Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মুখোমুখি দেবজ্যোতি দত্ত: পর্ব ৬

বাংলালাইভ

মে ২৪, ২০২৩

Interview with Debojyoti Dutta part 6
Interview with Debojyoti Dutta part 6
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বিটি রোডের পাশে ঐতিহ‍্যবাহী বেলঘরিয়ার সরস্বতী প্রেস। কলকাতা তো বটেই, সারা ভারতবর্ষে এই প্রেসের সুখ‍্যাতি রয়েছে। ১৯২৩ সালে ‘যুগান্তর’ দলের কর্ণধার প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর পরামর্শে ত‍ৎকালীন দুই বিখ‍্যাত কংগ্রেস নেতা অরুণচন্দ্র গুহ এবং মনোরঞ্জন গুপ্তকে সঙ্গী করে মহেন্দ্রনাথ দত্ত ২৬/২ বেনিয়াটোলা লেনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সরস্বতী প্রেস। পরবর্তীকালে সাহিত‍্য সংসদ এবং শিশু সাহিত‍্য সংসদও তৈরি করেন এই মহেন্দ্রনাথ দত্ত-ই। বেনিয়াটোলা লেনে সরস্বতী প্রেসের শুরুটা হলেও নানা কারণে পরের বছর থেকে তা স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। পরাধীন ভারতে মূলত জাতীয়তাবাদী সাহিত‍্যকে প্রচারের আলোতে নিয়ে আসাই ছিল এই প্রেস তৈরির নেপথ‍্য কারণ। ফলে এই প্রেসের প্রতিটি ইঁটের খাঁজে লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস। ১৯৭৫ সাল থেকে সরস্বতী প্রেসের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের সুযোগ‍্য পুত্র এবং সাহিত্য সংসদের কর্ণধার দেবজ‍্যোতি দত্ত। শতাব্দী প্রাচীন এই প্রেসের নেপথ‍্যের নানান গল্প নিয়ে বাংলালাইভের মুখোমুখি হলেন তিনি। প্রতি বুধবার ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি পর্বে প্রকাশিত হবে দেবজ‍্যোতি দত্তের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি। কথোপকথনে দেবজ্যোতি দত্ত এবং শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়…

আজ ষষ্ঠ পর্ব।

পঞ্চম পর্বে সরস্বতী প্রেসের উত্থান, প্রাইভেট লিমিটেড হয়ে ওঠা, ফরোয়ার্ড প্রেস অধিগ্রহণ এবং তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে এই সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ নিয়ে আলোচনাপ্রসঙ্গে…

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: প্রজ্ঞানানন্দ পাঠগৃহ তো এখন মৌলালিতে চলে গেছে।

দেবজ্যোতি দত্ত: সে অনেক পরে, বাড়ি হয়ে চলে গেছে।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: আপনার বাবারা করেছিলেন।

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই বাড়িটা করেছিলেন।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: আমাদের ছাত্রাবস্থায়, মানে ১৯৯০-এর দশকে ওটা খুব নির্ভরযোগ্য পাঠাগার ছিল।

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ, ভালো চলে। ওই প্রজ্ঞানানন্দ পাঠগৃহ কিরণ মুখার্জির তৈরি। সরস্বতী লাইব্রেরি থেকে অনেক বই বেরোয়। তার একটি বই ছিল ‘বিপ্লবের পদচিহ্ন’। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের লেখা। তাঁর জেল-জীবনের কথা সমস্ত সেখানে উনি লিখে গেছেন, রাজনীতিতে করাপশনের ঘুণ কিন্তু তখনই ধরেছে।

Bhupendra Kumar Dutta
ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, ধীরে ধীরে আমাদের পলিটিক্সের ডাইমেনশনটাও পালটে গেল। যাইহোক, ৩২ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে কীভাবে সরস্বতী প্রেসের কাজ চলতে লাগল?

