শীতের আগমনে সবাই আহ্লাদে আটখানা। বাজারে নানান রকমের সবজির রমরমা। অন্যদিকে বাগানিয়ারাও হরষিত এবং কিছুটা দ্বিধান্বিত। মরসুমি ফুলের অগুনতি সম্ভার থেকে বাছাই করা কষ্টকর। তবে যতই কষ্টকর হোক, ডালিয়া তার নিজস্ব আকার আর উজ্জ্বল রঙের খাতিরে বাছাই তালিকার ওপরের দিকে থাকবেই।
আমার বন্ধু কাঞ্চন, প্রতি বছর শীতে টবে কিছু মরসুমি ফুল ফোটায় ওর জানালার ধাপিতে। বেশ ভালোবেসে ফেলেছে গাছ পরিচর্যাকে। এবারে অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের কাছ থেকে অনুমোদন আদায় করেছে ছাদে গাছ করার। ও ঠিকই করেছে কাউকে কোনও প্রশ্ন করার বা আপত্তি জানানোর সুযোগ দেবে না, তাই ইটের ওপর কাঠের তক্তা পেতে তার ওপর টব রাখবে যাতে ছাদে ড্যাম্প না লাগে। ছাদে জায়গা পেয়ে যাওয়ায় এবারে ঠিক করেছে ডালিয়া করবে। আমাকে তলব করেছে ডালিয়া চাষের ব্যাপারে সহায়তা করার জন্যে। আমি তো এক পায়ে খাড়া, এই সুযোগে মাসিমার হাতের রান্না খাওয়া যাবে। এক রবিবার কাঞ্চনদের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ইলিশের সুবাসে মনটা ভরে হয়ে গেল।

— “তুমি আসবে বলে কাঞ্চন বড় ইলিশ এনেছে। আগে ইলিশ ভাজা খাও, তারপর তোমরা …” মাসিমার কথা অমান্য করা পাপ, অগত্যা…
ছাদে উঠে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। চারদিক খোলা। দিকনির্ণয় করার পর ডালিয়ার বসবাসের স্থান নির্ধারণ করা হল। ডালিয়া রৌদ্র-বিলাসী।
— “বাবুদা, এবার বল, বিশাল বড় বড় ডালিয়া কী করে করব?”
— “কাঞ্চন, তোমায় বুঝতে হবে যে ডালিয়া কত বড় হবে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করবে তুমি কোন প্রজাতির ডালিয়া লাগাবে, তার ওপর। বড় ফুল পেতে চাইলে, তোমাকে বড় প্রজাতির ফুলের গাছ লাগাতে হবে।“
— “তার মানে ছোট সাইজের ডালিয়াও হয়?”
— “অবশ্যই হয়, তবে ডালিয়ার সৌন্দর্য তার রঙে, পাপড়ি বিন্যাসে, তার মাধুর্যে, তার তরতাজা ভাবে, শুধুমাত্র আকারে নয়। তুমিই বিচার কর, কে বেশি সুন্দর, ছোট লাল মুনিয়া না বিশালাকার শকুন? অবশ্য এটাও ঠিক যে বড় আকারের ম্যাকাও অথবা ময়ূরও সুন্দর।“
এমন সময় রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল পুচু, কাঞ্চনের কন্যা।

