আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭]
উল্কি
ভদ্রলোক হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন: “কী মনে হচ্ছে?”
১৯৮৫ সাল। কিছু উপরি আয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যারেজে হিসেবপত্র রাখার কাজ করি। মার্কিন দেশে সব কিছুই বড়সড়। একটা ছোট ইউনিভার্সিটিতে অবধি শ’তিনেক বিভিন্ন ধরনের গাড়ি। সেই সম্পর্কিত খরচাপাতির হিসেব রাখাই ছিল আমার কাজ। সেই সময়ে ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের বাইরে কাজ করার অনুমতি ছিল না। সেটা প্রাক-কম্পিউটার যুগ। আমার মতো দরিদ্র বিদেশি ছাত্ররা এই ধরনের কাজ করে কিছু বাড়তি ডলার কামাতাম।
ভদ্রলোকের নামটাম এতদিনে ভুলে গেছি। ঐ গ্যারেজেই কোনও কাজ করতেন। বছর পঞ্চাশের হাসিখুশি মানুষ। তাকিয়ে দেখলাম ওঁর হাত জুড়ে নানা দুর্বোধ্য ছবির উল্কি। কেমন যেন গা শিরশির করছিল দেখে। প্রশ্নটার কী উত্তর দেওয়া উচিত বুঝতে পারছিলাম না।
‘C’mon Sid, be honest!’ (নির্ভয়ে বলো সিড) ভদ্রলোক আবার উৎসুক ভাবে তাকালেন।
শেষে বললাম ‘It looks sort of nice!’ (মন্দ নয়)।
‘Well, well, aren’t you thinking “what an arsehole!” নিশ্চয়ই ভাবছ আমি এক গাধা) ‘আমার উত্তরকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ভদ্রলোকের মন্তব্য। স্বগতোক্তি বলাই বোধহয় ঠিক।
তারপর আমাকে সেই উল্কির ইতিহাস শোনালেন। পূর্ববর্তী নাবিক জীবনে দলে পড়ে এক চরম নির্বুদ্ধিতার মুহূর্তের বিজ্ঞাপন সারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। উল্কি কাটানোটা বেদনাময় হলেও সহজ, তোলাটা প্রায় অসম্ভব।

উল্কি সম্পর্কিত প্রচুর চালু রসিকতা আছে। স্কুলের উঁচু ক্লাসে এক অতি অসভ্য সিন্ধি ছেলের কাছে লাস্ট বেঞ্চে বসে শোনা আদিরসাত্মক গল্পটি ভুলিনি এখনও। এক নববিবাহিত পুরুষ ফুলশয্যার রাতে আবিষ্কার করলেন স্ত্রীর দুই স্তনে দুই ভিন্ন পুরুষের উল্কি করা ছবি। ধরা পড়ে গিয়ে স্ত্রী কাঁদকাঁদ। অল্পক্ষণের নীরবতার পর স্বামী হো হো করে হেসে বললেন “আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে এদের মুখ কীরকম লম্বাটে হয়ে যাবে (what long faces they will have!) কল্পনা করে ভীষণ হাসি পাচ্ছে।
লঘু ব্যাপার দিয়ে শুরু করলাম। কিন্তু সেদিন উল্কি সম্পর্কিত কিছু করুণ তথ্য জানলাম। অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের নিম্নশ্রেণীর মানুষের- বিশেষ করে পুরুষদের অনেকেরই নাকি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে উল্কি থাকত। ১৭৮৮ থেকে ১৮৬৮ অবধি ছোট বড় নানা ধরনের অপরাধীদের ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড, আয়ারল্যাণ্ড থেকে নতুন উপনিবেশ অস্ট্রেলিয়াতে শাস্তিমূলক নির্বাসন দেওয়া হত। প্রায় দু’লক্ষ মানুষের বরাতে এই দুর্ভাগ্য ঘটেছিল। এঁদের প্রায় এক তৃতীয়াংশের শরীরে নাকি উল্কি ছিল- জাহাজে তোলার আগে নথিপত্রে শরীরের এই অবিচ্ছেদ্য আভরণগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থাকত। ততদিনে দাসপ্রথা ইংল্যাণ্ডে খাতায় কলমে বিলুপ্ত। এই কয়েদিরাই ছিলেন ভেসে এসে জুড়ে বসা এই নতুন উপনিবেশের অলিখিত দাসের দল। এঁদের চাবুক খাওয়া পরিশ্রমই আজকের ঝাঁ চকচকে দেশটির ভিত্তি।