দেবজ্যোতি দত্ত: বিধান রায়ের প্রস্তাবে অরুণ গুহ আর বাবা তখন ফরোয়ার্ড প্রেস কিনবেন ঠিক হল। বিধান রায় ফরোয়ার্ড পত্রিকাটাও চালু করতে বললেন। তখন, ১৯৩৯ সালে পুজোর সময়ে, ১ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট থেকে প্রেসটা ৩২ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত হল। সেই সময় থেকে কাজ অনেক বেড়ে গেল, কিন্তু টাকার ঘাটতি হল। তখন ঠিক করা হল শেয়ার বিক্রি করে প্রেসটা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করে দেওয়া হবে। তখন বোধহয় আড়াই লাখ টাকা অথরাইজড ক্যাপিটাল ধরা হয়েছিল। তখন অনেকেই বলেছিল এত টাকা পাওয়া যাবে কোথায়! ১৯৩৯ সালে আড়াই লাখ টাকা তো কম ছিল না।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: যুদ্ধের সময়ে।

দেবজ্যোতি দত্ত: যুদ্ধ লাগবে-লাগবে করছে, ওই সময়ে। বাবার সঙ্গে পরিচয় ছিল বরিশালের আই. বি. গুপ্ত— ইন্দুভূষণ গুপ্ত বলে একজনের। তিনি বাবার পাশা খেলার সঙ্গী ছিলেন। তিনি ছিলেন বরিশালের জমিদার। আগেকার দিনে ছিল না, দু-আনার জমিদার, চার-আনার জমিদার সেরকম একজন জমিদার।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: অংশীদারিত্ব আর কি!

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ, জমিদারির অংশীদারিত্ব। সেই সময়ে, ৩৯ সালে ইন্দুভূষণ গুপ্ত ৬০ হাজার টাকার শেয়ার কিনে নিলেন। ভাবতে পারো? ৬০ হাজার টাকার শেয়ার ৩৯ সালে…

32 APC Road
৩২ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত হল প্রেস

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: উনি নিজে নিলেন?

দেবজ্যোতি দত্ত: উনি বাবার এত বন্ধু ছিলেন যে বাবাকে বললেন, আপনি যখন দায়িত্বটা নিয়েছেন, এই টাকাটা রাখুন। তাতে করে প্রেসের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালে যে খামতিটা ছিল সেটা অনেকখানি মিটল। তারপর যুদ্ধ লেগে গেল। যুদ্ধের সময়ে প্রথমেই সরকারি কাজ আসতে লাগল। যদিও তাতে বাবা একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সরকারি কাজ নেব কি নেব না।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: যে আদর্শে সরস্বতী প্রেস তৈরি হয়েছিল…

দেবজ্যোতি দত্ত: সে আদর্শের সঙ্গে তো এটা ঠিক যায় না। তখন বাবা গুরুদেব প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীকে স্মরণ করলেন। গুরুদেব আদেশ দিলেন প্রেসটাকে যদি বড় করতে হয় তবে এই কাজটা ধরতে হবে। সেই শুরু হল। প্রেস আস্তে আস্তে ভীষণভাবে বড় হতে লাগল। জায়গার সঙ্কুলান হচ্ছিল না ৩২ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে। তারপর যুদ্ধ এল। ৪৩-৪৪ সালে, বাবা এক জায়গায় লিখছেন, হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় বলে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ইনিই পরবর্তীকালে কি রাজ্যপাল হয়েছিলেন ?

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ। ওটা হচ্ছে ’৪৩-’৪৪ সালের কথা। বাবা খুব মজা করে লিখেছিলেন। একদিন বাবা বসে আছেন প্রেসে। এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘আমাকে একটু তামাক এনে দিতে পারেন? আপনার কাছে তো লোকজনের অভাব নেই, আমাকে যদি একটু তামাক এনে দেন, আমি একটু তামাক সেবন করি, আমার খুব সুবিধে হয়। না হলে আবার আমাকে বুড়ো বয়সে দৌড়োদৌড়ি করে…। ভদ্রলোককে বাবা ঠিক চিনতে পারছেন না। তখন উনি নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন “আমি হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়। আমি অবসর নিয়েছি। কলেজ ইন্সপেক্টর ছিলাম। তার আগে আমি অধ্যাপনার কাজ করতাম। রাজশাহি কলেজে পড়িয়েছি, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়িয়েছি। এখন আমি রিটায়ার করে অন্য কাজ করছি।” তখন বাবা তামাক এনে দিলেন এবং তাঁকে গাড়ি করে এক জায়গায় পাঠিয়েও দিলেন। তিনি থাকতেন পার্কসার্কাসের ডিহি শ্রীরামপুরে। এরপর উনি মাঝে মাঝেই আসতেন। সন্ধেবেলায় সরস্বতী প্রেসে একটি আড্ডা হত। সেই আড্ডায় উনি যোগ দিতেন। বাবা একদিন হরেন্দ্রকুমারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি অবসর নেওয়ার পর কী করেন?” উনি বলেন, “অবসর নেওয়ার পর আমি শেয়ার মার্কেট করি আর তামাক খাই। আমার একটা অফিস আছে, কুমিল্লার ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের শান্তিভূষণ দত্তের অফিসের পাশেই আমার ঘর। সপ্তাহে একদিন আমি ওখানে যাই, শেয়ার ব্রোকাররা আসেন। আমি শেয়ারগুলো ডেলিভারি করি। তাদের বলি, এগুলো কেনো, এগুলো বিক্রি কর। যদি লাভ হয়, সেই লাভটা আমাকে দেয় তারা। আর যদি ক্ষতি হয় আমি তাদের দিয়ে দিই।”

