বিষাদ। তবু ছায়া ঘন হয়ে আসে। সন্ধের ছায়ার রং কী? মুলতানি কি সইবে? এমন সঘন শরীর থেকে পোকা উড়ছে। মুখে শ্বেতচন্দন স্পষ্ট। চোখের পাতায় তুলসী আর বুকের ওপর রাখা গোলাপ তোমায় জামাই সাজ সাজিয়েছে। জীবৎকালে যাকে ঠিক চেনা যায় না, মরে গেলে বুঝি সে রূপের বাহার। চুপি চুপি মরে গিয়ে হাজার প্রশ্ন জড়ো করেছিল সিনেমার পরিমল। নগরকীর্তনের কোরাস বুকে এসে ধাক্কা খেতে খেতে নীলাভ গৌড়ের পুরুষালি পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল নূপুর। এমন হাজার পরিমলের রং কি তবে শ্যামবর্ণা নীল? গাঢ় নীল যে তবে স্থিতিশীলতা এবং নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক! প্রশান্তি আছে, কোমলতা আছে। রং তাহলে সবসময় সুখকর নয়। রং মেরেও ফেলে। নগরকীর্তনে দেখানো হয়েছিল পুরুষ শরীরের খাঁচায় বন্দি নারীর মন। পরিমলের অন্য নারী শরীর দেখার মধ্যে কী অপার বিস্ময়। চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। তার প্যাডেড ব্রা পরা কৃত্রিম শরীর যেন ওই অকৃত্রিম নারী শরীরের পিয়াসী। রাধিকা অঙ্গে তবেই তো সঙ্গীকে তৃপ্ত করবে সে!(Homosexuality)
অনুশাসনপর্বে ভঙ্গাস্বন নামে এক রাজার কথা ছিল মনে আছে? যিনি স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের অভিশাপের গেঁড়োয় মেয়ে হয়ে গিয়েছিলেন। পরে ইন্দ্র বর দিতে এলে তিনি মেয়ে হয়েই থেকে যেতে চান।
নারীসুলভ পুরুষ বা নারী হতে চাওয়া মহাভারতীয় চেতনা। অনুশাসনপর্বে ভঙ্গাস্বন নামে এক রাজার কথা ছিল মনে আছে? যিনি স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের অভিশাপের গেঁড়োয় মেয়ে হয়ে গিয়েছিলেন। পরে ইন্দ্র বর দিতে এলে তিনি মেয়ে হয়েই থেকে যেতে চান। আবার ‘পদ্মপুরাণ’-এ পাই অর্জুন ও কৃষ্ণের গোপন প্রেমের পৃথিবী। অর্জুন তখন শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা দেখবেন বলে নাছোড়বান্দা। দেবী ত্রিপুরসুন্দরী তাঁকে এক জলাশয়ে পাঠালেন। সেখানে স্নান সেরে অর্জুন আভরণে বিভূষিতা সুন্দরী এক নারীতে পর্যবসিত হয়ে আগের কথা প্রায় ভুলেই গেলেন। তারপর বনমধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে দেখে নারীরূপী অর্জুনের সে কী প্রেম! পরে আবার পুরুষ রূপ ফিরে পেয়ে আর্জুনি হয়ে উঠলেন অর্জুন। কৃষ্ণ বললেন, ‘‘অর্জুন, এই ত্রিভুবনে তোমার মতো প্রিয় সখা আমার আর নেই। তাই তুমি আমার গোপন রাসলীলা দেখতে পেলে।’’ আরেকটি প্রেমের গল্প নয়, বরং প্রেমের আরেকটি গল্প।(Homosexuality)
যে গান লেখা হয়নি কখনও: সুমন সাধু
সেই গল্পে রুদ্র হয়ে ওঠে চিত্রাঙ্গদা। মহাভারতের। রবীন্দ্রনাথের। প্রেমের নতুন রং। ইচ্ছের নতুন রং। চিত্রাঙ্গদা ছবির সংলাপ মনে পড়ে-
-অসমাপ্ত দালানকেও কেন দালানই বলা হয়?