— “জেঠু, শুনেছি যে ‘ডাল’ নামের একজন ডালিয়া গাছ আবিষ্কার করেন মেক্সিকোর জঙ্গল থেকে। সেটা তখন একটা লতানো গাছ ছিল আর ফুলের পাপড়ি ছিল মোটে পাঁচটা।
— “তুই আদ্ধেকটা মনে রেখেছিস। প্রোফেসর ক্যাবানিয়াস বলে স্পেন দেশের এক উদ্ভিদবিদ প্রথমে এটা আবিষ্কার করেন। সুইডেনের উদ্ভিদবিদ ‘ডাল’-কে সম্মান জানাবার জন্যে গাছটার নামকরণ করেন ‘ডালিয়া’। গাছটা মেক্সিকোর বাইরে যায় ১৭৮৯ সালে, যে সালে ফরাসী বিপ্লব হয়। পরবর্তীকালে সংকরায়নের ফলে আমরা আজকের বাগানের ডালিয়া পাই যা প্রকৃতিতে, আকৃতিতে আর রঙের জৌলুসে সবার মন মাতিয়ে রাখে।“
— “জেঠু, আকৃতি প্রকৃতি বলতে কি বোঝাতে চাইছ?”
— “এখন আমাদের হাতে এত বিভিন্ন ধরনের ডালিয়া আছে যে তাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করার দরকার হলো। যেমন ধর, চাল। সবই চাল, তবুও আমরা বলি আতপ চাল, সেদ্ধ চাল। তারপরেও ভাগ – বাঁশকাঠি, মিনি কিট, বাসমতী, এই আর কি। প্রকারের ওপর নির্ভর করে ডালিয়াকেও ভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন গোত্রের– ডেকোরেটিভ, ক্যাকটাস, সেমি-ক্যাকটাস, ফিম্ব্রিয়েটেড, পমপন, ওয়াটার লিলি, অ্যানিমোন, কোলারেটে, বল, এবং মিসলেনিয়াস। যে ধরনের ডালিয়া আমরা সবচেয়ে বেশি দেখি পুষ্প প্রদর্শনীতে তা হলো ডেকোরেটিভ। এখানে পাপড়িগুলো ঠাস বুনোটের, সুন্দরভাবে একের পর এক সাজানো থাকে। ক্যাকটাস শ্রেণীর পাপড়ি পাশাপাশি মুড়ে, পাকিয়ে কাঠির মতো দেখাবে। সেমিক্যাকটাসের পাপড়ি ক্যাকটাসের মতোই, তবে পুরো পাপড়ি পাকানো হবে না, ডগা থেকে আদ্ধেক অংশ পাকানো থাকবে। ফিম্ব্রিয়েটেড শ্রেণীর পাপড়ির ডগা চেরা চেরা হবে। পমপন শ্রেণীর ডালিয়া দেখতে একেবারে টেনিস বলের মতো, আকারেও ছোট।
— “তার মানে ছোট ডালিয়াগুলোকেই পমপন বলে?”

— “তা নয়। অন্যান্য শ্রেণীর ডালিয়াও ছোট হতে পারে। ফুলের ব্যাসের ওপর নির্ভর করে ডালিয়াকে কোন সাইজের শাখাতে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন জায়ান্ট (১০ ইঞ্চির বেশী), লার্জ (৮- ১০ ইঞ্চি), মিডিয়াম (৬- ৮ ইঞ্চি), স্মল (৪-৬ ইঞ্চি), মিনিয়েচার (৪ ইঞ্চির কম)। অর্থাৎ ডেকোরেটিভ ডালিয়া ১২ ইঞ্চি ব্যাসের হতে পারে আবার ৪ ইঞ্চি ব্যাসেরও হতে পারে। এ ছাড়াও রঙের বিন্যাসের ওপর নির্ভর করেও শাখা ভাগ আছে। মনোক্রোম (একরঙা), বাই-কালার (পাপড়িতে দুটো রঙ এবং তা নির্দিষ্টভাবে বিভক্ত একটা বিভাজন রেখায়), ব্লেন্ড (একটা রঙ অন্য আর একটা রঙের সাথে ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে), ভেরিগেটেড (একরঙা পাপড়ির ওপর অন্য রঙের ছিট ছিট)।“
কাঞ্চন আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বলে উঠলো,
— “এ্যাই পুচু, থামাতো তোর পড়াশোনার কচকচানি। কী করে গাছ করব সেই আলোচনাটাই শুরু হোক এখন।“
আরও পড়ুন: জীবন থেকে জীবনে পর্ব ২৩
— “সেটাই হোক, তবে এগুলোও জানা অবশ্য জরুরি। যেমন বড় জাতের ফুলের ক্ষেত্রে তুমি একটাই ফুল ফোটানোর চেষ্টা করবে যাতে সে বেশি খাবার পেয়ে বড় হওয়ার উপযুক্ত পুষ্টি পায়। আবার ছোট শ্রেণীর গাছের ক্ষেত্রে গাছভর্তি ফুল থাকলে তার বাহার আলাদা, দেখতেও ভালো লাগে।“
— “ডালিয়ার মাটি কী ভাবে তৈরি করব?
— “ডালিয়ার সারমাটি তৈরি করতে হবে কমপক্ষে গাছ লাগাবার তিন মাস আগে থেকে। দেখ, যে কোনও ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। যেভাবে আমি করি সেটাই বলছি। দোআঁশলা মাটি (৩ ভাগ), পুরনো গোবর সার (২ ভাগ), পাতা সার (১ ভাগ)। এখন গোবর সার ইত্যাদি পেতে অসুবিধে, তাই এর পরিবর্তে ব্যবহার করা যায় দোআঁশলা মাটি (২ ভাগ), ভার্মি কম্পোস্ট (১ ভাগ), কোকোপিট (১ ভাগ)। মাপ ঠিক রাখার জন্যে লিটারের মাপ দেওয়া বালতি ব্যবহার করতে পারো। ২ লিটার পরিমাণ এই মিশ্রনের সাথে মেশাতে হবে স্টিমড্ বোন মিল (৫০ গ্রাম), শিং কুচো (২০ গ্রাম), সর্ষে/নিম খোল (৫০ গ্রাম)। এই মিশ্রণটা একটা পলিথিন চাদরের ওপর ছড়িয়ে মাঝে মাঝে জলের ছিটে দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। জল দেবার পর পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে বৃষ্টির জলে ধুয়ে না যায়।“