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: শেয়ার কনসালটেন্ট!

দেবজ্যোতি দত্ত: এই লাভের টাকাটাই উনি কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। এভাবে চলতে চলতে বাবা ওঁর কাছ থেকে শেয়ার মার্কেট করা শিখে গিয়েছিলেন। বাবা শেয়ারে লগ্নি করতেন, অনেক বেশি করে করতেন। ১৯৪৬-এর অগস্টের প্রথম দিকে উনি বলেছিলেন, “মহেন্দ্রবাবু, আপনি তো শেয়ার মার্কেট করেন। একটু সাবধানে করবেন।” কিন্তু বাবা বুঝতে পারেননি। ১৬ /১৭/ ১৮ তিনদিন পরপর শেয়ার বাজারে মারাত্মক ধস নামে। যে শেয়ারের দাম ১০০ টাকা ছিল, ৩০-এর নীচে নেমে গেল। ওই সময়ে বাবা কয়েকদিনে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং!

দেবজ্যোতি দত্ত: ভাবলে খুব আশ্চর্য লাগে, ওই সময়ে তাঁর ৮০ হাজার টাকার ওপর ক্ষতি হয়।

Harendra Kumar Mukherjee
হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: দেবজ্যোতিদা, এবার আমরা একটু অন্য বিষয়ে যেতে চাইব। সরস্বতী প্রেস ক্রমশ বড় হচ্ছে এবং জায়গারও অভাব হচ্ছে। সেসময় সরস্বতী প্রেসের জন্য একটা দ্বিতীয় জায়গা ভাবা হচ্ছিল নিশ্চয়ই, যেটা  পরবর্তীকালে বেলঘরিয়াতে হল।

দেবজ্যোতি দত্ত: সে তো অনেক পরে। ১৯৫২ সালের পরে।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ১৯৫২ সালের পরে, মানে বেলঘরিয়ার যে ইউনিটটা?

দেবজ্যোতি দত্ত: এই যে ৩৯ সাল থেকে ৫৫ সাল অবধি প্রেস কিন্তু শিয়ালদাতেই বড় হল।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ৩২ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে?

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ, এবং এটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। দেশভাগের ব্যাপারে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে এই বাড়িটার সঙ্গে। তার কারণ, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয় এবং সে সময়ে উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন। ’৪৭ এর থেকেও বেশি উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন ’৫০ সালে, তার কারণটা হচ্ছে ১৯৫০ সালে এক বিধ্বংসী দাঙ্গা হয়েছিল বরিশাল এবং ঢাকাতে।

Bengal refugees
সে সময়ে উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: সেটা যেহেতু পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষের ঢল, গেটওয়ে অফ পূর্ববঙ্গ হিসেবে শিয়ালদা স্টেশন এবং ওই চত্বরটা আর কি…

দেবজ্যোতি দত্ত: সেখানে সরস্বতী প্রেসের একটা ভালো ভূমিকা ছিল এই কারণে যে, সরস্বতী প্রেসের আদি জায়গা তো বরিশালে। বরিশাল থেকে সবাই এসেছেন মনোরঞ্জন গুপ্ত, বাবা…

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এমনকী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীও বরিশালের।

