শিউলি ফুল শিউলি ফুল
কেমন ভুল এমন ভুল…
সত্যিই তো পুজোর শিউলিরা কোথায় গেল! আমি আমার সংসারের কাজের সহচরীকে বললাম, ‘‘হ্যাঁ রে অঞ্জলি, শিউলি গাছ দেখতে পাস?’’
—“হ্যাঁ গো মাসি আমাদের গেরামে পেচুর শিউলি গাছ। অ্যাত্যো পড়ে থাকে।”
—“ও মা, আমাকে এনে দিবি? আমি মালা গেঁথে খোঁপায় দেব—”
—“কালকেই আনব—”
ভোরবেলা অঞ্জলি ভরে অঞ্জলি শিউলি দিল আমায়। আমার চোখে জল এল। এ কেমন শিউলি! ঘ্রাণ নেই! রং নেই! সত্যি আজকাল কোনও ফুলেরই গন্ধ পাই না। শুধুই রং। শুধুই বাহার। কেন?
হ্যাঁ, আসলে যে কথাটা বলছিলাম, ছোটবেলার পুজো। মহালয়া থেকেই পুজোর উত্তেজনা শুরু। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হত। এখন তো দু’মাস/তিন মাস আগে থেকেই সারা শহরের বাঁশের ব্যারিকেডে নাভিশ্বাস ওঠে। সেই সময় দেখতাম অনেক প্যান্ডেলের মধ্যেই প্রতিমা গড়া হত। সেই প্রতিমা গড়া আমরা ভাইবোন, বন্ধুবান্ধবরা দল বেঁধে দেখতে যেতাম। মায়ের হুকুমমতো সময়ের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হত। ভাই হত আমাদের পাহারাদার। আমরা বোনেরা একা কোথাও যাবার অনুমতি পেতাম না। (Pujo Memories)

পুজো মানেই নতুন জামা, নতুন জুতো। নতুন পুজো সংখ্যা। পুজোর গান। এখন আর পুজোর গান বলে কিছু হয় না। সারা বছরই শিল্পীরা গান প্রকাশ করছেন। প্যান্ডেলে কিন্তু সেই পুরনো গানগুলোই সাধারণত এখনও বাজছে। আর আগমনী গান বলতে গোটা দশেক পুরাতনী সর্বক্ষণ সর্বত্র বেজে চলেছে। পুজোর আড্ডায় সেই পুরাতন “বাজলো তোমার আলোর বেণু” হারমোনিয়াম বাজিয়ে পাড়ার আধুনিকা সুপ্রীতি ঘোষ উদ্বোধন করছেন। কিছু কিছু জায়গায় আমরা এখনও সেই শৈশবেই আছি। কিন্তু আমাদের কৈশোর, যৌবনে পুজোর সময় তখনকার বিখ্যাত সব গায়ক, গায়িকাদের গানের রেকর্ড, পরবর্তীকালে ক্যাসেট, সিডি বেরতো। কী উন্মাদনা, ভিড়! দোকানে ধাক্কাধাক্কি করে সেইসব কেনা। ক্বচিৎ, কখনও রাসবিহারীর মেলোডিতে কোনও শিল্পীর সাক্ষাৎ পেয়ে গেলে তো লটারি পেয়ে গেলাম। রেকর্ড কিনে শিল্পীর Signature নিয়ে দিগ্বিজয় করে বাড়ি ফেরা। আমি তখন পাড়ার হিরো বা হিরোইন— যাই বলে।
তা যা বলছিলাম। এইসব গানবাজনার বরাবরই আমি খুব ভক্ত। সারাদিন বাড়িতে রেডিও বা player-এ গান বেজেই চলেছে।

জামাকাপড়, জুতো-মোজা, রিবন, মালা, পুজোর সম্ভার কম ছিল না। কটা জামা হচ্ছে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকত। পাঁচটা জামা হতেই হবে। Bhalla-র দোকানে গিয়ে জুতো কেনা, বাবা নিয়ে যেত। যখন থেকে স্কুলে ব্যালেরিনা পরার অনুমতি পাওয়া গেল তখন থেকেই বড় হয়ে গেলাম। কী আনন্দ! ফিতে বাঁধা জুতো ছেড়ে এবার ছোট্ট হিল দেওয়া ব্যালেরিনা পরব। উফফ্, কী ফ্যাশনেবল!
কিন্তু একটা সমস্যা ছিল। নতুন জুতো পুজোর ষষ্ঠীর আগে পায়ে দেওয়া চলবে না। মায়ের হুকুম, অমান্য করলেই গোটাকয়েক চপেটাঘাত নির্ঘাৎ। আমি খুবই নির্বিবাদী মানুষ। ওইসবের ধার দিয়েই যেতাম না। রাত্রে শোবার সময় মাথার কাছে জুতোর বাক্স। ভোরবেলা উঠেই সবার চোখের আড়ালে পায়ে জুতো গলিয়ে বিছানায় কয়েক পাক। আবার জুতো বাক্সবন্দি এবং যথাস্থানে স্থানান্তর।
আর ওই যে বললাম, পাঁচটা জামা হতেই হবে। বাবা, মা, মাসিমা, দাদু—চারটে হল, আরও একটা তো লাগবে। ফোনে কাকা, পিসি, জ্যাঠা কেমন আছে খোঁজ করা শুরু। ব্যাস আমার কার্যসিদ্ধি। আরও দুটো জামা এসে গেল। এখন ভাবলে হাসি পায়। সত্যি কী সরল, নির্ভেজাল জীবন ছিল আমাদের। খুব শাসন ছিল। কিন্তু বড়দের ভালবাসা, প্রশ্রয় তাতে অবিরত পেয়েছি। কী যে আনন্দে বড় হয়েছি। এখন এত স্বাধীনতা। কিন্তু কোথায় সেই অনাবিল, নির্ভেজাল আনন্দ!!

