আমার কথা লিখতে বসে আমি বেশ বিব্রত বোধ করছি। কী মুশকিল! রবুদার মানে পণ্ডিত রবিশঙ্করজীর (Pt Ravi Shankar) বাইরে বেরোতেই পারছি না। আসলে আমার জীবনের একটা বিশেষ সময় জুড়ে উনি বিস্তৃত আছেন। সেই মূল্যবান উপস্থিতি আমি সারা জীবন ধরে সযত্নে লালন করে আসছি। প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে এত দামি, এত মূল্যবান যে এখনও ঝকঝক করছে সেইসব স্মৃতি। হয়ে গেছে প্রায় ৪৪-৪৫ বছর, কিন্তু এখনও তো ম্লান হওয়া দূরস্থান, প্রতিদিন আরও সজীব হয়ে সেগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। কী অমূল্য সম্পদে পরিপূর্ণ আমার জীবন। ঈশ্বরকে প্রণাম, কৃতজ্ঞতা জানাই আমাকে এইরকম একটি যাত্রাতে সামিল করেছেন।
আমি যে পরিবারে জন্মেছি, যাদের সান্নিধ্য ঘরে-বাইরে পেয়েছি, যে শিক্ষা, সংস্কৃতি অবলীলায় আত্মস্থ করেছি, সেও তো সাধারণ নয়। তখন তো বুঝিনি যে কত blessed আমি। এখন প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পদে তার উপলব্ধি হয়। এমনকী তখনকার আর এখনকার সামাজিক অবস্থানের বিপুল তারতম্য— তাও তো পীড়া দেয়। একমাত্র অতীতের মণিমুক্তোখচিত স্মৃতিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, সজীব রাখে। পরমহংসদেবের বাণী মনে রাখি— ‘জলে থাকবি পাঁকাল মাছের মত।’ সমস্ত গ্লানি, দুঃখ, কষ্ট— সে তো জাগতিক জীবনে আছে, থাকবেই। কিন্তু তোমাকে তা ঝেড়ে ফেলে শুধু সুখটাই স্মরণে রাখতে হবে।

এসব থাক্। এবার আসল কথায় আসি।
বিয়ের পর পর আমি আর শংকর একটা হানিমুন ট্রিপ করি শিলং-এ। সে এক মধুচন্দ্রিমা বটে! ক্রমশ নবকর্তাকে চিনছি, আর চমকিত হচ্ছি। সেসব বলব পরে কোনও এক পর্বে। এখন আসি দার্জিলিং ট্রিপে।
রবুদার (Pt Ravi Shankar) সঙ্গে রাগ-অনুরাগ—পণ্ডিতজীর জীবনী অনুলেখনের কাজ তখনও চলছে। শংকর কাজটা একবছর আগে থেকেই রবুদার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা, দেশ ঘুরে করছে। এবার ঠিক হল দার্জিলিং যাওয়া হবে। শংকর, রবুদা, কমলাদি, সঙ্গে আমি। যথারীতি আমি খুবই রোমাঞ্চিত। দার্জিলিং, তার সঙ্গে রবুদা। ভাবা যায় না।

নির্ধারিত দিনে রওনা দিলাম দার্জিলিং-এর পথে। আমার বড় প্রিয় এই পাহাড়। মার্চ মাসের কোনও একদিন, তারিখটা ঠিক মনে নেই, রবুদা, কমলাদি এলেন লালা শ্রীধরের বাড়ি থেকে আর আমরা তখন থাকতাম সতীশ মুখার্জি রোডের একটা ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। কী খুশি রবুদা। আনন্দে একদম ঝলমল করছেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হতেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘দার্জিলিং বললেই ছোটবেলা মনে পড়ে যায়। জানো শঙ্কর এই পাহাড় আমাকে নস্টালজিক করে দেয়। আলমোড়া মনে পড়ে যায়। দাদার ট্রুপে নাচতাম। আরও কত কত স্মৃতি গো। দাদার ওই শিবতুল্য চেহারা, ভঙ্গিমা। আমি তখন ছোট্ট রবি। কী সব সুখের দিন সেসব…!
রবুদা, কমলাদির সঙ্গে এসেছেন ভুদেবদা, ভুটানদা (রবীন পাল, রবুদার কলকাতার সেক্রেটারি)। ওঁরা আমাদের সি-অফ করে চলে গেলেন। কলকাতা তখন বেশ গরম। কিন্তু আমরা সবাই ভালো মতো শীতবস্ত্র নিয়েছি।
কী খুশি রবুদা। আনন্দে একদম ঝলমল করছেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হতেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘দার্জিলিং বললেই ছোটবেলা মনে পড়ে যায়। জানো শঙ্কর এই পাহাড় আমাকে নস্টালজিক করে দেয়।’
কমলাদিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। লম্বা, ঝাড়া, ঋজু চেহারা। রবুদার চেয়ে বেশ অনেকটাই লম্বা। লম্বা, কোঁকড়া চুলের বেণী। শ্যামলা রং, কিন্তু ভারী মোহিনী উপস্থিতি। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন— “ইন্দ্রাণী ভারী ভালো হল। তুমি এলে, আমরা দু’জন বেড়াব, গল্প করব, সময় কাটাব। ওরা কাজ করুক।” আমি তো অচেনা মানুষের সাক্ষাতে বেশি কথা বলি না। চুপচাপ শুনছি। এখনও তো সেইরকম পরিচিতি হয়নি। মৃদু হেসে সম্মতি জানালাম।
কমলাদি বলে চলেছেন, “কত পাহাড় দেখলাম। এই দার্জিলিংটাই দেখা হয়নি।” আমি কমলাদির দুঃখে সত্যি দুঃখিত হলাম। যদিও তখনও ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারিনি উনি আসলে কে! আমি যতদূর জানি অন্নপূর্ণা শংকর রবুদার স্ত্রী… ইনি কী তিনি? তাহলে বোধহয় ডাকনাম কমলা!