দেবজ্যোতি দত্ত: উনিও বরিশালের শঙ্কর মঠের। তখন ওখানে ‘বরিশাল সেবা সমিতি’ বলে একটা অরগানাইজেশন ছিল। যেটা ১৯০৯ সালে শুরু হয়েছিল। ললিতমোহন দাশ বলে একজন শুরু করেছিলেন। যারা ওখান থেকে পড়তে আসত তাদের থাকার জায়গা ছিল না। তাই উনি থাকার একটা বন্দোবস্ত করেছিলেন, ১৯০৯ সালে। বাবা এই অরগানাইজেশন-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে কী হল, উদ্বাস্তু মানুষ আসতেন, শিয়ালদাতে নামতেন। ‘বরিশাল সেবা সমিতি’র একটা ব্যানার টাঙানো থাকত। বাবা ভলান্টিয়ার রেখেছিলেন। যাঁরাই আসতেন বরিশাল থেকে, তাঁরা ওখানে দাঁড়াতেন। ভলান্টিয়াররা তাঁদের জিনিসপত্র তুলে এনে তাড়াতাড়ি করে শিয়ালদা থেকে সরস্বতী প্রেসে তুলে দিয়ে আসত। লঙ্গরখানায় পৌঁছে দিত। সেখানে তখন লঙ্গরখানা ছিল। লঙ্গরখানায় সবাইকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করার পরে তাদের কোথায় কোথায় সব আত্মীয়স্বজন আছেন, গুনে-গেঁথে ভাড়া দিয়ে…

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: পৌঁছে দেবার একটা ব্যবস্থা করতেন! মানে সরস্বতী প্রেস যেভাবে মুদ্রণ জগতে নিজের সুনাম বাড়াতে শুরু করেছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের যে আদর্শগত জায়গা সেটা ধরে রাখতে পারল।

দেবজ্যোতি দত্ত: এটা কিন্তু তখন বাঙালিদের মধ্যে ভীষণভাবে প্রচলিত ছিল, এই একে অপরকে সাহায্য করা।

Refugee camp
ভলান্টিয়াররা তাঁদের জিনিসপত্র তুলে এনে তাড়াতাড়ি করে শিয়ালদা থেকে সরস্বতী প্রেসে তুলে দিয়ে আসত। লঙ্গরখানায় পৌঁছে দিত।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ওরকম একটা মারাত্মক অভিঘাতের পর দেশভাগ তখন ‘বরিশাল সেবা সমিতি’ এবং সরস্বতী প্রেসের ভূমিকা ছিল অকল্পনীয়।

দেবজ্যোতি দত্ত: এই যে সময়টা, ১৯৩৯ থেকে ১৯৫০ অবধি এই সময়টায় একটা বড়রকম সামাজিক পরিবর্তন, বিভিন্ন রকম ঝঞ্ঝা, দেশভাগ হল, আর আগে মন্বন্তর হল, তার আগে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধল, এসমস্ত মিলিয়ে সামাজিক দিক থেকে প্রচণ্ড রকম একটা আঘাত এল। সেটা সামাজিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক সমস্ত দিকেই। এবং ঐ ’৪৭ সালে কিন্তু বৈপ্লবিক যা কিছু ছিল, সব ভেঙে গেল, শেষ হয়ে গেল। যাবতীয় রেভলিউশনারি অ্যাকটিভিটি স্তিমিত হয়ে গেল। অবশ্য সেই সময়ে কিন্তু সরস্বতী প্রেসের ঊর্ধগতি আরম্ভ হল আরও বেশি।

বাবা তখন ভাবলেন দেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাক্ষরতা বাড়বে। মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তাও বাড়বে। প্রিন্ট-মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। আগে কী ছিল, প্রেসে যখন কাজ হত, যারা মেশিন চালাত, তারা কিন্তু মেশিনের ওপরে ওই অ্যাপ্রেন্টিসশিপ বলে সেই অ্যাপ্রেন্টিস থাকতে থাকতে মেশিনম্যান হত। তাতে করে সময় লাগত অনেক।  প্রচুর সময় লাগত কাউকে মেশিনম্যান তৈরি করতে। বাবার মাথায় কিন্তু প্রথম থেকেই ছিল যে এবার সব বাড়বে, বাড়ার সময়ে তাহলে তো অসুবিধে হবে। যদি কাজ বেড়ে যায়, মেশিন বেড়ে যায়, তখন তো মেশিনম্যান পাব না। এই করে চলছিল ১৯৫০-’৫১-’৫২ অবধি। ১৯৫২ সালের ইলেকশনের পর যে মন্ত্রীসভা হল…

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: রাজ্যের মন্ত্রীসভা?

