১৮৯৭ সাল। বোম্বাইতে আছড়ে পড়েছে প্লেগ। আরব সাগরের তীর শূন্য করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সবাই। নাকমুখ ঢেকে, মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে থাকার চেষ্টা করছে মানুষই। ইঁদুর, মরা ইঁদুর থেকে হয় এই মহামারি– এমনটা জানতে লেগে যাবে আরও কিছুটা সময়।
মৃত ইঁদুর বা বাদুড়– ১৮৯৭ বা ২০২০– মহামারির গ্রাসের আগ্রাসন, তার চেহারা বদলাল কই? সেই একই ভীতি, সেই একই অসহায়তা। আর একইভাবে, সেই বিপদের মুহূর্তে দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য এগিয়ে আসার মানুষজন। আজ এই মুহুর্তে আমরা সবাই যখন অভিবাদন জানাচ্ছি যুবশক্তির পরার্থপরতাকে, কোভিড মহামারি মোকাবিলায় তাদের ভূমিকার জন্য, তখন ইতিহাসের ছায়াপথ থেকে তাদের অভিনন্দন জানাতে দাঁড়িয়েছেন আমাদের চেনা চরিত্ররা– সাবিত্রী বাঈ, ছত্রপতি সাহু যেমন আছেন, তেমনই আছেন আমাদের বড় কাছের ভগিনী নিবেদিতা। নিজে হাতে রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছেন নিবেদিতা, প্লেগে আক্রান্ত কলকাতাবাসীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, নিজের জীবনমৃত্যুর তোয়াক্কা না করে প্লেগ রোগীর শুশ্রুষা করছেন… এ ছবি তো আজও উজ্জ্বল সেই ইতিহাসের ছায়াপথে।
কিন্তু সাবিত্রীবাঈ? বা ছত্রপতি সাহু? তাঁরা কীভাবে যুক্ত এই অতিমারির ইতিহাসের সঙ্গে? এখনও অবধি আমরা দেখে এসেছি দলিতদের অবস্থান, দলিত নারীপুরুষের শিক্ষার জন্য সমাজের বিরুদ্ধে, সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন জ্যোতিবা-সাবিত্রী। দেখেছি, সাবিত্রী ফতিমা শেখের শাড়ি আবর্জনা, কালিমাসিক্ত হচ্ছে– তবু থামছে না সংগ্রাম। একই জীবনরেখ পেয়েছি ছত্রপতি সাহুর ক্ষেত্রেও। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, ক্ষাত্রগুরু নিয়োগের মতো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহের পক্ষে প্রশাসনিক আইনি পদক্ষেপের অবস্থানকে কুর্নিশ জানিয়েছি আগের বেশ কিছু পর্বে, একে একে।

কিন্তু অতিমারির আবহে তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা কী? কেন তাঁরা ছায়াপথ থেকে অভিবাদন জানাচ্ছেন আজকের অতিমারির ভলেন্টিয়ারদের? সে কথার উত্তর দিতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও এক ধাপ। ইতিহাসের এ এক মজার খেলা। জানার জগতে একধাপ এগোতে চাইছি, আরও বেশি করে বুঝতে চাইছি। তাই বেশি এগোবার জন্য পিছিয়ে যাব আরও একধাপ।
১৮৯৭ সালের কথা বলছিলাম। পৃথিবীব্যাপী বিউবোনিক প্লেগের তৃতীয় ঢেউ এসে পড়েছে। বম্বে প্রেসিডেন্সির পরেই পুণে এবং নালাসোপারা এলাকায় আছড়ে পরে প্লেগ। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন বিনা চিকিৎসায়। এমন সময় কি সাবিত্রীবাঈ চুপ থাকতে পারেন? জ্যোতিবা মারা গেছেন কয়েক বছর হল। সাবিত্রী তখন একা। তবু পিছিয়ে থাকলেন না। সেবা করতে শুরু করলেন। দত্তকপুত্র যশবন্তের সঙ্গে পুণের বাইরে নালাসোপারায় গড়ে তুললেন এক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা হত প্লেগরোগীদের।
