ভুবন ডাঙার চিঠি
লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় মেরে কেটে ছয় ফুট। উচ্চতায় ফুট আষ্টেক। এই হল ঘর। তবে টিভি, সোফা, ফোন, ওয়াই ফাই সংযোগ সবই আছে ঘরে। কোনও ত্রুটি নেই। কেবল পৃথিবীর কোনও জায়গায় নয় এটি। চাঁদের (Moon) ক্লভিয়াস গহ্বরে এই বাসস্থান। আর এই গহ্বরেই গড়ে উঠেছে একটা ছোটখাটো কলোনি যার এক একটি ঘরে দিব্যি আছেন পৃথিবী থেকে আসা নয় নয় করে এগারোশো পুরুষ আর ছশো মহিলা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের দল।
চাঁদের যে দিকটা পৃথিবীর দিকে দৃশ্যমান, সেইদিকে রয়েছে এই ক্লভিয়াস। আদতে সে একটা প্রকাণ্ড গহ্বর, সাড়ে ৩ কিলোমিটার গভীর, ২৫১ কিলোমিটার ব্যস। চাঁদের দক্ষিণের পাথুরে এলাকায় ৪০০ কোটি বছরের প্রাচীন এই গহ্বর আকারে চাঁদের দ্বিতীয় বৃহত্তম গহ্বর। উল্কা পাতের ঝঞ্জাট নেই বললেই চলে। অর্থ্যাৎ মানুষের বসতি স্থাপন করার জন্য এটা যে আদর্শ জায়গা তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এমনিতে এই ক্লাভিয়াস বেসে থাকা খাওয়ার কোনও সমস্যা নেই। চাঁদের এই এলাকায় যেসব নুড়ি পাথর পাওয়া যায় সেগুলো গুঁড়ো করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অনেক কিছুই মেলে। শুধু তাই নয়, এই কলোনির বাস্তুতন্ত্রকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। ঠিক যেন একটা ক্ষুদে পৃথিবী।
আদতে মানুষের অন্তরীক্ষ জয়ের প্রথম ধাপ হিসাবেই গড়ে তোলা হয়েছে এই ক্লভিয়াস বেসকে। অন্য গ্রহে বসতি স্থাপনের আগে চাঁদের এই কলোনিই হল পৃথিবীর বাইরে প্রথম বাসস্থান। কৃত্রিম আবহাওয়া আর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে মানুষ কীভাবে থাকবে তার জ্বলজ্যান্ত নিদর্শন এটি।
এই পর্যন্ত পড়ে কেউ যদি এটাকে বাস্তব ভেবে থাকেন তাহলে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। আসলে বারংবার মহাকাশ অভিযানের পর মানুষ সত্যিই এখন গ্রহান্তরে পা রাখার জন্য প্রস্তত। আর্থার চার্লস ক্লার্কের ১৯৬৮ সালে লেখা অমর কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ২০০১ আ স্পেস ওডিসির এই কাহিনি, তাই এত বাস্তব মনে হচ্ছে।
অবশ্য একটা আশ্চর্য্য সমাপতন আছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষনা সংস্থা দ্য ন্যাশনাল এরোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসা এই ক্লভিয়াস গহ্বরেই জলের সন্ধান পায়। ফলে চাঁদকে বাসযোগ্য করার পথ আর একটু সহজতর হল বলে মনে করা হচ্ছে।
আর এই আবিষ্কারের কাহিনিও কিন্তু কম চিত্তাকর্ষক নয়। আদতে এই সন্ধান পাওয়া যায় পৃথিবী থেকেই। তার জন্য চাঁদে যেতেও হয়নি। নাসার মাটি থেকে ৪৫ হাজার ফুট ওপরে এক বিশেষ বোয়িং ৭৪৭ বিমানে রাখা ৯৮ ইঞ্চির বেন্ট ক্যাসেগ্রেন টেলিস্কোপের সাহায্যে এই আবিষ্কার হয়। নাসার এই বিশেষ ভাসমান পর্যবেক্ষন কেন্দ্রটির নাম স্ট্র্যাটোফেরিক অবজারভেটরি ফর ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনমি বা সংক্ষেপে সোফিয়া। এই সোফিয়া পালা করে থাকে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইসচার্চ বিমানবন্দর ও যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসের অদূরে অ্যান্টিলোপ ভ্যালিতে পামডেল বিমানবন্দরে।
