বারো ভুঁইয়াদের কর্মকাণ্ডে ইদানীং মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের উপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না। মুর্শিদকুলি অবশ্য ব্যতিক্রম। দিল্লির শাসক কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার দেওয়ান হলেও ওঁকে অনেকেই সুবেদার বলে। দক্ষ ও বিচক্ষণ শাসক হিসেবে প্রকৃতপক্ষে সম্রাটের মতো ক্ষমতা তাঁর। ন্যায়বিচারেও নির্মম সুনাম আছে। এই তো কিছুদিন আগে সধবা কুললক্ষ্মী অপহরণের দায়ে হুগলির দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোতোয়াল ইমাম-আল-দীনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তারচেয়েও বড় কথা নিজের এক নিকটাত্মীয়কেও নাকি অনুরূপ দণ্ডদান করেছেন তিনি। চতু্র্দিকে নজর তাঁর।
নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যে ইদানীং বৈষ্ণবের আখড়ার দিকে ঝুঁকছে, খেয়াল করছিলেন তিনি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব পণ্ডিতরা নিজেরা শুদ্ধ জীবন যাপন করলেও এযাবৎ পতিত, অপাংক্তেয় নর-নারীর জন্য হিন্দু সমাজের দ্বার অবারিত করে দিচ্ছেন, এসব নজর এড়ায়নি তাঁর। বৈষ্ণবরা সমাজে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখছেন, কারণ প্রেম ও মানবধর্ম তাঁদের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে। ছোঁয়াছুঁয়ি জাতপাতের ভেদ কমিয়ে দিচ্ছেন এঁরা। বাংলায় অবস্থিত ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমারদের সঙ্গে তিনি বাণিজ্য করছেন বলেই বুঝতে পারছেন এসব অজানা শ্বেতাঙ্গরা তেমন বিশ্বস্ত নয়। ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করতে হিন্দুদের বেশি করে পাশে পাওয়া প্রয়োজন।
[the_ad id=”266918″]
মুর্শিদকুলি আজ চিন্তিত। মালিহাটি গ্রাম বৈষ্ণবদের এক প্রধান আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখান থেকে আসা এক পত্র আজ তাঁর চিন্তার কারণ। ডেকে পাঠিয়েছেন একান্ত আস্থাভাজন রঘুনন্দন স্বামী ও আহসান খাঁ-কে। রঘুনন্দন তাঁকে সশিষ্য, সপরিকর বজ্রদেবের আগমন অভিপ্রায় জানান। নবাব বিস্মিত! শুধুমাত্র রাধা পরকীয়া না স্বকীয়া নায়িকা, এই মত প্রতিষ্ঠা বা খারিজের জন্য এত বড় যুদ্ধযাত্রা!
হেসে উত্তর দেন রঘুনন্দন, ‘আর যাই হোক, যুদ্ধযাত্রার সঙ্গে তুলনা করবেন না! নাতিপ্রশস্ত সৈন্যবাহিনী দ্বারা আপনি যত যুদ্ধ জয় করেছেন, তার সমতুল্য আর কোনও কিছুই নেই।’

প্রীত হন মুর্শিদকুলি খান। বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা ঠিক থাকলে, প্রজাদের ন্যূনতম দাবিদাওয়া পূরণ করলে সেনার প্রয়োজন হয় না। আর আপনি যা বলছেন, এই যে মালিহাটির রাধামোহন ঠাকুরের গৃহে মহাবিতর্কের সূচনা হতে যাচ্ছে, এ-ও একরকম আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। এ বিতর্কে যে পক্ষ জিতবে, বৃন্দাবনে তাদের মত প্রতিষ্ঠিত হবে। আর কে না জানে, বৃন্দাবন দখল না করলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মত, উচ্চবর্ণের আগ্রাসন থেকে বেশিদিন বাঁচবে না। চৈতন্য-অনুসারীরা যত শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নেড়া-নেড়িদের আখড়ায় ঠাঁই দিচ্ছে, ব্রাহ্মণরা তা ভাল চোখে দেখবে বলতে চান?’