-কারণ, পৃথিবীতে কোনওকিছুই সম্পূর্ণ নয়। সবটাই প্রক্রিয়াধীন।
যৌন পরিচয়ের বাইরের যে মানুষ, তাকে কেন খুঁজে দেখা হয় না? এ পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কই আসলে তকমাকেন্দ্রিক।
আমি আপনি এই প্রক্রিয়ার অংশ। আমরা সাজি। সাজতেই থাকি। সম্পূর্ণ হয় না। সেই অসম্পূর্ণ ইচ্ছের রং কী দেব? সাদা। অপারেশন থিয়েটারে সাদা আলোর বিচ্ছুরণ। ভালবাসার মানুষটাকে নারী হয়ে পেতে চায় সে। শরীরের যাবতীয় খোলস ছেড়ে মিশে যেতে চায় আরেক শরীরের দিকে। এক জীবনে কত বাঁক, কত দেখা, কত পরিচিতি, কত লোক হাসানো, কত রঙ্গতামাশা, কত যৌন চাহিদা, কত প্রেম আর কতই বা চাওয়া-পাওয়ার হাতছানি। তার কতটুকু জানা হয় আমাদের! ‘প্রেম’- যে শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রহস্যের অনন্ত ঘেরাটোপ। এই পৃথিবীতে পোড়ারাই একমাত্র পোড়াদের পুড়িয়ে ফেলতে পারে। তাদের কী পরিচয়? স্ট্রেট, গে, বাই, লেসবিয়ান, ট্রান্স? যৌন পরিচয়ের বাইরের যে মানুষ, তাকে কেন খুঁজে দেখা হয় না? এ পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কই আসলে তকমাকেন্দ্রিক। সে তুচ্ছ বা অতিতুচ্ছ হলেও তকমার আওতায় আসতে ভালোবাসে। তকমার বাইরে যে বহির্জগৎ, যে আলোকময় পৃথিবী, তা যেন নিষেধের বেড়াজাল। সমকামিতায় কে নারী আর কে পুরুষ তা অবধারিত বা জরুরি কোনওটাই নয়। বিষমকামী নারীর মধ্যে যেমন থাকতে পারে সুপ্ত পুরুষত্ব, তেমন বিষমকামী পুরুষও ধারণ করতে পারেন নারীর কোমলতা। এখান থেকেই তৈরি হয় জেন্ডার ফ্লুইডিটি।(Homosexuality)
বিষমকামীরা তো প্রকাশ্যে কখনও ঘোষণা করেন না যে তিনি যৌন পরিচয়ে একজন বিষমকামী; তাহলে সমকামী মানুষদের কেন জনসমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে তাঁর যৌন পরিচয়!
