প্রথম ছবি থেকেই স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, আদিল হুসেনের মতো তারকা তাঁর ছবিতে। এই স্বপ্নই কি ছোট থেকে দেখে এসেছেন পরিচালক অর্জুন দত্ত? দিদার সঙ্গে লুকিয়ে হিন্দি ছবি দেখতেন, কেন? নিজেই দাবি করেন, রক্তে পরিচালনা নিয়ে জন্মেছেন। সত্যি? কিসের জোরে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের হিট ছবির পাশাপাশি তাঁর পরিচালনা প্রশংসিত? এখনকার বাংলা ছবির জগৎ নিয়ে কী চিন্তাভাবনা তাঁর? এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বাংলা লাইভের কাছে অকপট নব্য পরিচালক। মুখোমুখি বিয়াস মুখোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: ২৩ জানুয়ারি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ মুক্তি পেয়েছে। ৩১ জানুয়ারি ‘অব্যক্ত’। দর্শক, সমালোচকদের এত প্রশংসা পাবেন ভেবেছিলেন?
উত্তর: একেবারেই না। বরং বেশ ভয়েই ছিলাম। দর্শক নেবে তো! রিলিজের দিন ছবি শেষ হতেই স্ট্যান্ডিং ওবেশন দিলেন ছবি দেখতে আসা ২০০ দর্শক। তখনই বুঝলাম, পাস করে গেছি।
প্রশ্ন: কিসের জোরে ৩৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, নিজের শহরেও এত ভালোবাসা পেল অব্যক্ত?
উত্তর: মা-ছেলের সম্পর্কের জোরে। এই সম্পর্ক চিরকালীন। এর আবেদন জন্ম-জন্মান্তরের। সেই জায়গা ছুঁয়েছি। সহজ কথা সহজ করে বলার চেষ্টা করেছি। দর্শকদের সেই জন্যেই হয়ত ছবিটি ভালো লেগেছে। আরও একটি প্লাস পয়েন্ট, আমার ছবির গল্প আমি নিজেই লিখি। সংলাপ, চিত্রনাট্য সমস্তটাই আমার তৈরি।
প্রশ্ন: সমান্তরালভাবে দেখিয়েছেন আরও একটি স্পর্শকাতর বিষয়, সমকামিতা। ঘনিষ্ঠ দৃশ্য ছাড়াই…
উত্তর: মা-ছেলের সম্পর্ক যেমন স্বাভাবিক, সমকামিতাও তাই। রোজের ডাল-ভাতের মতোই। একুশে এসে তাকে কেন বিশেষ দৃশ্যের মাধ্যমে বোঝাতে হবে! খুব সাধারণ, স্বাভাবিক ভাবে দেখানো বা বলাটাই তো পরিচালকের মুন্সিয়ানা! আমি মানুষের সমস্ত সম্পর্ককে ভীষণ শ্রদ্ধার চোখে দেখি। তাদের ভীষণ স্বাভাবিকভাবে দেখাতে পছন্দ করি।
প্রশ্ন: ছোট থেকে এই সাফল্যের স্বপ্নই তো দেখতেন?
উত্তর: (হেসে ফেলে) একদম ঠিক। ছোট থেকেই মাথায় সিনেপোকা। অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চে পড়তে পড়তেই হিন্দি ছবি ভীষণ টানত। দিদার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেও যেতাম। আর মনে মনে বলতাম, বড় হয়ে পারিবারিক ব্যবসা নয়, ছবির দুনিয়ায় আসব। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে অনার্স। স্যোসিওলজিতে মাস্টার্স প্রেসিডেন্সি থেকে। কলেজে পড়তে পড়তে দুটো শর্ট ফিল্ম বানাই। একটা বাংলা একটা ইংরেজিতে। সেই শুরু। তারপর পড়ার পাট চুকিয়ে নিজের গল্প নিয়ে তৈরি করি ‘অব্যক্ত’। বরাবর বিশ্বাস করতাম, এখনও করি, ছবি করতে গেলে আলাদা পড়াশোনার দরকার নেই। ওটা ভেতর থেকে আসে। এবং আমি ভীষণভাবে হাতেকলমে কাজ শেখায় বিশ্বাসী।
প্রশ্ন: প্রথম ছবিতেই আদিল হুসেন, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের মত অভিনেতা। এর রহস্য কী?

