Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ছিন্নপাতার সাজাই তরণী (পর্ব ৩): আশীর্বাদ উৎসব

ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩

Indrani Bhattacharya Column of memories part 3
Indrani Bhattacharya Column of memories part 3
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আগের পর্ব পড়তে: [] []

পাহাড়ী (আমার মা), নীহার (আমার বাবা) সবাই দেখো রবিশঙ্করজী, কমলাদি, শঙ্করলাল সবাই এসে গেছে। তোমরা ওদের ওপরে নিয়ে এসো— দাদু ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। মেঘগর্জনের মতো গলায় খুব অস্থির হয়ে সবাইকে ডাকাডাকি করছে। শঙ্খ, হুলুধ্বনির আওয়াজে; আশেপাশের বারান্দা, ছাদে মানুষজনের উৎসুক উঁকিঝুঁকিতে কালোমাথার ঠোকাঠুকি। বিশাল রেডিওগ্রামের রেকর্ডচেঞ্জারে রবিশঙ্করের সেতার বেজে চলেছে। বাড়ির ঠাকুর, রাঁধুনি, বাকি সবাই ঘাম মুছতে মুছতে সিঁড়ির তিনতলা, চারতলা চাতালে সসঙ্কোচে দণ্ডায়মান। রবুদা আর কমলাদিকে নিয়ে শঙ্করলালের প্রবেশ, বিশাল লিভিংরুমে। দাদুর দু’হাত চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে রবুদা বললেন, “ভারী আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু কোথায় আপনার মা লক্ষ্মী নাতনিটি, তাকে তো দেখছি না!”

—গৌরী, গৌরী … (আমার ডাকনাম)

—ও বাবা, ইন্দ্রাণীর নাম গৌরী নাকি? ও শঙ্করলাল! একেবারে গৌরী-শঙ্কর? কমলাদি পাশ থেকে সজোরে হেসে উঠলেন। আমি ধীর পায়ে বাবার সঙ্গে এসে সবাইকে প্রণাম করলাম। পা ছুঁলাম।

Indrani Bhattacharya
আমার পোষ্যদের সঙ্গে আমি

রবুদা বাবার দিকে হাতজোড় করে বললেন, আপনার মেয়ে বলে দিতে হবে না। এ তো পুরোদস্তুর পিতৃমুখী কন্যা। আপনি ইন্দ্রাণীর বাবা সেটাও পরিষ্কার। দু’জনের এত মিল!

কমলাদি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিবুক ছুঁয়ে বললেন, পিতৃমুখী কন্যারা খুব সুখী হয়। 

এই ফাঁকে বলে রাখি কমলাদি রবুদার দীর্ঘকালের সঙ্গিনী। বম্বের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর স্ত্রী। স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী লক্ষ্মীশঙ্করের বোন। ভারী গুণী মহিলা। রবুদার সব ঝক্কি কমলাদি একলাই সামলান। যত দিন গেছে ক্রমশ বুঝতে পেরেছি কত সহনশীল এই মহিলা। আস্তে আস্তে সব বলব। 

রবুদা ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখতে দেখতে বললেন, শংকরলাল, কী অসাধারণ কালেকশন! এ তো জাদুঘরকেও হার মানাবে। আর এই রেডিওগ্রাম। এত বড়। কী সুন্দর আওয়াজ! এই বাড়ির মানানসই একেবারে। আমি তোমার দাদাশ্বশুরের নাম শুনেছি। এখন আলাপ করে তো মনে হচ্ছে অনেক কিছু জানার আছে ওঁর কাছে। 

With Father
বাবার সঙ্গে আমি- পিতৃমুখী কন্যা

আজকের এই আশীর্বাদ অনুষ্ঠান রবুদা, কমলাদির ইচ্ছেতেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রবলপ্রতাপ এবং চরম সৎ পুলিশ আধিকারিক (পুলিশ কমিশনার, আইজি হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত) দাদুকে শংকরলালই প্রস্তাব দেয় এই আয়োজনের। দাদু হবু নাতজামাইয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেননি। পুলিশের বাড়িতে আশীর্বাদের ব্যবস্থা জেনে কৌতুক করে রবুদা শংকরকে বলেছিলেন, পুলিশি আইন মেনে শুধু কি শরবতের ব্যবস্থা থাকবে?

আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের শেষে ভূদেবদা (ভূদেবশঙ্কর, রবুদার ভাইপো) চমৎকৃত হয়ে অফিস চলে গেলেন। জরুরি কাজ আছে। কমলাদি, রবুদা বহুক্ষণ আবিষ্ট হয়ে থাকলেন আমাদের ছাদবাগানে। চারতলায় এই বাগান, আমার গানঘর বড় প্রিয় আমার।

বিস্মিত, মুগ্ধ রবুদা বললেন, এই ধুলোধূসরিত কলকাতায় এমন শৌখিন মানুষ আছে বিশ্বাসই হয় না! আরও অবাক ছাদবাগানের মাঝে আমার গানঘর দেখে। শ্বেতশুভ্র দেওয়াল। খাটের ওপর দুধসাদা গদিওয়ালা গালিচা। হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা। চমৎকৃত রবুদা বলেই ফেললেন, —ও শংকরলাল, এ যে নন্দনকানন! সঙ্গে মা সরস্বতী। কী করে খুঁজে পেলে গো! রাজত্ব, রাজকন্যা, বাঃ বাঃ!

Ravishankar with family

দাদু খুব উৎসাহের সঙ্গে রবুদা, কমলাদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন— ফুলবাগান, ঠাকুরঘর, খরগোশ, গিনিপিগ, বড় বড় খাঁচাবন্দি রকমারি পাখি। আর আমি অবাক বিস্ময়ে ক্রমশ উপলব্ধি করছি সেতারের জাদুকর, বিশ্বশ্রুত রবিশঙ্কর একেবারে আমাদের পাশের বাড়ির মানুষ। ছেলেমানুষের মতো উচ্ছ্বাস, অনুসন্ধিৎসা! তাঁর কথাবার্তায়, চলনে, বলনে, সমস্ত শরীর জুড়ে বিস্ময় ঝরে ঝরে পড়ছে। মাঝেমাঝেই হাসিমুখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি কোথায় যে লুকাই নিজেকে! ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই দাদু, কমলাদি, রবুদাকে ঘিরে রেখেছে। আমি আস্তে আস্তে ওদের মধ্যে মিশে গেলাম। আশীর্বাদ পর্ব শেষ হল। 

মা, বাবা, দাদু, শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির বড়রা, সবশেষে রবুদা, কমলাদির পালা। কমলাদি-রবুদার আশীর্বাদী হিসেবে পেলাম দক্ষিণী আশীর্বাদী রুপোর প্রদীপ। অনেকটা রাজসিংহাসনের মতো দেখতে। দক্ষিণী চাদর, শাড়ি আর ধূপের প্রচুর প্যাকেট। নানান রকমারি সুগন্ধী। একটা ওড়না। এ সবই দক্ষিণ ভারতীয় রীতি মেনে। আদতে কমলাদি ছিলেন দক্ষিণ ভারতের মানুষ। এ সবই তিনি সেই নিয়মনীতি মেনেই করেছেন। রবুদার অবাক হওয়া তখনও শেষ হয়নি। মধ্যাহ্নভোজে বসেই প্রথম উচ্ছ্বাস শালপাতা, মাটির ভাঁড়ের জল দেখে। ভারী খুশি রবুদা, কমলাদি। শালপাতা আবার মাটির থালার ওপর রাখা। 

এরপর মধ্যাহ্নভোজের পদ পরিবেশন। সাদা ভাত, হলদে পোলাও, শাকভাজা, ন্যাশন ভাজা, শুক্তো, মুগ ডাল নারকোল সহযোগে, দইকাতলা, চিংড়ি মালাইকারি, মাটন কোর্মা, আনারসের চাটনি, মোল্লারচকের লাল দই, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, স্পঞ্জ রসগোল্লা, আইসক্রিম সন্দেশ। 

রবুদা একদম গলে জল। এইসব কতকাল খাওয়া হয়নি। ও শংকরলাল, এদের কোথায় পেলে গো…

Ashirbad
আশীর্বাদ পর্ব

খেতে বসে আমার মা, বোন, হবু ননদদের সঙ্গে বাঙালি রান্না নিয়ে কত গল্প করলেন রবুদা। মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গেই রবুদা, কমলাদি আপনজনের মতো মিশে গেলেন। 

আমি অবাক হয়ে শুধুই দেখে গেলাম। তাহলে সেতারের জাদুকর রবুদা আসলে আমাদের মতোই এক রক্তমাংসের মানুষ। সদ্য কৈশোর পেরনো আমি এই সিদ্ধান্তেই এলাম। রবুদা। হ্যাঁ পণ্ডিত রবিশঙ্কর— দাদু, বাবা, দাদা, কাকা, মামাদের মতোই একজন। তিনি অবশ্যই আমাদের স্বপ্নের শিল্পী। কিন্তু বাকিদের মতোই রসিক, রোমান্টিক, কৌতুকপ্রিয় একজন নিখাদ, ভদ্র, ভোজনপ্রিয় মানুষ। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়!

আদতে পণ্ডিতজী আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড় ছিলেন। তবে এটা অবশ্যই বলব রবুদা খুব ডিসিপ্লিন্ড মানুষ ছিলেন। শংকরের ঠিক বিপরীত। ক্রমশ সেই গল্পতে আসব। রবুদা কোনও নেশায় আসক্ত নন। শুধুমাত্র সঙ্গীত। সঙ্গীত। সঙ্গীত। আর উপযুক্ত সঙ্গী পেলে তুমুল আড্ডাবাজ। 

Ravi-Shankar
রবুদা খুব ডিসিপ্লিন্ড মানুষ ছিলেন

আশীর্বাদ শেষ। মধ্যাহ্নভোজও শেষ। খাওয়া-দাওয়া, আশীর্বাদ শেষে রবুদা, কমলাদি আমাদের বিস্তৃত, বিরাট বসার ঘরে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। রেডিওগ্রামে দাদু শোনালেন তপন সিংহের, ক্ষুধিত পাষাণ চলচ্চিত্রে উস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের গাওয়া— পিয়া কি অবনক ম্যাঁয় শুনত খবরিয়া—ঠুমরি। পরে ভীষ্মদেব ও জ্ঞান গোঁসাইয়ের নজরুলগীতি পৃথকভাবে— শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়…।

আমার বিয়ের দিন রবুদা, কমলাদি থাকবেন না। যাওয়ার সময় মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, “সুখী হও”। সঙ্গে কপট চিন্তায় গালে হাত রেখে কমলাদির দিকে তাকিয়ে রবুদা বললেন, শংকরলাল বিয়ের দিন সময়মতো আসবে তো কমলা…

সবাই হো হো করে হেসে উঠল, আমি কিছুই বুঝলাম না…

যদিও এ কথার মানে প্রতি পদে উপলব্ধি করেছি বিবাহ পরবর্তী জীবনে। 

 

(চলবে)

ছবি সৌজন্য: Britannica, লেখক
আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে এ মাসের তৃতীয় বুধবার…

Indrani Bhattacharya

বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব

Picture of ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
Picture of ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব

One Response

  1. বাহ্! অপূর্ব!! যত পড়ছি, মুগ্ধতায় ভরে যাচ্ছি। সঙ্গীত আকাশের মহামূল্য এক নক্ষত্র, পণ্ডিত রবিশঙ্কর এখন আমাদের কাছে হয়ে উঠেছেন অত্যন্ত কৌতুকপ্রিয়, খাদ্য প্রিয় এবং একেবারে মাটির মানুষ, স্রেফ লেখার গুনে। তা ছাড়াও আরো কত নাম জানা কিন্তু অদেখা বিখ্যাত মানুষ হয়ে উঠেছেন একেবারে কাছের মানুষ। খুব ভালো লাগছে পড়তে। শুধু একটাই কথা বলবো – এই পরের পর্ব পড়ার জন্য যে সুদীর্ঘ সময়, সেটাকে কি একটু কমিয়ে আনা যায় না? পরপর পড়তে পড়তে পারলে খুব ভালো হতো। আর একটা কথা – এই ন্যাশন ভাজা ব্যাপারটা কি – ঠিক বোঝা গেল না। ওটা আসলে কি? বলা যাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com