বিশিষ্ট বেহালাবাদক তথা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র শিশিরকণা ধর চৌধুরী প্রয়াত হলেন ৯ মার্চ ২০২১। বাংলালাইভের তরফ থেকে তাঁকে স্মরণ করতে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। শোকবিহ্বল হলেও তাঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাঁদের গুরুকে, বাংলালাইভের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের শেষ প্রণাম। পাঠকদের জন্য রইল সেই বিশেষ সাক্ষাৎকার। আজ শেষ পর্ব।
আগের পর্বের লিংক: বিদূষী শিশিরকণা ধর চৌধুরীকে নিয়ে: প্রথম পর্ব
প্রখ্যাত তবলিয়া অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। চার বছর বয়স থেকে তবলায় হাতেখড়ি। তুষার কান্তি বসু, মানিক পাল, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে শিক্ষা। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে শিখেছেন কণ্ঠসঙ্গীত এবং দীর্ঘ দশ বছর বিদূষী শিশিরকণা ধর চৌধুরীর কাছে শিখেছেন বেহালা। পণ্ডিত রবিশঙ্কর থেকে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, যসরাজ থেকে বালমুরলী কৃষ্ণান, কার সঙ্গে না বাজিয়েছেন তিনি! তবলা লহরা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী। ২০০১ সালে ভারতে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের সংস্থা ‘ধ্বনি অ্যাকাডেমি অফ পারকাশন মিউজ়িক’। পরে আমেরিকার লস এঞ্জেলেস ও নিউ ইয়র্ক শহরে দু’টি শাখাও পত্তন করেন। শিশিরকণা ধর চৌধুরীর শেষ ডোভার লেন কনসার্টে তিনিই ছিলেন তাঁর সঙ্গে তবলায়। প্রিয় শিশিরদির স্মৃতিচারণে অভিজিৎ-
‘শিশিরদির ব্যাপারে কথা বলার সময় আবেগ সংযত রাখা খুবই কঠিন আমার পক্ষে। আসলে ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগটা ছিল অদ্ভুত রকমের। আমি ১৯৮৫ সাল থেকে ওঁর কাছে বেহালা শিখতে শুরু করি। সে সময় আমি গান করতাম এবং তবলা বাজাতাম। বেহালার ব-ও জানতাম না। কিন্তু খুব ইচ্ছে হল বেহালা শেখার। চলে গেলাম ওঁর কাছে। এতখানি ‘নভিশ’কে উনি যে শেখাতে রাজি হবেন, ভাবতেই পারিনি। শুধু যে রাজি হলেন, তা-ই নয়, একেবারে অআকখ থেকে শেখাতে লাগলেন। কীভাবে বেহালা ধরতে হয়, ছড় ধরতে হয় সেই শিক্ষা থেকে শুরু করে কতকিছু যে শিখেছি, আজ ভাবলে অবিশ্বাস্য ঠেকে। এ আমার পরম সৌভাগ্য। ওঁর যে মান, যেখানে সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে ওঁর বিচরণ, সেই জায়গা থেকে নেমে এসে একজন প্রায় আনাড়িকে এইভাবে বেহালা কেনা থেকে ঠিকভাবে ধরা, এই স্তর থেকে যে উনি শেখাতে রাজি হবেন আমি কল্পনাও করিনি।
শিখতে শিখতে চার তার থেকে যখন পাঁচ তারে এলাম, তখন কোন দোকান থেকে তার কিনব সেটা পর্যন্ত বলে দিতেন। আমি তবলা বাজাতে বিদেশে আসতাম বলে উনি নির্দেশ দিয়ে দিতেন যেন টমাস টিক-এর তার কিনি কারণ তাতে সুরের অণুরণন সবথেকে ভাল বোঝা যায়। প্রত্যেক রবিবার শিখতে যেতাম। কোনও অনুষ্ঠান থাকলে আগে থেকে জানাতাম। এভাবে দশ বছর ওঁর কাছে শেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সবসময় যে নিজে শিখতাম তা নয়, কখনও অন্য কাউকে শিখিয়েছেন, আমি কেবল শুনেছি। কখনও শেখানোর সময় তবলায় সঙ্গত করেছি। নানাভাবে ওঁর সাহচর্য পেয়েছি। কখনও এমন হয়েছে যে গৎ শিখতে শিখতে বেহালায় এমন নিমগ্ন হয়ে গেছি যে পাশে তবলার ঠেকা খেয়ালই করিনি। উনি ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, তুমি না নিজে তবলিয়া? পাশে তবলা বাজছে আর তাকে কানে না নিয়ে তুমি গতে মনোযোগ দিয়েছ? দুটোই মন দিয়ে শুনলে তবেই না সার্থক সঙ্গীত হবে!’ খুব লজ্জা পেয়েছি, কিন্তু এগুলো থেকেই শিক্ষা নিয়েছি।