সিনেমায় জেন্ডার ফ্লুইডিটি নতুন ভাবে চিনিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ওঁর অভিনীত ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ দেখলে আরও গভীরভাবে বোঝা যায়। কিন্তু যে পরিমাণে সমপ্রেমী মানুষদের কথা মূলস্রোতে আসা উচিত ছিল, ততটা আর হল কই! সে সিনেমা হোক বা থিয়েটার, সাহিত্য হোক বা চিত্রকলা। এখনও খানিক ব্রাত্যই থেকে গেছে রামধনু মানুষদের মহামিছিল। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি জরুরি কথা বলে নেওয়া যাক- বিষমকামীরা তো প্রকাশ্যে কখনও ঘোষণা করেন না যে তিনি যৌন পরিচয়ে একজন বিষমকামী; তাহলে সমকামী মানুষদের কেন জনসমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে তাঁর যৌন পরিচয়! বলতে হয়। কারণ, রাষ্ট্রব্যবস্থার মন এখনও স্বাভাবিক/অস্বাভাবিকে দ্বিধাবিভক্ত। এলজিবিটিকিউ+ মানেই যেন সেনসেটিভ ইস্যু। কেন? এই সেনসেশন কারা আনল? কীভাবে আনল? যৌন পরিচয় যদি নর্মালই হয়, তাহলে কীসের এত কথা কাটাকাটি, মারামারি, কাদা ছোড়াছুড়ি!(Homosexuality)
আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়েছে মানুষ। উন্মুক্ত হয়েছে ব্যক্তি প্রেম, সম্পর্কের বাঁধন। স্বাধীনতা পেয়েছে মেয়েরা। কিন্তু আজও কিছু ফোবিয়া সমাজের মূলে রয়ে যায় অজান্তেই। এই অজানাকে খোঁজার দায়িত্ব কার? আমার আপনার সবার।
আরও একটি প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়। এক বাঙালি কুইয়্যার কবির একটি কবিতা (যদিও কবিতায় শ্রেণি বিভাজন বিশ্বাস করি না, তাও আলোচনার সুবিধার্থে ধরা যাক প্রেমের কবিতা) নিয়ে এক সমালোচক আলোচনা করতে গিয়ে বারবার নারী-পুরুষের সম্পর্কের কথাই আনছেন। মেনে নিলাম, কবিতা পড়ে বোঝার উপায় নেই সেটি কুইয়্যার কবিতা কিংবা কবির সঙ্গেও ব্যক্তিস্তরে আলাপ নেই আলোচকের, কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয় এখানেই যে, আজও অধিকাংশ মানুষ প্রেম বলতে বোঝেন নারী-পুরুষ, তার বাইরে যে বৃহত্তর পৃথিবী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিকে ইচ্ছাপূর্বক নজর দিতে চান না। অসুবিধাটা কীসের? নাকি ভয়? পরিবারের, কাছের মানুষের, সমাজের নাকি নিজের উপরেই ভয়? উনিশ শতকীয় খোলস ছেড়ে এই মানুষই বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়েছে মানুষ। উন্মুক্ত হয়েছে ব্যক্তি প্রেম, সম্পর্কের বাঁধন। স্বাধীনতা পেয়েছে মেয়েরা। কিন্তু আজও কিছু ফোবিয়া সমাজের মূলে রয়ে যায় অজান্তেই। এই অজানাকে খোঁজার দায়িত্ব কার? আমার আপনার সবার।(Homosexuality)
‘অভিজ্ঞান’-এ এক বিবাহিতা মহিলা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিলেন কমবয়সী এক শয্যাসঙ্গিনীকে। অন্যদিকে ‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসে সঞ্জয় আর রবি– সমপ্রেমী দুই পুরুষের কথা পাই।
সমকামিতা নিয়ে অহেতুক আতঙ্কের কোনও শেষ নেই এই হোমোফোবিক দেশে। ‘ফায়ার’, ‘মাই ব্রাদার নিখিল’, ‘আই অ্যাম’, ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘কোবাল্ট ব্লু’, ‘নগরকীর্তন’ ইত্যাদি ছাড়া বেশিরভাগ পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিতেই সমকামিতা মানে এক ধরনের ক্যারিকেচার। ‘দোস্তানা’ ছবিতে যেমন অভিষেক বচ্চন আর জন আব্রাহাম নিজেদের সমকামী ঘোষণা করে ঘর ভাড়া নেবেন, লোকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে। প্রাদেশিক সাহিত্য, নাটক