দেবজ্যোতি দত্ত: না। সেন্ট্রালে যে ইলেকশন হল, তার আগে ৪৬-এ ইলেকশন হয়েছিল।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: ’৫২-এর কেন্দ্রীয়  নির্বাচন? 

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ, কেন্দ্রীয়  নির্বাচন… সে সময়ে অরুণ গুহ মন্ত্রীসভাতে স্থান পেলেন। তখন বাবার সুবিধে হল। বাবা যে চিন্তাগুলো করছিলেন সেটাকে একটা রূপ দেওয়ার চেষ্টা হল। তখন বাবা বললেন, এই যে প্রিন্টিংয়ের কাজ বাড়ছে, ইঞ্জিনিয়ার তো বেরোচ্ছে, তো ইঞ্জিনিয়ারের মতো মেশিনম্যানও বার করুন, প্রিন্টিংয়ের বিভিন্ন কাজ জানা লোকও বার করুন। ওই জন্য স্কুল অফ প্রিন্টিং-এর মতো একটা ভালো প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। তখন প্ল্যানিং কমিশনে ডেভেলপিং কাউন্সিল বলে একটা উইং ছিল। বিভিন্ন ডেভেলপমেন্টের জায়গাগুলো তারা খুঁজে বের করত যে এই এই জায়গায় ডেভেলপমেন্ট দরকার। সেই সূত্রে প্রথম অস্থাজভাবে মুদ্রণ শিক্ষায়তন  স্কুল অফ প্রিন্টিং হয় কলকাতায়।

স্কুল অফ প্রিন্টিং ১৯৫৫ সালে কলকাতায় চালু হল। তাতে করে সুবিধাটা হল যে, প্রত্যেক বছর যারা পাশ করে বেরোত, মুদ্রণের বিভিন্ন শাখায় তারা পারদর্শী হত। ফলে লোক পেতে আরম্ভ করল।

Arun Guha
অরুণ গুহ

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: প্রিন্টিং টেকনোলজির এই যে ইন্সটিটিউট তৈরি হল সেটা কি যাদবপুরেই ? 

দেবজ্যোতি দত্ত: হ্যাঁ, ওই জায়গাতেই। ত্রিগুণা সেন তখন যাদবপুরে ছিলেন, সেসময়ে বিধান রায় ত্রিগুণা সেনকে বললেন, এটা করতে হবে। তখন পলিটেকনিকের পাশে একটা বাড়িতে শুরু হল। প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন নিরঞ্জন চক্রবর্তী। শুনলে আশ্চর্য হবে, গ্রাফিক আর্ট বলে তো একটা ব্যাপার আছে প্রিন্টিংয়ে, সেই গ্রাফিক আর্টের শিক্ষক কে ছিলেন জানো? পরিতোষ সেন। প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে একজন বেঁচে আছেন বিমল দত্ত বলে একজন। পাশ করেন বোধহয় ১৯৬০ বা ’৬১ সালে। উনি জয়েন করেছিলেন সরস্বতী প্রেসে। আমার সঙ্গে কথাও হয়। আমি তাঁকে বলেছি, তোমার স্কুল জীবনের, মানে প্রিন্টিং স্কুলের জীবনের সব কিছু লিখে রাখ পরে কাজে দেবে। সরস্বতী প্রেসেও কাজে দেবে, অন্যত্রক
তো এইভাবে প্রেস ক্রমশ বাড়ছে। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬০ সাল। ১৯৬৭ সালে প্রেসের যেটা সবথেকে অসুবিধা হল, ’৬৭ সালে, তার আগে কিন্তু আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট মুভমেন্টের দুটো ধারা হয়ে গেছে
একটা সিপিআই, আরেকটা সিপিআইএম। সেই সময় থেকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গাতেই… 

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: রাজনৈতিক অস্থিরতা।

দেবজ্যোতি দত্ত: রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হল।

Communist movement flag

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: দেবজ্যোতিদা, আমরা একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার ওই জায়গাটা শুনতে চাইব, যেখানে সরস্বতী প্রেসের দ্বিতীয় একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে।