নির্দিষ্ট দিনে অপরাধী সাব্যস্তদের চাবকানো হত। কারও পঁচিশ ঘা, কারও একশ, কারও আরও বেশি। অধিকাংশই শুরুতে কাতরভাবে ক্ষমাভিক্ষা করতেন, বেদনাতে আর্ত চিৎকার করতেন। কয়েক ঘা খাবার পর রক্তাক্ত দেহগুলি নিস্তেজ হয়ে পড়ত। অল্প কিছু মানুষ কিন্তু ছিলেন অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। এঁরা চাবুক খেয়ে টুঁ শব্দটি করতেন না। চাবুকধারী ক্ষিপ্ত হয়ে আরও জোরে মারত, শেষে এই রক্তাক্ত দেহ প্রতিবাদীদের জেদের কাছে হার মানত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দর্শক বাকি কয়েদিরা নীরবে এঁদের কুর্নিশ জানাতেন।
অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের নিম্নশ্রেণীর মানুষের – বিশেষ করে পুরুষদের – অনেকেরই নাকি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে উল্কি থাকত। ১৭৮৮ থেকে ১৮৬৮ অবধি ছোট বড় নানা ধরনের অপরাধীদের ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড, আয়ারল্যাণ্ড থেকে নতুন উপনিবেশ অস্ট্রেলিয়াতে শাস্তিমূলক নির্বাসন দেওয়া হত। প্রায় দু’লক্ষ মানুষের বরাতে এই দুর্ভাগ্য ঘটেছিল। এঁদের প্রায় এক তৃতীয়াংশের শরীরে নাকি উল্কি ছিল – জাহাজে তোলার আগে নথিপত্রে শরীরের এই অবিচ্ছেদ্য আভরণগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থাকত।
এই নিরন্তর চাবুক খাওয়া মানুষদের রোদে পোড়া তামাটে দেহগুলি হয়ে যেত কশাঘাতে ক্ষতবিক্ষত – অনেকের নাকি পিঠে কড়া পড়ে যেত, চাবুকে বিশেষ কোনও বেদনাবোধ হত না আর। শুধু রয়ে যেত উল্কিগুলি– ফেলে আসা দেশের কোনও মধুর স্মৃতি নিয়ে, বা চিরবিচ্ছিন্না প্রিয়ার নাম মনে করিয়ে দিয়ে। চেহারা পালটে পালানোর চেষ্টা করলেও সুবিধে হত না – এই উল্কিই তাদের চিরকালীন পরিচয়পত্র হয়ে দাঁড়াত।
***
সত্তরের দশকে ভারতীয় ক্রিকেটারদের একটা ফ্যাশন হয়েছিল – লম্বা জুলফি রাখা। হালের ফ্যাশন হল উল্কি। সেটা অবশ্য শুধু ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় – সমস্ত দেশের খেলোয়াড়দের গায়েই দেখি নানা ধরনের উল্কি।

এই উল্কি ব্যাপারটা আজকাল একটা শিল্পে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রঙে সুক্ষ্ম সব নকশা। শুধু হাতে নয় – পিঠে, পায়ে, গলায়, মায় মুখ অবধি।
পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করছেন, আমি উল্কিপ্রেমী নই। প্রকৃতিদত্ত সুন্দর মানবদেহে এই আঁকিবুকির মধ্যে আমি চেষ্টা করেও কোনও রকম সৌন্দর্য খুঁজে পাইনা। শুধু আজ নয়, কোনওদিনই পাইনি।
সত্তরের দশকের একটা হিন্দি ছবির কথা মনে পড়ছে – যতদূর মনে আছে নাম দিওয়ার। এক নিরপরাধ পিতাকে মিথ্যা অপবাদে চোর সাব্যস্ত করা হয়েছে। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া জনতা মানুষটির শিশুপুত্রের হাতে উল্কি কেটে দিল “মেরা বাপ চোর হ্যায়!” সেই শিশু বড় হয়ে অমিতাভ বচ্চন রূপে পিতৃ-অপমানের যথাযোগ্য বদলা নিল। ছবিটা জমাটি ছিল।
এই প্রসঙ্গে মনে হল – দেশের অসৎ ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ- সরকারী আমলাদের উপরোক্ত বলিউডি শাস্তি দিলে কেমন হয়? কপালে বড় বড় করে চিরস্হায়ী লেখা – ” ম্যায় চোর হুঁ!”
ছবি সৌজন্য: Rawpixel
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।