অবশ্য সেই বলিউডি চ্যাংড়ামির বাইরে গত কয়েক বছর ধরে অন্য ভাবে ভাবছিল। বাংলা ভাষায় নবনীতা দেবসেনের ‘বামাবোধিনী’ এবং ‘অভিজ্ঞান’ নামে দুটি উপন্যাস রয়েছে। লোকে এখনও পড়ে। কী ছিল সেই দুটি উপন্যাসে? দুটিতেই লেসবিয়ান এবং বাইসেক্সুয়াল চরিত্র আছে। ‘অভিজ্ঞান’-এ এক বিবাহিতা মহিলা হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিলেন কমবয়সী এক শয্যাসঙ্গিনীকে। অন্যদিকে ‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসে সঞ্জয় আর রবি– সমপ্রেমী দুই পুরুষের কথা পাই। বিবাহিত পুরুষ সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বিদেশে তাঁর পুরুষসঙ্গীর কাছে। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক ধরনের মানসিক সম্পর্ক। পরস্পর সহবাস করে সুখভোগ করে। এইভাবে অসমবয়সী বন্ধুত্ব এবং সমপ্রেমকে অত্যন্ত সহজভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নবনীতা।(Homosexuality)
ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদাতে স্বয়ং ঋতুপর্ণ ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁটাচামচে খাবার খেতে খেতে বাবা-মা-কে বলছেন লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা। সমপ্রেমীদের যে আন্দোলন শুধু শহুরেপনার মধ্যেই আটকে গেল, গ্রাম-তস্য গ্রামের সীমানা ছুঁতে পারল না, সেখানে কাঁটাচামচ যেন রূপক।
যদিও ভারতীয় প্রেক্ষাপটে তথাকথিত ‘এলিট ভদ্রলোক’ জাতীয় জিনিস হয়তো ‘খায়’ বেশি। অনেকটা রূপকথার মতো। প্রশ্ন আসে বৈকি, যখন দেখি, ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদাতে স্বয়ং ঋতুপর্ণ ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁটাচামচে খাবার খেতে খেতে বাবা-মা-কে বলছেন লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা। সমপ্রেমীদের যে আন্দোলন শুধু শহুরেপনার মধ্যেই আটকে গেল, গ্রাম-তস্য গ্রামের সীমানা ছুঁতে পারল না, সেখানে কাঁটাচামচ যেন রূপক। বুকে কোপ বসায়।(Homosexuality)
নিরাশার গল্প বলব না। সাতরঙের মানুষ শুধু আশাহীনতায় বাঁচে না, সন্তুষ্টিতেও বাঁচে। ঘৃণায় বাঁচে না, বাঁচে ভালবাসায়। লেখার একদম শুরুতে একটা মৃত্যুর কথা বলেছিলাম। সে মৃত্যুকে লেখার শেষে চলুন বাঁচিয়ে তুলি। দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম গড়িয়াহাট ক্রসিংয়ে দুই তরুণ, সন্ধের ক্লান্ত শরীরে ফুটপাথের এক কোণায় চুমু খেতে খেতে বলেছিল, ‘ভালোবাসি’। ওদের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল সন্ধের শেষ ট্রাম। চারপাশের ভিড় যে যার মতো, ওদের দিকে কেউ তাকাচ্ছিল না। কী অপলক ওরা! চোখ আটকে গেছে একে অপরের শরীরে। হিন্দুস্তান পার্ক, দেশপ্রিয় পার্ক, ট্রাঙ্গুলার পার্কের সমস্ত রং লেগেছিল ওদের প্রতিটি অভিব্যক্তিতে। ওরা সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল ভিড় ঠাসা শহরের হাইরাইজের আলোয়। ওরা ভালো থাক। সব গল্পের শেষে কান্না থাকে না, মুখে চাপা হাসিও থাকে। এ-হাসিগুলোর মেজাজ বাড়ুক। নগর উথালপাতাল হোক।(Homosexuality)
একজন কবি, গদ্যকার এবং সাংবাদিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘গওহর জান’, ‘উড়তে চললাম কমরেড’, ‘ঘুম হও অজস্র অপরাজিতা’, ‘বিলম্বিত দুপুর’, ‘ও ডার্লিং তুমি শুধু দৃশ্যমান হাওয়া’। একটি দৈনিক অনলাইন মিডিয়ার সহযোগী সম্পাদক ও বিষয়বস্তু প্রধান।
One Response
অপূর্ব লেখা। তেমনই বহতা গদ্যভাষা।