আমাদের ছোটবেলায় পুজোর থিমের এত রমরমা ছিল না। প্যান্ডেলের ঘনঘটা, তাও ছিল না। বাঁশের বাড়াবাড়ি নৈব নৈব চ। গাড়ি করে সোজা প্যান্ডেলের সামনে নেমে প্রতিমা দর্শন। আর কখনও-সখনও উপরি পাওনা মায়ের প্রসাদ বা ভোগ। আহা! তখন পায় কে আমাদের। আমরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্স তখন ঘন ঘন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাচ্ছি মা’কে। এখন তো ঠাকুর দর্শন করতে গেলে দূর দূর হেঁটে মায়ের দর্শন পেতে হয়। ভিভিআইপি কার্ড না থাকলে Bus no 11-ই একমাত্র ভরসা।
আমরা তো সাধারণত রাত্রিবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। উত্তর কলকাতায় যখন যেতাম দেখতাম বড় বড় কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। দুধের ওপর মোটা সরের আস্তরণ। আমি বরাবরই মিল্ক প্রডাক্টের দারুণ ভক্ত। মেসোমশাই হাঁক মেরে ঠাট্টা করে বলত—“দাঁড়াও, দাঁড়াও গৌরীর জন্য এক জামবাটি গরম দুধ আনো।” যত রাতই হোক আমি একগ্লাস দুধ খাবই। বাকি মাস্কেটিয়ার্সরা জিলিপি, সিঙারা, পান্তোয়া, রসগোল্লা— যার যা খুশি খাচ্ছে। মা, মাসি তারাও পছন্দের স্বাদ নিচ্ছে। আমি কিন্তু ওই এক গ্লাস দুধ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি। এখন বহুদিন আর যাই না। ওইরকম কড়াভর্তি গরম দুধ ময়রারা মাঝরাতে জ্বাল দেয় কিনা জানি না।

সাত ভাইবোন সারাদিন প্যান্ডেলেই কাটাতাম পুজোর কটা দিন। অষ্টমীর দিন সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে দামি জামাটা পরতাম। সঙ্গে দু’দিনের পুরনো নতুন জুতো। ফোস্কা থেকে রেহাই পেতে পায়ে ব্যান্ড-এড। বিজয়ার দিন সকালে সব গুরুজনদের ঘটা করে প্রণাম করা। ভাই-বোনেদের কান মুলে প্রণাম নেওয়া। মা মাসিদের বানানো নারকেল, ক্ষীরের সন্দেশ ছাঁচে ফেলা, কী সুন্দর কর্পূরের গন্ধ দেওয়া! বোঁদের লাড্ডু। রসের জিলিপি। আর মায়ের হাতের তিলের তক্তি। নারকেল নাড়ু। মেসোমশাইয়ের দেশের বাড়ি রাণাঘাটের রসবড়া। বাবার আনা বহরমপুরের কালোজাম আর তিলেখাজা। প্রণাম সেরেই হই হই করে খাওয়া, সঙ্গে তিনকোণা নিমকি। সন্ধেবেলা রাসিবহারীর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সার সার প্রতিমার বিসর্জন যাত্রা দেখা।
এরপর পাড়ার গুরুজনদের প্রণাম পর্ব। সেখানেও কতরকম মিষ্টান্নর আয়োজন। কী যে আনন্দ! অনাবিল, নির্ভেজাল শৈশব, কৈশোর। আমৃত্যু এই আস্বাদ নিয়েই বেঁচে থাকা। এখন সব কিছুই বদলেছে। তাতে ভাল, মন্দ সবই আছে। গত পাঁচ বছরে বয়সটা মনে হয় অনেকটাই বেড়ে গেছে। কারণ মন খারাপটাও অনেক বেড়ে গেছে। বয়স যত বাড়ে ততই বোধহয় ছোটবেলার স্মৃতি খুব বেশি করে মনে পড়ে। এইভাবেই কেটে যাচ্ছে।
(চলবে)
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
3 Responses
বাহ! আবারও একটা নতুন এপিসোড এলো, নতুন কথা জানলাম। লেখার গুনে প্রায় সবই আমার নিজের কথা, নিজের অভিজ্ঞতা বলেই মনে হলো!
আরো লিখুন আপনি, আরো এরকম স্মৃতি কথায়, নিজের স্মৃতি মেদুরতায় ভাসি আবার!
বাহ! আবারও একটা নতুন এপিসোড এলো, নতুন কথা জানলাম। লেখার গুনে প্রায় সবই আমার নিজের কথা, নিজের অভিজ্ঞতা বলেই মনে হলো!
আরো লিখুন আপনি, আরো এরকম স্মৃতি কথায়, নিজের স্মৃতি মেদুরতায় ভাসি আবার!
বাহ! আবারও একটা নতুন এপিসোড এলো, নতুন কথা জানলাম। লেখার গুনে প্রায় সবই আমার নিজের কথা, নিজের অভিজ্ঞতা বলেই মনে হলো! এরকম
আরো লিখুন আপনি, আরো এরকম স্মৃতি কথায়, নিজের স্মৃতি মেদুরতায় ভাসি আবার!