তবে চাঁদের বাসস্থান নিয়ে গল্প ছাড়াও সত্যিকারের কাজ হচ্ছে। অস্ট্রিয়ার সংস্থা ন্যুমোসেল ৩২ জন মহাকাশচারীর থাকার জন্য ১৬টা গ্রিনহাউসের এক ছোট্ট কলোনির নকশা করেছে। তবে চাঁদের অতি তীব্র আবহাওয়ার জন্য বাসস্থানগুলো থাকবে চাঁদের মাটির তলায়। ন্যুমোপ্ল্যানেট নামের এই কলোনি চলবে সৌরশক্তিতে। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও শাকসবজি ও কলোনির বাসিন্দারা তৈরি করতে পারবেন। এখনও পর্যন্ত ঠিক রয়েছে চাঁদের মেরু অঞ্চলে হবে এই কলোনি কারণ তাতে সূর্যালোক তুলনামূলকভাবে বেশি পাবে।
পাশপাশি নাসাও কোমর বেঁধে নেমেছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে। চাঁদের পৃষ্ঠেই থাকার জন্য সারফেস হাবিটাট নামে এক প্রকল্পে হাত দিয়েছে তারা। এতে জনাচারেক নভোচর মাসখানেক থাকতে পারবেন। শুধু বাসিন্দাদের থাকা খাওয়া নয়, তাদের কাজের জন্য গবেষনাগার, ওয়ার্কস্টেশন সবই থাকবে তাতে। এরই অঙ্গ হিসাবে চলতি বছরে ফের চাঁদে নভোচর পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে নাসার।
হাউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে কৃত্রিমভাবে মঙ্গলের আবহাওয়া তৈরি করে সেখানে থাকার এক সিমুলেশন কেন্দ্রও বানিয়েছে নাসা। সম্প্রতি ৪ জন মার্কিন নভোচরর এই কেন্দ্রে বছরখানেক ছিলেনও। গ্রহান্তরে বসতি হলে মানবদেহের উপর ঠিক কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা কেন্দ্রে দেখা হচ্ছে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মানসিক প্রভাবও দেখা হচ্ছে। পরবর্তীকালে এই সিমুলেশন কেন্দ্রে স্পেস ওয়াকও করানো হবে। ক্রু হেলথ অ্যান্ড পারফর্মান্স এক্সপ্লোরেসন অ্যানালগ (ছাপিয়া)কে গ্রহান্তরে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে বড় পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।
পিছিয়ে নেই ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ)ও। জার্মান আর্কিটেক্ট সংস্থা হ্যাসেল স্টুডিও আর ক্রানফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ জীববিজ্ঞান ও মহাকাশ জীবপ্রযুক্তির অধ্যাপক ডেভিড কালেনের নেতৃত্বে চাঁদে বসবাসের জন্য এক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করছে। ইএসএ-অর্থ্যানুকূল্যে হওয়া এই পরিকল্পনা আপাতত চাঁদে ১৪৪ জন মহাকাশ বিজ্ঞানীর চাঁদে বাসস্থান তৈরি করার কথা মাথায় রেখে করা হচ্ছে। তবে পরিকল্পনা সফল হলে প্রথমে চাঁদ ও পরে মঙ্গলে বসতি তৈরির করার পথে নির্দেশক মডেল হবে।
ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) ও গ্রহান্তরে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার আর রোবোটের সাহায্যে চাঁদে ইগলু আকৃতির ঘর বানানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে ইসরো। আর এরই প্রথম ধাপ হিসাবে ২০৩৫ এর মধ্যে পৃথ্বি থেকে ৪০০ কিমি দূরে মহাকাশ স্টেশন গড়তে চলেছে ভারত। ৪০০ টনের এই ‘ভারতীয় অন্তরীক্ষ স্টেশনে’ জনা চারেক নভোচারি তাদের গবেষনা চালিয়ে যেতে পারবেন।
আদতে ১৯৬৯ এ চাঁদে মানব পদচিহ্ন পড়ার পর গঙ্গা, নীল, আমাজন, দানিয়ূবে কয়েক বিলিয়ণ কিউসেক জল বয়ে গিয়েছে। মানুষ এখন আর চাঁদে নেমেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, সে চাইছে থাকতেও। আর সাম্প্রতিক যেসব চন্দ্রাভিযান হচ্ছে তার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে এই ব্যাপারে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করা যাতে কলোনি গড়ার সময় সেটা কাজে লাগে। মানুষ আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে একদিন না একদিন ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রব উঠবে। তখন অন্য গ্রহে যেতেই হবে। চাঁদ সবচেয়ে কাছের। ফলে পৃথ্বির এই লেজুড়কে দিয়ে প্রক্রিয়াটা শুরু করা যেত। ব্যাপারটা এখন যতই আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনাক, একদিন তা নির্মম সত্যিতে যে পরিণত হবে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ নিঃসন্দীহান।

এ ছাড়া অন্য গ্রহ থেকে খনিজ সম্পদ আহরনের ব্যাপারটিও আছে। চাঁদের কথাই ধরা যাক। যে শপাঁচেক কেজি চাঁদের বিভিন্ন মাপের পাথর আনা হয়েছে তা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, টিটানিয়াম প্রভৃতির হদিশ মিলেছে।
বস্তুত খনিজ নিয়ে দীর্ঘদিন কোনও উচ্চবাচ্য হয়নি। ১৯৭৬ এর অগস্টে তৎকালীন সোভিয়েত রোবটচালিত মহাকাশযান লুনা ২৪ তেরো দিনের চন্দ্রাভিযান শেষে চাঁদের ১৭১ গ্রাম নুড়ি পাথরের নমুণা নিয়ে ফিরে আসে। এর আগে লুনা সিরিজের লুনা ১৬ ও লুনা ২০ও মোট দেড়শো গ্রাম নমুনা নিয়ে আসে।
সম্প্রতি এ নিয়ে ফের উঠে পড়ে লেগেছে চিন। সম্প্রতি চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ৪০০ কোটি বছরের প্রাচীন এইটকিন গহ্বর থেকে প্রথমবারের মতো মাটি আর পাথরের নমুণা সংগ্রহ করেছে চিনের চাঙ্গি ৬ নামে মহাকাশযান। হাইনান দ্বীপের ওয়েন্যাঙ মহাকাশযান উৎক্ষেপন কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপন করা এই মহাকাশ যানের সংগ্রহ করা নুড়ি পাথরের মধ্যে ২৫ লক্ষ বছরের পুরনো আগ্নেয়গিরির শিলাও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বস্তুত মহাকাশের দিকে মুখ করা অংশ থেকে এই প্রথম নমুনা পাওয়া গেল। এর আগের মহাকাশযান চাঙ্গি ৫ চাঁদের ‘ওসান অফ স্টর্ম’ থেকে কেজি দুয়েক নমুনা সংগ্রহ করেছিল।
বস্তুত চাঙ্গি ৬-এর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার আরও একটা কারণ আছে। এই দক্ষিণ মেরুতেই চিন আর রাশিয়া মিলে ইন্টারন্যাশানাল লুনার রিসার্চ স্টেশন (আইএলআরএস) তৈরি করার পরিকল্পনায় রয়েছে। বেজিং-এর পরিকল্পনা মাফিক চাঙ্গি ৭ ও চাঙ্গি ৮ এই স্টেশন গড়ার কাজকেই এগিয়ে দেবে। চিনের পরিকল্পনা রয়েছে চাঁদ, মঙ্গল, গ্রহানু বেল্ট আর বৃহস্পতির চাঁদগুলোতে বসতি করার যাতে গ্রহান্তর থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য অন্য এক আশঙ্কার কথাও শুনিয়েছেন। তাঁদের মতে, মহাকাশ যুদ্ধের সময় এই স্টেশনগুলোই সামরিক ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারে বেজিং-এর।
চিনা উপকথায় চাঁদের দেবীর নাম চাঙ্গি। ২০০৭ সালে শুরু হয় চাঙ্গি মিশন। ওই বছর চাঙ্গি ১ কে চাঁদের কক্ষপথে পাঠানো হয়। এরপর ২০১০ সালে চাঙ্গি ২ চাঁদের কক্ষপথে ঢুকেই ক্ষান্ত হয় না, চাঙ্গি ৩ যাতে চাঁদে অবতরন করতে পারে তাও খতিয়ে দেখে। বস্তুত চাঙ্গি ২ এর তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চাঙ্গি ৩ চাঁদে অবতরন করে। সরেজমিনে চাঁদের উপরিভাগ দেখা ও নমুনা সংগ্রহ করার জন্য রোবট নিয়ন্ত্রিত রোভার উটু (চিনা উপকথায় উটু হল চন্দ্রদেবী চাঙ্গির পোষা খরগোস) বেরিয়ে এল মহাকাশযান থেকে। সপ্তাহ দুয়েক বাদে ইলমেনাইট নামে একধরনের কালো রঙের খনিজের খোঁজ পাওয়া গেল। ২০১৯ র ৩রা জানুয়ারি প্রথম মহাকাশযান হিসাবে চাঁদের অন্ধকার দিকে চাঙ্গি ৪ অবতরন করল।
তবে যতটা সহজ ভাবে চাঁদে বসবাসের কথা বলা হচ্ছে, বিষয়টি মোটেই অত সহজ নয়। প্রযুক্তিবিদদের মতে, নানা কারণে গোটা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সাবধানে এগোতে হবে। প্রথম বিপদ আসতে পারে আবহাওয়া রক্ষাকবচহীন পরিবেশে স্রোতের মতো ধেয়ে আসা ছোট-বড় উল্কা বৃষ্টিকে সামাল দেওয়া। শঙ্কা রয়েছে চাঁদের উপরিভাগ সরাসরি অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে থাকার ফলে মানবদেহে ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া মানসিক চাপও আছে। আবহাওয়াহীন শব্দহীন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া চাঁদের বাসিন্দাদের কাছে যে রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ‘ফল অফ মুনডাস্ট’এ আর্থার সি ক্লার্ক দেখিয়েছেন উল্কাপাত থেকে বাঁচাতে চাঁদে গোলাকৃতি টিউবের মতো ফোলানো বৃত্তাকার বাসস্থান। নাম দিয়েছিলেন ইগলু লুনার হ্যাবিটাট।
তবে এখনও পর্যন্ত একজনও বাসিন্দা চাঁদে না থাকলেও চাঁদের বুকে ছড়িয়ে আছে নাসার জ্যোতির্ভূতত্ত্ববিদ ইউজিন শুমেকারের চিতাভস্ম। পলিকার্বনেট ক্যাপসুলে রয়েছে সেই চিতাভস্ম। ওপরে রয়েছে শুমেকারের নাম, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ আর তার ছবি। ১৯৯৯ সালের ৩১ জুলাই চাঁদের বুকে প্রোথিত হয় শুমেকারের চিতাভস্ম।
এই হয়তো শুরু। আগত শতাব্দীতে আরও বহু জন্ম মৃত্যু দেখবে চাঁদের নীরব প্রান্তর।
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে