রোদ্দুরে জ্বলে যাচ্ছে একটা মাঠ। মাঠের ঘাস হলদে হয়ে গেছে রোদে পুড়ে। মাঠের মাঝে মাঝে খেজুর বা তালগাছ কোথাও কোথাও। সেই তাল-তমালের পিছনে খানিক দূরে গরম হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে খান কয়েক রুক্ষ পলাশ গাছ। বসন্ত বহু দূরে, সুতরাং ফুল নেই। অগত্যা বলে না দিলে, পলাশ গাছ বলে চেনা শহুরে চোখের পক্ষে মুশকিল। সেই পলাশের সঙ্গে শাল কোথাও কোথাও। সোনাঝুরিও। মাঠের পাশে আলের ধারে একা অশ্বত্থ। ডালপালা ছড়িয়ে ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে এই তীব্র দাবদাহের বেলাতেও। তার তলায় এই আকাশ ফাটা রোদে ছড়িয়ে গেছে ছায়ার প্রলেপ। সেখানে খালি গায়ে বসে একটা কালো শরীরের ছেলে… না, বাঁশি বাজাচ্ছে না। বরং ফোন (Mobile Phone) ঘাঁটছে গাছে হেলান দিয়ে। এবং দূর থেকে শহুরে চোখ দেখতে থাকে, উন্নয়ন তার সর্বস্ব নিয়ে হইহই করে ঢুকে পড়ছে প্রান্তিক মানভূমেরও কোণায় কোণায়।
এই ঠাঠা পোড়া দুপুরে বাইরেই বা কেন আদুল গায়ের ছেলে? পুরুলিয়ায় অবশ্য তাপের দোহাই দিয়ে ঘরে বসে থাকার উপায়টাই বা কোথায়? গাছের ছায়া থেকে একটু দূরত্বে, শুকনো ঘাসের বুকেই চড়ে বেড়াচ্ছে তার বাইরে বেরনোর উপলক্ষেরা। তাদের রুগ্ন চারপেয়ে সাদা-কালো-ঘিয়ে-খয়েরি শরীরের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকে শুধু গলার টুংটুং ঘন্টিটা।
মোবাইল ঘাঁটতে থাকা ছেলের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসে এতক্ষণ ধরে মাঠে কাজ করে চলা কয়েকটা শরীর। এই গরমে খোলা মাঠের রোদ্দুরে সানস্ট্রোক হওয়া আশ্চর্য নয়। অথচ এদের হবে না কিছু। কিছু হয় না এদের। সকালেই তাল বা খেজুরের তাড়ি খেয়ে মাঠে নেমে গেলে রোদের সাধ্যি নেই নাকাল করে আর! আর এদের হাঁটা-চলাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে মুখ লুকিয়ে কোথাও নাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে পাখি। ট্টি ট্টি ট্টি। হেঁটে চলা শরীরগুলোর মধ্যে কমবয়েসী মেয়ে একজন। মাথায় গামছা দিয়ে ঢাকা মুখ। হাতে ধরা একটা মোবাইলে লাগাতার কথা বলে চলছে সে কলেজের ফর্ম তোলার শেষ দিন জানতে চেয়ে।

সময়টা ২০১৩ সালের এদিক-ওদিক। এইসব দৃশ্যের থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে, ঘটমান এই বর্তমান লাগাতার দেখে চলেছে তখন আচমকাই একটা অন্য পরিবেশে গিয়ে পড়া দুটো চোখ। কোথায় শহুরে মফস্সল, কোথায় পুরুলিয়া শহর থেকেও ষাট কিলোমিটার ভিতরের গ্রাম! দূরত্ব বজায় রাখতে হয়, কারণ দূর থেকে দেখা এই আশ্চর্য বাঙ্ময়তা ভেঙে দিতে ইচ্ছা করে না কিছুতেই। কিছু দূরত্ব মানতে শেখা জরুরিও, শিখিয়ে যায় একলা থাকার সময়। কোথা থেকে বাচ্চা একটা ছেলে ওই রোদের মধ্যে দিয়েই ছুটে এসে আলের পাশ দিয়ে নেমে গিয়ে হারিয়ে যায় জল শুকিয়ে আসা একটা পুকুরের ওই পাড়ে। সেখানে খড়ে বাঁধা নিচু চালের কুঁড়ে একটা।
অবশ্য গ্রাম বাংলা মানেই ‘ছায়া সুনিবীড় শান্তির নীড়’, সেই ভাবনা নেহাতই গ্রাম বাংলা নিয়ে সম্যক ধারণা না থাকারই পরিচয় দেয়। যাবতীয় জটিলতা বা কুটিলতা রোদ বা ছায়াদের পাশে পাশে সারা পৃথিবীর মতোই উপস্থিত সেখানেও। অতএব আধুনিক সভ্যতার বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি যে মোবাইল ফোন বা দূরাভাষ যন্ত্র এবং তার ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধিই যে পুরুলিয়ার মতো একটা গ্রাম ভিত্তিক জেলার মানুষের সারল্যের ছবি বদলে দেবে, সেটা অতিসরলীকরণ বলাই যায়। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর আগে যখন কেরোসিনের বাতি ছিল শেষ ভরসা, এই সময়ে দাঁড়িয়েও সেই ছবিটাই থাকবে— এ ভাবনাও কষ্ট কল্পনা। যতই তা গ্রামের চেনা হলদে টিমটিমে আলোর ছবি বদলে দিয়ে যাক না কেন।
