধ সমাধিতে শান্তির বারি ধারা বর্ষিত হচ্ছে।
আরশি নামিয়ে রাখে সে। আজ আর সে অভিশপ্ত নয়। রূপমঞ্জরী কে দিইয়ে মুর্শিদকুলিকে পত্র লিখিয়ে ছিল। না হলে হয়তো এত গুরুত্বসহকারে বিতর্কসভার আয়োজন করতেন না দেওয়ান।
সন্ধ্যামণি মৃত্যুকালে জানিয়েছিলেন আহসান খাঁর কাছে তাঁর কিছু দুর্বল মুহূর্তের সাক্ষ্য থেকে গেছে। তাই তাকে পত্র লিখে ডেকে আনা। তাছাড়া আহসান খাঁ যখন আমোদগলির চম্পার কাছে যেত, দুয়ারে বাঁধা ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি আর পুরীষের গন্ধে ভয়ের কাঁপুনি ধরে যেত দরজার বাইরে অপেক্ষারত ছোট্ট মেয়েটির বুকে। গলির অন্যরা বলত, মাকে চোখে চোখে রাখিস। কোনদিন খাঁ সাহেবের সঙ্গে ওই পক্ষীরাজে উড়ে যাবে! তাই আহসান এলে দরজা ছেড়ে নড়ত না সে। অন্য মেয়েরা খেলতে ডাকলেও নয়। দরজার ছিদ্র দিয়ে তাই অনায়াসে সে মায়ের অনাবৃত শরীরের ছবি আঁকতে দেখেছে আহসানকে। আহসানের মনে থাকার কথা নয় চম্পার দরজার বাইরে অপেক্ষারত ভাগ্যহত শিশুকন্যাটির কথা! কিন্তু এসব কথা আর কাউকে নয় সুবাহুকে জানানো দরকার। একমাত্র সুবাহু তাকে বিনা স্বার্থে গ্রহণ করেছে। সন্ধ্যামণির বহুমূল্য অলংকার সম্পদ আখড়ায় দান করে প্রবেশ করেছিল কিন্তু সুবাহু সে সবের খবর রাখেনি। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে রাগলেখা। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে মাথা। রূপমঞ্জরীকে ডেকে পাঠায়। চিত্রগুলো সে দেখবে না। তার মা সন্ধ্যামণি মৃত্যুর সময় প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল। এবারের পত্রটি হবে তার পরম প্রণয়ার্ণব সুবাহুর প্রতি নিবেদিত প্রথম ও শেষ পত্র।
সুবাহু এই কয় মাসে বিশেষত শেষের কটা দিন যেন এক লহমায় যৌবনের চাপল্য ত্যাগ করেছে। একদিন সে শাস্ত্রী মশাইয়ের প্রায়শ্চিত্ত পত্র নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কদিন আগে যে পরকীয়া ভাবের বিপক্ষ পক্ষের পণ্ডিত ব্রজদেবের মূর্ছিত প্রায় অবস্থা দেখে গোপনে আনন্দ পেয়েছিল, আজ সেই সুবাহু শাস্ত্রীর হাত থেকে সন্ধ্যামণি ফারখতি পত্র গ্রহণ করেছে! কোথায় গেল তার রুচি ও উদারতা? শোকের মতো ঔদার্যও তাহলে ব্যক্তিগত? শাস্ত্রী উপযুক্ত সময়ের জন্য পত্রটি জোগাড় করে রেখেছিল বুঝেও সে কোন নীচতায় গ্রহণ করল? একজনের পরাজয় যখন অন্যের বিজয় উন্মাদনা জাগায়, আর সেই বিজয়ে যখন পরাজিত শূন্যের অতল কুয়োয় প্রবেশ করে, আর সেই অতলস্পর্শী মুখটির প্রতি কণায় লেগে থাকে মনুষ্যত্বের নির্বাণ, তখন কেমন হবে একজন প্রকৃত বৈষ্ণবের প্রতিক্রিয়া? কেমন আচরণ করবে সে? বিভিন্ন স্তরে উঠে আসা পরস্পর বিপরীত অনুভূতির মধ্যে বেছে নেবে কাকে?