— “বাবুদা, গাছ লাগাব কখন? কত বড় টবে লাগাব?”
— “তুমি নভেম্বর মাসে লাগাতে পার। প্রথমে ভালো জায়গা থেকে শেকড়যুক্ত কাটিং কিনবে। সেটাকে ৩-৪ ইঞ্চি ব্যাসের টবে লাগাতে হবে। রাখতে হবে এমন জায়গায় যেখানে হাল্কা রোদ আসে। এটাকে হার্ডেনিং বলে, বাচ্চাকে শক্ত পোক্ত মানুষ করে তোলার মতো।“
— “ছোট টবে ক’দিন রাখব?”
— “এভাবে থাকবে ১৫- ২১ দিন, তারপর সেটাকে বড় টবে অর্থাৎ ১০-১২ ইঞ্চি টবে লাগাবে। টব কেনার সময় খেয়াল রাখবে যাতে টবের নিচে অন্তত ৩ টে ফুটো থাকে, একটা মাঝখানে, এবং অন্য দুটো পাশে, নীচের দিকের কানায়। টবের নিচে ১ ইঞ্চি পরিমাণ খোলামকুচি দিয়ে ভর্তি করতে হবে, জল নিকাশি ব্যবস্থা হিসেবে, যাতে জল না জমে। খোলাম কুচির ওপর সারমাটি দিয়ে ছোট পটের গাছ লাগাতে হবে এমনভাবে যাতে টবের কানা থেকে ২ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা থাকে, পরবর্তীকালে চাপান সার দেবার জন্যে। মনে রেখো, ডালিয়া কিন্তু পেটুক গাছ।“

— “আমার তো কচি পাঁঠার ঝোল ভালো লাগে। ডালিয়ার কোন খাবার পছন্দ?”
— “এর খাবার চাপান সার, তরল সার আর পাতার সার, তবে খেয়াল রাখবে যাতে গুরুপাক না হয়।“
— “সার কী ভাবে দেব?”
— “চাপান সার তৈরি করবে সারমাটি (৩ ভাগ), সর্ষে/নিম খোল (৩ ভাগ), স্টেরামিল/বিরল (১ ভাগ) দিয়ে। ২ মুঠো পরিমাণ এই চাপান সার টবের ধার বরাবর দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে বড় টবে গাছ লাগাবার দিন পনেরো পর থেকে যখন গাছ বাড়তে শুরু করবে। তারপর প্রতি ১৫ দিন অন্তর একই ভাবে চাপান সার দিতে হবে।“
— “ও, বুঝলাম। এটার জন্যেই টবের ওপর দিকে তুমি খালি রাখতে বলেছিলে। তরল সার কখন দিতে হবে?”
— “ঠিক তাই। কুঁড়ি আসার পর তরল সার দিতে হবে। একটা পাত্রে গোবর (২ ভাগ), সর্ষের খোল (২ ভাগ), মৌরলা মাছ (১ ভাগ), জল (১০ ভাগ) দিয়ে পচতে দিতে হবে ১০ দিন। এই পচানি ১ ভাগের সঙ্গে ২০ ভাগ জল মিশিয়ে প্রতি ১০ দিন টবে দিতে হবে যতদিন না কুঁড়িতে রঙ ধরছে।“
— “কিন্ত বাবুদা, এতে তো প্রচণ্ড দুর্গন্ধ হবে।“