তবে দৃশ্য বদলেছে। ভীষণ ভাবেই বদলেছে। মোবাইল এসে পড়ে একমূহুর্তে দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে অনেকটা, শহরের একটা ছেলের সঙ্গে গ্রামের ছেলেটার। পুরুলিয়ার সৌরভের কবিতা পড়ে ফেসবুকে ভালো লাগা জানিয়ে যাচ্ছে যাদবপুরের অরিত্র। আর একটা সম্ভাবনার ক্ষেত্র যেমন খুলে যাচ্ছে, তার ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে পুরুলিয়ার মতো জায়গাতেও একটা ধাঁধার সামনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে মানুষগুলোকে। আড্ডার বদলে সময়গুলো গিলে নিচ্ছে এখন পাশাপাশি বসে পাবজি খেলে যাওয়া কিশোর বা তরুণদের দল। মধ্যবয়স্ক মানুষদের চায়ের দোকানের আড্ডা ঘুরপাক খাচ্ছে মোবাইলের রিলের আশেপাশে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই এসে পড়ছে ভয়ঙ্কর একটা প্রবণতা। প্রবল ঘৃণা বা বিদ্বেষ ভরা মেসেজ বহু বহুবার ফরোয়ার্ড হয়ে এসে পড়ছে তাঁদের মোবাইলে। আজ থেকে মোটামুটি দশ বছর আগে দাঁড়িয়েও বোঝা যায়নি ঠিক কতটা প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়াবে এই প্রবণতা। দেশ বা রাষ্ট্রের জনমত গড়ে তুলতে বা প্রভাবিত করতে এর কোনও ভূমিকা থাকবে কী না।

সেই সঙ্গে এটাও তো অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, মোবাইল ফোন না থাকলে কী করে পাবে প্রান্তিক মানুষেরা এখনকার দিনে সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো? ২০১৪ সালে দেশের সরকার বদলের পর জনধন অ্যাকাউন্ট তৈরি বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক ভাতার প্রকল্প পাওয়ার জন্য আবশ্যিক হয়ে যায় মোবাইল ফোন। আচমকাই অনেকটা সস্তা হয়ে যেতে শুরু করে মোবাইলের ডেটা প্ল্যান। স্কুল-কলেজের নোটসও ঢুকে আসতে শুরু করে মোবাইলে। এবং তারপর কোভিড এসে পুরোপুরিই বদলে দিয়ে যায় দৃশ্যপট।
পুরুলিয়া জেলায় পারিবারিক স্বাস্থ্যসেবা নির্ধারক সংক্রান্ত একটা গবেষণা বলছে, ২০২২ সালে পুরুলিয়ায় পরিবারগত ভাবে সবথেকে সাধারণ সম্পদ হল মোবাইল ফোন। শতাংশের হিসাবে ১০০টি পরিবারের মধ্যে ৯২টি পরিবারেই অন্তত একটা মোবাইল ফোনের দেখা পাওয়া যাবেই। তথ্যের খাতিরে বলে রাখা যায়, মোবাইলের পরেই পরিবারের কাছে সাধারণ সম্পদের হিসাবে আছে সাইকেল। ১০০টি পরিবারের মধ্যে ৮৪টি পরিবারের কাছে দেখা মেলে সাইকেলের। এবার যদি বিনোদনের অন্যান্য উপায়ের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে পুরুলিয়ায় মাত্র ৫৪ শতাংশ পরিবারের কাছে টেলিভিশন আছে। অর্থাৎ, মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই যোগাযোগ ছাড়াও বিনোদনের অন্যান্য উপাদান খুঁজে নিচ্ছেন মানুষ। এবং এখান থেকেই সেই আশঙ্কাটা ফিরে ফিরে আসতে থাকে আবার। দলগতভাবে মিলেমিশে একজায়গায় বসে থাকার সেই দিনগুলো কেড়ে নিল কি এবার তাই একলা একলা মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকা?