উত্তর: (আবার হাসি) ভাগ্যবান আমি। আমার গল্প অর্পিতাদির পছন্দ হয়েছে। মায়ের চরিত্রে আমি এমন একজন অভিনেত্রীকে চেয়েছিলাম যিনি ৩০ আর ৫০— এই দুটো বয়সকেই ক্যারি করতে পারবেন। অর্পিতাদি রাজি হওয়ায় আমার ভীষণ সুবিধে হয়েছে। আদিল হুসেনের মতো অভিনেতাও গল্প পড়ে এককথায় রাজি হয়ে যান। তার ফলাফল আমার ওপর দর্শকদের আশীর্বাদ। শেষ কথা তো জনতা জনার্দনই বলে। তবে আমার প্রথম ছবি কিন্তু শ্রীমতী হওয়ার কথা ছিল। অব্যক্ত নয়। কিছু বিশেষ কারণে ওটা আমার তৃতীয় ছবি হিসেবে মুক্তি পাবে। প্রথমে মুক্তি পায় অব্যক্ত।
প্রশ্ন: দ্বিতীয় ছবি ‘গুলদস্তা’র শুট শেষ। সেখানেও কি সম্পর্কের কথাই বলবেন?
উত্তর: আমি ভীষণ স্পর্শকাতর। মানুষ, সম্পর্কের নানা স্তর আমায় টানে। আমি খুঁটিয়ে মানুষ দেখি। হাঁটা-চলা-কথা বলা, স-ব। যেচে আলাপ করি। কথা বলি। তাদেরকেই ফুটিয়ে তুলি ছবিতে। দ্বিতীয় ছবি গুলদস্তা দর্শকদের উপহার দেবে তিন নারীকে। যাঁরা খুব চেনা। তাঁদের জীবনের গল্প আমাদের জানা। এই তিন নারীর ভূমিকায় থাকবেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। গল্প অনুযায়ী ছবিতে অর্পিতা ‘শ্রীরূপা’। ঘরে-বরে যিনি ঘোরতর সংসারী এবং আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণা। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা এই জন্যেই, সব থেকেও কী যেন নেই-এর তাড়নায় সারাক্ষণ ভোগেন শ্রীরূপা। কী সেই অভাব সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। ছবির দ্বিতীয় ফুল রেণু। সংসারে সমর্পিত প্রাণ। ভীষণই সাদামাঠা। চট করে রা কাড়েন না। সংসার রয়েছে তাঁরও। রয়েছে ছেলেকে নিয়ে সমস্যাও। কিন্তু সেই সমস্যা দর্শক দেখবেন পর্দায়। ছবির তৃতীয় ফুল ডলি। যিনি মাড়োয়াড়ি সেলস উওম্যান। ভিন্নভাষী এই মহিলা ভীষণ পরিশ্রমী। কাজ ছাড়া যিনি দুনিয়া চেনেন না। এই চরিত্রই ফুটিয়ে তুলবেন স্বস্তিকা। ছবি মুক্তি পাচ্ছে ২৪ এপ্রিল।
প্রশ্ন: ‘গুলদস্তা’ আর ‘শ্রীমতী’—পরপর দুটি ছবিতে কাজ স্বস্তিকার সঙ্গে। মানুষ হিসেবে কেমন তিনি? খুব বিতর্কিত?