রাগলেখা হাসে। বুক ভেঙে যায় সুবাহুর।
রাগলেখা বলে,ভালই হল বুঝলে? একদিক থেকে ভালই হল। সংসার সবার জন্য নয়। অমৃত বলে যা পান করেছি তা আসলে বিষ। হয়তো কেউ কেউ সারা জীবন অমৃতের সন্ধানে বিষই লাভ করে। ভাল, নিজের জীবনে থিতু হও। এখন তোমার সামনে অনেক কাজ অনেক কাজ। মান যশ-
সুবাহু জোর এনে শুকনো গলায় বলে, বললাম তো, সেভাবে সিদ্ধান্ত নিইনি। বোঝই তো দ্বিতীয় বিবাহে তেমন বাধা নেই, কিন্তু শিখীকে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। ওর তো কোনও দোষ নেই। তুমি বা ও কেউ কারও সঙ্গে থাকবে না। শাস্ত্রীমশাইদের সঙ্গে একটু আলোচনা করি। পিতা নেই কিন্তু মায়ের অনুমতি প্রয়োজন।
আজ আর সে অভিশপ্ত নয়। রূপমঞ্জরী কে দিইয়ে মুর্শিদকুলিকে পত্র লিখিয়ে ছিল। না হলে হয়তো এত গুরুত্বসহকারে বিতর্কসভার আয়োজন করতেন না দেওয়ান।
রাগলেখা এবারে সুবাহুর সামনে এসে দাঁড়ায়, অবাক গলায় বলে, সে কি? তোমার পিতামাতার কথা তো কখনও শুনিনি? এই যে শুনতাম ঠাকুরমশাই তোমার পিতা ও মাতা? রাধামোহন ঠাকুরের কথাই তোমার জীবনের শেষ কথা?
সুবাহু শুকনো গলায় বলে, ব্যক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তে পিতামাতাকে প্রয়োজন অবশ্যই-
রাগলেখা স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, বলে, তাই তো? শাস্ত্রীমশাই কে বলতে হবে! মায়ের অনুমতি লাগবে! তা সম্পর্ক গড়ার সময় ওঁরা অনুমতি দিয়েছিলেন তো? এই উদ্যানবাটীতে আমি যে আছি, তোমার রক্ষিতা হয়ে আছি বলেই অনুমতি লাগে নি, তাই তো?
সুবাহু কথা হাতড়াতে থাকে-
রাগলেখা রুদ্ধ গলায় বলে, এতদিন সমাজের গায়ে লাগেনি, এখন বিবাহের প্রশ্নে এত কথা উঠছে তাই তো?
বৈষ্ণবের সমাজও এমন পাথর? সমাজ! সমাজের নাম করে ভণ্ড কাপুরুষেরা মেয়েদের ভয় দেখায়, অন্ধ করে দেয়, শেষ পর্যন্ত তুমিও? তুমিও? সুবাহু? তুমিও? রাগলেখা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে।
শেষের দিকে কান্নায় জড়িয়ে আসা কথাগুলো এমন ভাবে আলো-ছায়ায় মিশে যায় দু’হাত দূরে থাকা সুবাহুর কানেও স্পষ্টভাবে প্রবেশ করে না। সে কিছু বলতে পারে না। একবার মনে হয় কাছে টেনে সমস্ত অভিযোগ মুছিয়ে মান ভাঙিয়ে দেয়। তার যা প্রতিপত্তি বাড়ছে তাতে একটি অনাথ কন্যাকে এক কোণে আশ্রয় দিলে সমাজ তেমন বিরক্ত হবে না। রাগলেখা অন্তরীণে থাকার মতো তুচ্ছ নয়। আবার বিনা দোষে শিখীকে ত্যাগ করলে সমাজের চোখে ছোট হয়ে যাবে সে। শিখী অতি সাধারণ কিন্তু অল্পবয়সী। রাগলেখার গর্ভের সন্তান কেমন হবে কে জানে! তার অতীত ছায়াচ্ছন্ন।
রাগলেখা কাঁদে। সুবাহুর জন্য কাঁদে।অপেক্ষা করে কখন উজ্জ্বল দীপ নিভিয়ে পূর্বের মতো মিলিত হবে সুবাহু। মিথ্যা আশঙ্কা উড়িয়ে পুড়ে মিশে যাবে। সুবাহু চুপচাপ বসে থাকে। মাথা নিচু। সর্বাঙ্গে অবসাদ তার। নিশ্চেষ্ট শরীরে-মনে কোনও আগ্রহ নেই মিলনের। রাধাবিরহের শ্লোক মনে পড়ে। জোর করে ওঠে সুবাহু। রাগলেখার কাছে যায়। জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বোলায়। শান্ত করার চেষ্টা করে। কান্নার দমকে দমকে হিক্কা ওঠে রাগলেখার। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চায় সুবাহুকে। সুবাহুর শরীরের অনাগ্রহ অগ্রাহ্য করেও সে মিলিত হতে চায়। সুবাহু তাকে সান্ত্বনা দেয় কিন্তু তার কোমলতা কাঠিন্যে পরিণত হয় না। দীপশিখা অনির্বাণ জ্বলে। সুবাহু আজ আর নেভায় না তাকে।
ছবি সৌজন্য: Pinterest
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১১ মার্চ ২০২১
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।
One Response
এই ধারাবাহিকে বিভোর হয়ে আছি।