রঘুনন্দন ঈষৎ রুষ্ট হন, কিন্তু প্রকাশ করেন না। বলেন, ‘দেওয়ান সাহেবের ব্রাহ্মণ বিষয়ে এমন নিখুঁত ধারণা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারছি না।’
[the_ad id=”266919″]
শর্মার মনোভাব খেয়াল করে স্মিত হেসে মুর্শিদকুলি উত্তর দেন, ‘বহু সংবাদ রাখেন পণ্ডিত! আপনি বোধহয় বিস্মৃত হয়েছেন, একজন প্রশাসককে প্রজাদের সকল খবরই সংগ্রহ করতে হয়।’ নবাবের কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন আহসান খাঁ। রঘুনন্দনের গম্ভীর মুখের দিকে না তাকিয়ে আহসান খাঁ-কে পত্র লিখতে আদেশ দেন মুর্শিদকুলি।
আহসান খাঁ এতক্ষণ চুপ করে নবাবের কথা শুনছিলেন। এবার ইতস্তত করে বলেন, ‘মুশকিল হল কী, ওখান থেকে একইসঙ্গে আমিও একটি পত্র পেয়েছি।’ সাফাই দেবার ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমার পুরনো পরিচিত কেউ হয়তো তসবিরের কথা জানিয়েছে। হয়তো সে কারণেই আগের সব ছবি নিয়ে যেতে বলেছে। ওখানে কেউ আছেন যিনি আমার আঁকা পুরনো ছবিগুলো দেখতে চান।’
নবাব সকৌতুকে বলেন, ‘তাই নাকি? আমার সভাসদদের উপর এত নজর? তা এক গৌড়ীয় রমণী শুনি অন্য বেগমদের আপনার কাছে ঘেঁষতে দেন না? নতুন করে আর বিপদ ডাকবেন না! আপনি আমার দরবারের সেরা মুসাব্বির। দেখবেন যেন আবার কোন হিন্দু মেয়ের পাল্লায় পড়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাবেন না যাতে আমাকে আবার ফৌজ পাঠিয়ে আপনাকে তুলে আনতে হয়!’
[the_ad id=”270084″]
আহসান খাঁ তার ধূসর নীল চোখ তুলে বলেন, ‘আপনি আমার সম্রাট। যে ইজ্জত দিয়েছেন, ইন্তেকাল অবধি ভুলি তো দোজ়খ কবুল। যাচ্ছি আপনার আদেশে আর সত্যি বলতে খানিক কৌতূহলে।’ নবাব হালকা সুর পাল্টে বলেন, ‘ওরা না ডাকলেও আপনার নেতৃত্বে আমার লোকজনকে পাঠাতাম। এই বাংলা আপনার মতো পণ্ডিতও চেনেন না। কী বলেন? খাঁ সাহেবই যান, নাকি?’
রঘুনন্দন সানন্দে সম্মতি দেন। আলাভোলা তুরুকটার মতো মাঠে-ঘাটে জ্যোৎস্নারাতে ঘোরা আর রং-তুলি নিয়ে বসা, কোনওটাই তাঁর সইবে না। কর্দমাক্ত গ্রামগঞ্জ আর সর্পকূলময় পথঘাট এবং নৈশকালে ভেকের ডাক মোটেই ভাল লাগে না তাঁর।
খাঁ সাহেবের হাতের লেখা ইস্পাহানি তরোয়ালের মতো। কোথাও এতটুকু টাল খায় না। নবাবের আদেশমতো লেখেন, “পাতসাই শুভা শ্রীযুত নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সাহেব নিকট দরখাস্ত হইল জিহা করিলেন, ধর্মাধর্ম বিনা তাজবিজ (বিচার-বিবেচনা) হয় না অতএব বিচার কবুল করিলেন।’
মুর্শিদকুলি বলেন, ‘এই পত্রসহ যাত্রা করুন আপনারা। আর সাক্ষী হিসেবে যাদের উপস্থিত থাকতে বলেছি, তারা বিধর্মী হলেও পণ্ডিত– এটা খেয়াল রাখতে বলবেন। মালিহাটি থেকে যে অনুমতিপত্র এসেছে, সেটির লিপিকর সম্ভবত পুরুষ নয়, ওটাও একটু নজরে রাখবেন। হিন্দু পণ্ডিতরা আজকাল বৈষ্ণবীদের দিয়েও পত্র লেখাচ্ছে! গুরুতর ব্যাপার!’
পরবর্তী পর্ব ৪ ফেব্রুয়ারি
*ছবি সৌজন্য Pinterest
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।
2 Responses
একটা বিশেষ সময়ের চালচিত্রে বিধৃত লেখাটি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। অতীত কথা বলছে খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে। চরিত্রগুলি ঐতিহাসিক, কিন্তু সুদূর নয়। আখ্যান এগিয়ে চলুক, সঙ্গে আমরা, পাঠকেরাও।
ভালো লেগেছে