উত্তর: একদমই না। ভীষণ গুজব ওঁকে ঘিরে। এত ভালো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আমার মত নতুন পরিচালকের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে, গুছিয়ে কাজ করেছেন। এটাই সবথেকে বড় পাওনা। উনি আমার কমফোর্ট জোন।
প্রশ্ন: ‘শ্রীমতী’ কি স্বস্তিকার মতোই?

উত্তর: (হাসি)কিছুটা অগোছালো, খানিকটা এলোমেলো মনের উচ্চবিত্ত পরিবারের বউ শ্রীমতী। পাগলের মতো ভালোবাসে স্বামী অনিন্দ্য, সংসার, সন্তান কুট্টুশকে। সরল মনের শ্রী বাইরের দুনিয়ার চাকচিক্যের মোহে একসময় প্রায় হারাতে বসে নিজের পরিচয়। সেই সময় তাঁকে আগলাতে পাশে এসে দাঁড়ান পরিবারের সবাই। শ্রীমতীর এই সমস্যা এখন ঘরে ঘরে আর তা নিয়েই আসছে আমার তৃতীয় ছবি।
প্রশ্ন: পরিচালক কোনওদিন অভিনেতা হবেন? ভবিষ্যতে আর কী কী করার ইচ্ছে আছে?
উত্তর: কোনওদিন অভিনয়ে আসব না। কারণ, আমার রক্তে পরিচালনা। তবে সিনেমার অন্য শাখা, ওয়েব সিরিজ, শর্ট ফিল্ম, টেলি ফিল্ম নিশ্চয়ই করব। গুলদস্তার শুট করতে করতেই আমায় ওয়েব সিরিজ বানানোর অফার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আপাতত আমি পরের দুটো ছবি নিয়ে ব্যস্ত। ফলে অন্য কোনওদিকে মন দিচ্ছি না।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বাংলা সিনে ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা কেমন?
উত্তর: খুব ভালো। নতুন পরিচালকেরা আসছেন। বিষয় নির্ভর ছবি হচ্ছে। টিপিক্যাল মারদাঙ্গা, মশালা বা লাভ স্টোরি দেখতে চাইছে না আর দর্শক। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও প্রাণ খুলে তাই অভিনয় করতে পারছেন। আর্ট বা কর্মাশিয়াল নয়, ভালো ছবি দেখতে চাইছে দর্শক। বাংলা ছবির বিষয় আর দর্শক—দুজনেই সাবালক হয়েছে। এটা ভালো লক্ষণ।
প্রশ্ন: সেই জন্যেই কি নতুন পরিচালকদের সঙ্গেও নামী অভিনেতারা কাজ করছেন চুটিয়ে?
উত্তর: একদম। অভিনয়ের খিদে সবার মধ্যে। ভালো চরিত্র পেতে সবাই চান। গাছের ডাল ধরে নাচাগানার দিন শেষ। এখন আর তাই কেউ নায়ক-নায়িকা নন, সকলেই অভিনেতা।
প্রশ্ন: এখনকার কোন কোন পরিচালককে অনুসরণের ইচ্ছে জাগে? আগামী দিনে কোন কোন অভিনেতাদের কাস্ট করতে চান?
উত্তর: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় থেকে নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায়—সকলেই আমার শ্রদ্ধেয়। সবার থেকে কিছু না কিছু শিখছি। খুব ইচ্ছে রয়েছে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, যীশু সেনগুপ্ত, পাওলি দামের সঙ্গে কাজ করার। যদিও সবটাই ভবিষ্যত বলবে।
একযুগ সাংবাদিকতায় কাটিয়েছেন। কলম তাঁর হাতিয়ার। বই তাঁর বন্ধু। তাই সাদা পাতায় কলমের আঁচড় কেটে মনের কথা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন মুখে না বলে। ভালো লাগে গান, আবৃত্তি-সহ সমস্ত শিল্পকলা। বোধহয় নিজে ষোলকলায় পূর্ণ নন বলেই...।