— “তা একটু হবে, গন্ধ থেকে বাঁচতে তুমি পাত্রের মুখ বন্ধ করে রাখতে পারো। না হলে তুমি রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে পারো, ১৯:১৯:১৯ এনপিকে (২ গ্রাম) + ডিএপি (২ গ্রাম) ৫ লিটার জলে মিশিয়ে।“
— “তুমি পাতার সারের কথা কী বলছিলে?
— “হ্যাঁ, এই রাসায়নিক সার আরও তরল করে (১ ভাগ আর ২০ ভাগ জল), তার সাথে ট্রেস এলিমেন্ট মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করলে ভালো হয়।“
— “জল কখন দেব?”
— “জল দেবার সব চেয়ে ভালো সময় ভোরবেলায়, না হলে সূর্যাস্তের ৩ ঘণ্টা পর। জলের পরিমাণ এমন হবে যাতে টবের নীচের মাটিও ভেজে। সার দেবার পর অন্তত তিন দিন মাটি যেন ভিজে থাকে।“
— “পোকা মাকড়ের ব্যাপারে কী করব?”

— “ভালো প্রশ্ন করেছ। প্রতিষেধক হিসাবে কীটনাশক (যেমন রোগর) আর ছত্রাকনাশক (যেমন ব্লাইটক্স) প্রতি ১৫- ২১ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। এর সাথেও ট্রেস এলিমেন্ট যোগ করা যায়।“
— “দেখেছি ডালিয়া গাছে কাঠি বাঁধা থাকে…”
— “জায়ান্ট, লার্জ প্রজাতির ক্ষেত্রে ফুল বেশ বড় আর ভারী হয়, তাই কাঠি দিয়ে সাপোর্ট দিতে হয়।“
–“বাবুদা, ডালিয়া করার জন্যে তুমি আমাকে কয়েকটা নাম বল…”
— “দেখ কাঞ্চন, প্রচুর ডালিয়ার প্রজাতি আছে যার মধ্যে থেকে তোমাকে বেছে নিতে হবে যেমন প্রভুজি, সাহিত্য সম্রাট, মিনু…”
— “এগুলো তো বাংলা নাম।“
— “হ্যাঁ কাঞ্চন, পশ্চিম বাংলায় ডালিয়ার সংকরায়নের মাধ্যমে প্রচুর ডালিয়ার প্রজাতি তৈরি হয়েছে, আর এর পথপ্রদর্শক হলেন স্বামী বিনয়ানন্দ (ওরফে বুদ্ধদেব মহারাজ, ভিক্ষু বুদ্ধ), রামকৃষ্ণ মিশনের এক সন্ন্যাসী। এঁর দৌলতেই ভারত বিশ্বের ডালিয়া মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পেরেছে।“
–“বাবুদা,মনে হচ্ছে মা এবার খেতে ডাকবে, তুমি ডালিয়ার একটা লিস্ট করে দাও।“

এমন সময় হই হই করে আসরে ঢুকে পড়লেন অমরনাথদা। “তোমরা ভেবেছ একাই ইলিশ খাবে? আমিও খাব, আরও খাব। ও মাসিমা, আমি পায়স খামু।“ বলে ডালিয়ার লিস্টটা তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়ে, “ওরে বাবা, ডালিয়ার এত নাম আছে? আচ্ছা কাঞ্চন ওই রকম ধামা ধামা আকারের ডালিয়া করতে পারবে? অনেক খাটুনি তাই না?”
— “কাঞ্চনের ডালিয়া ভালোই হবে, তবে প্রদর্শনীর মতো করতে হলে অনেক বেশি নজর দিতে হবে। এমনিতে ডালিয়া করা খুব শক্ত নয়। ধরুন প্রদর্শনীর কেনিয়া প্রজাতি যেখানে ১৬- ১৮ ইঞ্চির ব্যাসের হয়, সেখানে কাঞ্চনের কাছে হেসে খেলে ১০- ১২ ইঞ্চি ব্যাসের হবে।“
এটা শুনেই অমরনাথদার মুখ হাঁ হয়ে গেল যদিও ইলিশ মাছ আর পায়স তখনও আসেনি!
ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।