দেবজ্যোতি দত্ত: যখন ওই প্রথম ইউনিটটায়, ১৯৫০-’৫১ সাল থেকে বড় জায়গার প্রয়োজন অনুভূত হল। খুব বড় জায়গা দেখতে গিয়ে অনেকগুলো জায়গা দেখা হল। অনেক জায়গা পছন্দ হল না। শেষ অবধি ভাগ্যলক্ষ্মী কটন মিলের একটা জায়গা ছিল ডানলপ ব্রিজ ছাড়িয়ে গিয়ে বাঁ-দিকে ভাগ্যলক্ষ্মী কটন মিলের একটা জমি ছিল ঠিকা টেনেন্সিতে। প্রথমে সেখানে ৪ বিঘে জমি নেওয়া হল।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: সেটা কত সাল?

দেবজ্যোতি দত্ত: এটা হচ্ছে ১৯৫২-’৫৩ সালে। তারপরে আরও জমির দরকার হবে। তখন আরও ৩ বিঘে জমি পিছনে ছিল, সেটাও নেওয়া হল। তারপরই হঠাৎই ঠিকা টেনেন্সিটা উঠে গেল। লিজহোল্ড ল্যান্ড তো… তখন কিন্তু সরস্বতী প্রেস ওই জমিটার মালিকানা নিল। বাবা একটা জায়গায় লিখেছেন, সেই সময়ে ৭০ হাজার টাকায় ৭ বিঘে জমি। 

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: সে তো একটা বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হল সেকেন্ড ইউনিটের। 

দেবজ্যোতি দত্ত: এত বড় জমি নিয়ে তখন কিন্তু কোনও প্রেস এখানে ছিল না।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এত বড় প্রেস পশ্চিমবঙ্গে কেন, ভারতেই ছিল কি না সন্দেহ।

দেবজ্যোতি দত্ত: ছিল না। পরবর্তীকালে আরও জায়গা নেওয়া হয়েছে। এখন সেই প্রেসের এরিয়া হচ্ছে প্রায় ১০ বিঘে জমি। সেখানে অফসেট, মেটাল প্রেস সব তৈরি হয়। সরস্বতী প্রেস এমন একটি প্রেস ছিল যেখানে কাগজ বাদ দিয়ে আর সব কিছু তৈরি হত, এমনকি কালিও তৈরি হত, সিল্ক স্ক্রিন হত, টাইপ তৈরি হত।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: নিজস্ব ফাউন্ড্রি ছিল?

দেবজ্যোতি দত্ত: নিজস্ব ফাউন্ড্রি ছিল। তারপর রোলার। প্রিন্টিং মেশিনে তো রোলার দরকার হয়, সেই রোলারও কিন্তু তৈরি হত।

শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়: এটাও খুব অভিনব যে, একটা প্রেস যে টাইপগুলো ব্যবহার করছে সেটাও নিজে তৈরি করছে।

দেবজ্যোতি দত্ত: সমস্ত কিছু। সমস্ত টাইপ ফর্মেশন ছিল। একমাত্র প্রিন্টিংয়ের যে কাগজ, তা ছাড়া যা কিছু দরকার সব ওইখানে তৈরি হত। এটা কিন্তু আর কোনও প্রেসে ছিল না। বাবা বলতেন, ‘আজ যদি বয়স থাকত তাহলে হয়তো কাগজের রিলও তৈরি করতাম’। যাইহোক, সরস্বতী প্রেসের এই উত্থানের ফলে সারা ভারতবর্ষে তখন সরস্বতী প্রেস এক নম্বর বলে গণ্য হত। দিল্লি টেলিফোন ডিরেক্টরি সরস্বতী প্রেসে ছাপা হত। উত্তর প্রদেশের টেলিফোন ডিরেক্টরি সরস্বতী প্রেসে ছাপা হত। DAVP, মানে ডিরেক্টরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিশুয়াল পাবলিসিটির যত কাজ, সমস্ত সরস্বতী প্রেসে আসত। মানে পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের মধ্যে মুদ্রণে একদম প্রথম স্থান অধিকার করেছিল।

 

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Picryl
*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ৩১ মে।

Banglalive.com Logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Picture of বাংলালাইভ

বাংলালাইভ

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
Picture of বাংলালাইভ

বাংলালাইভ

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com