প্লেগ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, এমন সময় খবর আসে যে পুণে থেকে দূরে অবস্থিত মুন্ডওয়াতে, মাহার জাতের বসতিতে, সাবিত্রীবাঈদের পরিচিত পান্ডুরং বাবাজি গায়কোওয়াডের পাঁচ বছরের ছেলে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে। নিজে ছুটে যান সাবিত্রীবাঈ, অন্য যানবাহন না পেয়ে কোলে করে সেই ছেলেটিকে নিয়ে আসেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ছেলেটি প্রাণে বেঁচে যায়, কিন্তু প্লেগ আক্রান্ত হয়ে যান সাবিত্রীবাঈ। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই, ৬৬ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। সেই সাবিত্রীবাঈ, যিনি মাত্র এগারো বছর বয়সে এসেছিলেন জ্যোতিবার স্ত্রী হয়ে, স্বামীর উৎসাহে শিক্ষার এক সোপান থেকে আর এক সোপানে পৌঁছেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন দলিতদের শিক্ষা সম্মানের জন্য– মহামারির মূল্য চুকিয়ে বিদায় নিলেন।

ছত্রপতি, যিনি পতাকা বহন করবেন এই ভাবধারার, তাঁর বয়স তখন ২০ বছর। কোলাপুরের রানি তাঁকে দত্তক নিয়েছেন কয়েকবছর আগে। আর কয়েকবছরের মধ্যেই ছত্রপতি হয়ে উঠবেন ছত্রপতি সাহু মহারাজ, তা আমরা ইতিমধ্যেই জানি। ইতিহাসের চাকা ১৮৯৭ সাল থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে পৌঁছবে ১৯২০ সালে। ততদিনে ছত্রপতি সাহু মহারাজের রাজত্বকাল পেরিয়েছে ২৬ বছর। তৈরি হয়েছে সব ধর্মের একসঙ্গে পড়ার কলেজ, মেয়েদের পড়াশুনোর সব সুযোগসুবিধা, সব ছাত্রীনিবাস। আবার একইসঙ্গে তৈরি হয়েছে কাপড়ের কল, আর তার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
প্রজন্মলালিত দেবদাসীদের যে অবমাননা, তার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে যে পিছপা হন না ছত্রপতি– তার অবিশ্বাস্য কথন আমরা দেখি ঠিক এর আগের পর্বেই। তাই আমাদের গল্পের পথ বেয়ে ইতিহাসের চাকা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯২০ সালে। স্থান ভারতবর্ষ। একইসঙ্গে সেই সময় ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন যুগপুরুষরা। আছেন স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, সদ্য শুরু করেছেন ভারতবর্ষের মাটিতে জালিয়ানওয়ালাবাগ ও রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রথম অহিংস গণআন্দোলন– অসহযোগ।
ঠিক সেই মুহুর্তে ভারতবর্ষের মাটিতে আছেন তরুণ ভীমরাও বাবাসাহেব আম্বেদকরও। তিনি তখন যুব দলিত নেতা, আইনি লড়াইয়ে নামছেন দলিতদের স্বার্থরক্ষার জন্য। আর এই প্রয়াসে তিনি পাশে পাচ্ছেন ছত্রপতি সাহু মহারাজকে। ইতিহাসের সঙ্গে করমর্দন হচ্ছে ইতিহাসের। আর তার কথন, সাক্ষ্য, গ্রহণ করছি আমরা। একশো বছর পরে, অতিমারির ক্ষত বুকে নিয়ে।
*চিত্রঋণ: The Print, nam.ac.uk, Gulf News
*তথ্যঋণ: টেল ইফ টু মুম্বই এপিডেমিকস: স্ট্রাইকিং প্যারালালস বিটুইন ১৮৯৬ বিউবনিক প্লেগ অ্যান্ড ২০২০ কোভিড আউটব্রেক: মার্ক ডাব্লিউ ফ্রেজিয়ার
মুম্বই অ্যান্ড এপিডেমিকস – দ্য বম্বে প্লেগ অফ ১৮৯৬ – আমোল আগরওয়াল
টেকিং আ পেজ আউট অফ ইন্ডিয়া’স মেডিকাল হিস্ট্রি অফ কারেজ, স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড সাফারিং – কাঞ্চা ইলাইহা শেপার্ড
প্লেগ ম্যানিফেস্টো – স্বামী বিবেকানন্দ
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।