গত ৬ আগস্ট ২০২২, যাদবপুর বিদ্যাপীঠ সংলগ্ন ইন্দুমতি সভাগৃহে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গানের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আয়োজক ‘দিঠি’। এই সংস্থা গত দু’দশক ধরে মূলত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে নানাবিধ গঠনমূলক কাজে যুক্ত। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলার বিখ্যাত মনীষীদের লেখা এবং সুর দেওয়া গানগুলি এই অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং কাজি নজরুল ইসলামের গানের নির্বাচিত সংকলন।
অনুষ্ঠানের গানগুলি মূলত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথমত: ভারতবর্ষের মর্মগত পরিচয়ের প্রকাশ এবং দ্বিতীয়ত: দেশমাতৃকা রূপে চেতনার উদ্বোধন। মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে শোভনা ঘোষের গ্রন্থনা ও ভাষ্যপাঠে জানা যায়, ভারতবর্ষের মর্মপ্রোথিত বাণী হল আত্তীকরণ এবং যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের প্রভেদ এবং বৈষম্য অতিক্রম করে কীভাবে মিলন এবং ঐক্যের বার্তা বহন করে চলেছে আমাদের দেশ। অনুষ্ঠানের প্রথম গান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের রচনা ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিবেশন করেন দুই গুণী শিল্পী শ্রী সন্দীপ ঘোষ এবং শ্রীমতি দয়িতা দত্ত। দ্বিতীয় গানটির প্রেক্ষাপট হিসেবে শোভনাদেবীর পাঠে ফুটে ওঠে, ভারতবর্ষ কীভাবে যুগ যুগ ধরে মানবসভ্যতাকে উপকৃত করেছে, অথচ বারবার বৈদেশিক শক্তির হানায় জর্জরিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় গান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক রচনা ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’। এ গান প্রথমবার গাওয়া হয়েছিল হিন্দুমেলায়। এই গানটির ভিতরের অনুচ্চ বেদনা অনুভব করে পরিবেশন করার অসামান্য মুন্সিয়ানা ছিল দয়িতা দত্তের কণ্ঠে এবং সঙ্গে যথোপযুক্ত সহযোগিতা করেন তবলায় স্বাগতম দাস এবং এস্রাজে নন্দন দাশগুপ্ত।
অনুষ্ঠানের তৃতীয় গানটি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’, যেটি চৈত্র মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে গাওয়া হয়। এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: এই গানটি পরাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় গাওয়া হত। দয়িতার মর্মস্পর্শী গায়কী এবং উপযুক্ত যন্ত্রসংগীত সহযোগে গভীরভাবে দেশাত্মবোধ ফুটে ওঠে। চতুর্থ গান দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত, রাগ ভৈরবীতে আধারিত ‘পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গে’। দ্বৈত কণ্ঠে সন্দীপ ঘোষ এবং দয়িতা দত্ত অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে গানটি পরিবেশন করেন। দুই শিল্পীর দৃপ্ত এবং সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া এই গান শ্রোতাদের অন্তর বিশেষভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। পঞ্চম গানের পূর্বে শোভনাদেবীর ভাষ্য়ে ফিরে আসে ভারতবর্ষের ঐক্যের বার্তা। শ্রীমতি ঘোষ এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ভারতবর্ষের ইতিহাস” প্রবন্ধের উল্লেখ করেন। পঞ্চম গানটি প্রখ্যাত কবি, গায়ক এবং সুরকার অতুলপ্রসাদ সেনের রামপ্রসাদী রচনা ‘দেখ মা এবারের দুয়ার খুলে’। গানটি সন্দীপ ঘোষের ভাবপূর্ণ উদাত্ত গলায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। খোল বাজিয়ে যথোপযুক্ত সহযোগিতা করেন স্বাগতম দাস। পরের গানটির প্রারম্ভে খুব সৃষ্টিশীলভাবে নন্দন দাশগুপ্তর এস্রাজ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘এবার নবীন মন্ত্রে হবে’ গানটির রচয়িতা বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম। গানটির মূলে রয়েছে সেই ঐক্যের বার্তা যাতে কোনও পুরুষ নারী বা জাতপাতের ভেদ নেই এবং সবাই দেশমাতৃকার সন্তান। এই দেশাত্ববোধক গানটির মধ্যে যে আকুতি রয়েছে, সেটি দয়িতার সুরেলা গলায় অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
পরের গানটি খুব পরিচিত রবীন্দ্রসংগীত ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’। এ গান প্রসঙ্গে শোভনাদেবী মনে করিয়ে দেন, কীভাবে এ দেশে যুগযুগান্তর ধরে নারী নির্যাতন হয়ে চলেছে এবং দেশমাতৃকা যেন চোখের জল ফেলছেন আর ভাবছেন যে সুসন্তানেরা এসে একদিন এই কালিমা মুছে দেবে। এ গানে যে গভীর বেদনা আছে, সেটি সন্দীপ ঘোষ অসামান্যভাবে তাঁর গায়কীর মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। আট নম্বর গানটি আর একটি পরিচিত বাউলাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত ‘রইল বলে রাখলে কারে’ শোনা গেল দুই শিল্পীর গলায়। দ্বৈতকণ্ঠে খুব সুন্দর পরিবেশনা। বিশেষত গায়কীতে গানের বিদ্রোহী মেজাজটি অটুট রয়েছে। পরের গানটিও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের ‘আপনি অবশ হলি’ যেখানে তিনি ভারতবাসীকে ডাক দিচ্ছেন আলস্য কাটিয়ে দেশের জন্য উঠে দাঁড়াতে। দয়িতা এ গানটির মূল বাণী স্মরণে রেখে বলিষ্ঠভাবে পরিবেশন করেছেন। অনুষ্ঠানের শেষ গানটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এটিও স্বদেশ পর্যায়ের বাউলাঙ্গের গান– ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’। দ্বৈতকণ্ঠে অত্যন্ত সাবলীলভাবে এ গান দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।
এই অনুষ্ঠানটি স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি অদ্বিতীয় প্রচেষ্টা। প্রতিটি গান খুব ভাবনাচিন্তা করে রচনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাছা হয়েছে। গানগুলির সম্পূর্ণ স্বকীয়তা বজায় রেখে সন্দীপ ঘোষ এবং দয়িতা দত্ত অত্যন্ত মননশীলভাবে পরিবেশন করেছেন। অনুষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শিল্পী এবং সংগতকারদের মধ্যে সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখা। শোভনা ঘোষের রচনা অত্যন্ত চিন্তাশীল এবং পাঠ সাবলীল। গানের পটভূমি সম্বন্ধে সৃষ্টিশীল ব্যাখ্যা আকর্ষণীয়। শিল্পীদের বিষয়ে বলি, অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী হলেন সন্দীপ ঘোষ এবং তাঁর সুযোগ্যা ছাত্রী, অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিল্পী এবং শ্রুতি মিউজিক অ্যাকাডেমি, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিষ্ঠাতা দয়িতা দত্ত। রচনা এবং পাঠে ছিলেন ডক্টর শোভনা ঘোষ, যিনি ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান। তবলা সহযোগিতায় ছিলেন স্বাগতম দাস, এস্রাজে নন্দন দাশগুপ্ত এবং মন্দিরায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। শব্দ প্রক্ষেপণের দায়িত্বে ছিলেন হাসি পাঞ্চাল।
শিল্পীদের ওয়েবসাইট – সন্দীপ ঘোষ, দয়িতা দত্ত
ভিডিও – Youtube
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।