এরপর বেহালা বাজানোয় ছেদ পড়লেও সম্পর্কে ছেদ পড়েনি কোনওদিন। উনি যখন সান ফ্রানসিসকো-তে আলি আকবর কলেজ অফ মিউজ়িকে অধ্যাপনা করেছেন, আমি বহুবার গিয়েছে খাঁ সাহাবের সঙ্গে, ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। দেখতাম কীভাবে খাঁ সাহাবের পায়ের কাছে বসে গবেষণাপত্র তৈরি করে চলেছেন একমনে। আলাউদ্দিন খাঁ সাহাবের উপর লেখা তৈরি করছেন। প্রণাম করতে গেলে উস্তাদজিকে দেখিয়ে বলতেন, ‘বাবার সামনে আমাকে প্রণাম করবে না।’
এরকম মানুষের সঙ্গ পাওয়াটাই তো ভাগ্যের কথা। উনি নিজের গুরুকে যে শ্রদ্ধা করতেন, নিজের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেও সেই শ্রদ্ধা বরাবর পেয়েছেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জগতে এমন প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী সঙ্গীতজ্ঞ খুবই কম এসেছেন।

ওঁর বেহালার ‘টোন’ ছিল একদম আলাদা। মাইহার মতে যেভাবে বেহালাটা ব্যবহার করেছেন, সেতার এবং সরোদের কাজগুলি বেহালার ছড়ে তুলে আনা, সেটা কতখানি কঠিন, শিল্পী ছাড়া কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। উনি যখন বিদেশে বঙ্গসম্মেলনে বাজাতে গেছেন, সেখানে আমি গিয়েছি দেখা করতে। অনেকেই অনুরোধ করেছে আমাকে ওঁর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতে। কিন্তু আমি কোনওদিন রাজি হইনি। কারণ উনি আমার গুরু। ওঁর প্রতি যে সমীহ, যে শ্রদ্ধা আমার ছিল, একসঙ্গে মঞ্চে সঙ্গত করার কথা ভাবতেই পারতাম না।
কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ একবার ডোভার লেন থেকে অনুরোধ এল, শিশিরকণা ধর চৌধুরীর সঙ্গে আমাকে সঙ্গত করতে হবে। আমি যথারীতি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ হল না। অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানালেন, গুরুমা নিজে বলেছেন, আমি বাজালে নাকি ওঁর খুব ভাল লাগবে, তৃপ্তি পাবেন। সেকথা শুনে আর বারণ করতে পারিনি। রাজি হলাম। যেদিন অনুষ্ঠান, তার আগে মহড়ার জন্য যোগাযোগ করলাম। উনি বললেন, ওসবের কোনও দরকার নেই অভিজিৎ। তুমি ওইদিন একেবারে মঞ্চে চলে এস।
যথাসময়ে পৌঁছলাম অনুষ্ঠানে। আমাদেক দেখে আপ্লুত হয়ে খুব আদর করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখনও বেহালা বাজাও?’ বলতেই হল অনুষ্ঠানের চাপে আর তেমন হয়ে ওঠে না। কষ্ট পেলেন। বললেন, ‘বাবা, অনেক কষ্ট করে শিখিয়েছিলাম তোমাকে। একটু বাজিও। এত ভাল গান করতে তুমি। সেটাও বন্ধ করে দিও না।’ আমারও খুব খারাপ লেগেছিল সেইদিন। বাড়ি ফিরেই বাক্স খুলে বেহালা বের করে সারালাম। তারপর থেকে সময় পেলেই একটু একটু বাজাতে চেষ্টা করি, যা শিখেছি সেটুকুই।