এবং এক লাইনেই দেওয়া যায় উত্তরটা। হ্যাঁ, কেড়ে নিল! এই জায়গায় একটা শহর বা মফস্বলের সঙ্গে আর কোনও পার্থক্য রইল না গ্রামীন জনপদগুলোরও। লক্ষ-কোটি ‘কনটেন্ট’ তাদের ‘টার্গেট অডিয়েন্স’-দের মধ্যে কোনও শহর-গ্রাম বাছ-বিচার করে না। তবুও, এই পরিবর্তন হওয়ারই ছিল, আর সেটা থেকে দূরে সরে থাকারও কোনও অর্থ দাঁড়ায় না; আজকের দিনে অন্তত। সরল থাকার দায় তো গ্রাম একা নিয়ে বসে থাকেনি! বরং আলোর দিকে তাকানো যাক।

যেই জায়গাগুলোতে আগে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়াও দুষ্কর ছিল, সেখানে এখন প্রান্তিকতম জায়গাতেও নেটওয়ার্কের কোনও অসুবিধা নেই। ফলে মোবাইল ডেটার সাহায্যে গ্রামের কোনও ছেলে হয়তো এখন তার মোবাইলে ভিডিও বানিয়ে বাকি দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে পারছে তার গ্রামের সৌন্দর্য। শহরের থেকে পাঁচজনের একটা দল সেই জায়গা দেখতে আসতে চাইলে, সে হয়ে যাচ্ছে তাদের ট্যুর ম্যানেজার। এবং এভাবেই বিকল্প অর্থনীতির একটা জায়গা যে তৈরি হচ্ছে, তা তো অস্বীকার করে দূরে সরিয়ে রাখা অসম্ভব। কিংবা, গ্রামের কেউ হাসপাতালে ভর্তি, শহরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রোগীকে। গ্রামের ছেলে বা মেয়েটার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টটা দেখেই শহরের তার ভার্চুয়াল বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়ল রক্ত জোগাড়ের কাজে। অনলাইন ক্লাসে চিত্রনাট্য লেখার ওয়ার্কশপ করে সেই গ্রামে বসেই মোবাইলে দুরন্ত একটা ছবি বানিয়ে ফেলল কেউ।
দেয়ালগুলো ভাঙতে পারে এভাবেই। দেয়ালগুলো ভাঙুক, এভাবেই! এই টুকরো টুকরো আলোগুলো এই তুমুল পরিবর্তনের পাথেয় হয়ে থাক আমাদের।

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
শুভদীপের জন্ম মফস্বল শহর বাটানগরে, ইডেন গার্ডেনসে সে বছর বিশ্বকাপ ফাইনালে ভুল রিভার্স সুইপ মারছেন মাইক গ্যাটিং। পড়াশোনা নঙ্গী হাই স্কুল, এবং পরবর্তীতে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। অর্থনীতি এবং সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার পর চাকরিসূত্রে পুরুলিয়া থেকেছেন বেশ কিছু বছর।