জাগতিক বিষয়-আশয় নিয়ে আমার মাথাব্যথা বরাবরই কম। পড়াশোনা, গান, গাছপালা, পশুপাখি, চারপাশের প্রকৃতিই আমার প্রিয়। ওদেরকেই আত্মার কাছাকাছি রাখি সবসময়। প্লেনে উঠব। Air India-র Dakota বিমান। তখন এটাই একমাত্র flight to Bagdogra ছিল। সেখান থেকে by road দার্জিলিং। প্লেনে উঠে আমি আমার চারপাশের অন্যান্য যাত্রীদের নিয়ে মনে মনে আলোচনা শুরু করলাম। মানুষ স্টাডি করতে আমি খুব ভালবাসি। বরাবরই। এখনও। সামনের সিটে রবুদা, কমলাদি। প্লেন ছাড়ল। রবুদা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদের তিনজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন।
হ্যাঁ, আর একটা জিনিস বিস্ময়ের সঙ্গে নজর করলাম। রবুদার সেতারের জন্য একটা সিট রিজার্ভ করা আছে। সেখানে সেতার বসে আছে।
রবুদার কথার সঙ্গে সঙ্গে আমার মানসভ্রমণ শুরু হল। আমেরিকা, ইউরোপ, তুরস্ক, ব্রাজিল, স্পেন, জাপান, সুইটজারল্যান্ড… কী সুন্দরভাবে বর্ণনা করছেন রবুদা। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, ভ্রমণ করছি, স্পর্শ করছি এইসব দেশ-বিদেশের বিস্ময়কর সমস্ত দর্শনীয় স্থান, প্রকৃতি, মানুষজন। পরে অবশ্য শংকরের সঙ্গে পৃথিবীর অনেক দেশ বেরিয়েছি, থেকেছি, অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু রবুদার বর্ণনার সেই চিত্রকল্পে একজন সদ্য যুবতী হওয়া পর্যটকের মানসভ্রমণের অনুভূতি এখনও অমলীন।

খুব সুন্দর জমিয়ে গল্প করতে পারতেন রবুদা। একদম সেতারের আলাপের মতো মনের গভীরে গেঁথে যেত। বারবার আলমোড়া, দাদা উদয়শঙ্করের কথা, বউদি অমলাশঙ্করের স্মৃতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলতেন। সেইসময় একদম বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে যেতেন। বিমানযাত্রা শেষ। রবুদা, কমলাদি চটপট সবকিছু গুছিয়ে নিলেন। আমরাও রেডি। সেতারকে খুব সন্তর্পণে হাতে তুলে রবুদা এগিয়ে গেলেন। বাকি যারা যাত্রী ছিল, এয়ারহোস্টেসরা, বিমানের পাইলট, অন্য crew সবাই এসে রবুদাকে নমস্কার জানাল। আমরা সবার আগে গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে পুরো হতবাক। ও বাবা! কত লোক! কেন? হঠাৎ দেখলাম শ’য়ে শ’য়ে ফুলের তোড়া আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। সব্বাই এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রবুদার ওপর। ছবি তুলবে। সঙ্গে বড় বড় ক্যামেরা। তখন তো মোবাইল ছিল না। মোবাইল ক্যামেরাও ছিল না। কত যে খাতা হাতে, ডায়েরি হাতে অটোগ্রাফের দাবিদার! নানান বয়সী, নানান সাজের পুরুষ, মহিলারা ঠেলাঠেলি করছে। একবার রবুদাকে ছুঁয়ে দেখবে। আমি রীতিমতো ঘাবড়ে সেই ঠান্ডাতেও তখন ঘামতে শুরু করেছি। কমলাদির হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছি। শঙ্কর এয়ারপোর্ট সিকিওরিটির সঙ্গে ভিড় সামলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রবুদা বিভ্রান্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কাউকে খুঁজছেন।
কমলাদি নরম হেসে বললেন “এরকম সবসময়ই হয় ইন্দ্রাণী, ভয় পেও না…” মনে মনে ভাবলাম, সবাই জানল কী করে?
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে আগামী মাসের তৃতীয় বুধবার…
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
2 Responses
Opurbo…ato jeebonto monograhi bornona..jano Panditji r byaktitwo pathoker samne phute uthechhe.
আপনার এই স্মৃতি – কথন মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ছি আর ভালোলাগায় একেবারে মরে যাচ্ছি। তাছাড়া ওই নমস্য মানুষদের আপনার লেখার মাধ্যমে একেবারে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
আরো লিখুন ম্যাডাম, আরো অনেক কিছু জানতে হবে আমায় এবং আমাদের।