সেদিনের অনুষ্ঠানে সঙ্গত করার সময় অবাক হয়ে দেখেছিলাম, অত বয়সেও পরিপূর্ণ সঙ্গীতচেতনা রয়েছে ওঁর মধ্যে। হাতে কোনও জড়তা নেই। যতদূর মনে পড়ে দুটিই নিজের সৃষ্ট রাগ বাজিয়েছিলেন– তরঙ্গিণী ও ভবতারিণী। একটা ঝাঁপতালে, একটা তিনতালে। সেই বছর ওঁর একটি সিডি প্রকাশ হয়েছিল ডোভার লেন থেকেই। উনি আমাকে বললেন, ‘আমি চাই তোমার হাতে সেটা প্রকাশ হোক।’ ওঁর কথা ফেলতে পারলাম না। আমার গুরুর সিডি ডোভার লেনের মতো মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওঁর সামনে উদ্বোধন করতে পারলাম, এ আমার অনেক জন্মের পুণ্যের ফল। এর বেশি আর কী বলব? ওঁকে ভোলা তো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। ওঁর সঙ্গীত, ওঁর জীবনচর্যা বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করব নিজের মধ্যে। ওঁর অভাব বোধ করব সারাজীবন।’
ভারতের অন্যতম সেরা তালবাদ্যকার এবং ফিউশন সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল নাম বিক্রম ঘোষ। বিশিষ্ট তবলিয়া পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ এবং সুগায়িকা বিদুষী সংযুক্তা ঘোষের সুযোগ্য পুত্র বিক্রম শুধু যে ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারায় নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন তা-ই নয়, ফিল্ম সঙ্গীতের জগতেও তাঁর খ্যাতি আন্তর্জাতিক। তাঁর সঙ্গীতে একসঙ্গে স্থান পায় রক, লোকসঙ্গীত, জ্যাজ় থেকে শুরু করে ভারতীয় মার্গসঙ্গীত পর্যন্ত সমস্ত ধারার সুর। রিদমস্কেপ নামে তাঁর ব্যান্ডটিও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ফিল কলিন্স থেকে বব ডিলান, সকলের সঙ্গে এক মঞ্চে বাজানোর বিরল অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তাঁর একাধিক অ্যালবাম পেয়েছে গ্র্যামি নমিনেশন। বাজিয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর থেকে শুরু করে রশিদ খান পর্যন্ত সকলের সঙ্গে। স্মৃতিচারণে বিক্রম–
শিশিরকণা ধরচৌধুরী যে আসামান্যা শিল্পী ছিলেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার চেয়েও যেটা বড় কথা তাঁকে মহিলা বেহালাশিল্পীদের সামনে এক আলোকশিখা হিসেবে উপস্থাপিত করা যায়, করা উচিত বলে আমার মনে হয়। উনি স্বনামধন্যা ছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন, সেসব তো আছেই। তবে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের জগতে মহিলাদের স্থান অনেকটা উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন এই শিল্পী।
আমার বাবা পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ ছিলেন ওঁর খুবই ঘনিষ্ঠ। এক দশকেরও বেশি সময় তাঁরা একসঙ্গে মঞ্চে বাজিয়েছেন। ওঁদের যুগলবন্দি, বোঝাপড়া ছিল দেখবার মতো। অনেক পরে, যখন আমি বাজানো শুরু করি, কলকাতার বাইরে আমার প্রথম অনুষ্ঠান ছিল ওঁরই সঙ্গে, গুয়াহাটিতে। সেই শুরু। তারপর গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়ে বহু অনুষ্ঠানে আমি সঙ্গত করেছি ওঁকে। ওঁর বেহালার ‘টোন’ ছিল অসাধারণ সুন্দর। যখন বাজাতেন, মনে হত সরাসরি হৃদয়ে গিয়ে লাগছে সেই সুর।
মানুষ হিসেবেও ওঁর কোনও তুলনা ছিল না। কোনওদিন উঁচু স্বরে কথা বলতে বা রাগ করতে দেখিনি। মায়ামমতা দিয়ে ঘেরা এক অদ্ভুত ভালবাসার মানুষ ছিলেন, যা সত্যিই আজকের যুগে দুর্লভ। আমি চিরকাল ওঁকে শিশিরপিসি বলেই ডেকে এসেছি। আজও তাই বলছি, শিশিরপিসি, তোমার অভাব কোনওদিনও পূর্ণ হবার নয়। জানি, আজ তুমি ওপরে কোথাও বসে আমার বাবার সঙ্গে দারুণ যুগলবন্দিতে বাজাচ্ছ, আনন্দ করছ। তবে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে এই ক্ষতি অপূরণেয় হয়েই থাকবে। তোমার শান্তি কামনা করি।
মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial