(Shibram Chakraborty) কাঁটাতারের বেড়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রিনি, দুজনেই আমরা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে।
‘সেই গানটা একটু গা না রিনি, গাইবি? পরশু মীর্জাপুর পার্কের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গাইছিলিস যেটা? গুন গুন করে ধরেছিলি যে সেই-‘ তার দিকে তাকাই। তার রূপ গুণ দুই-ই বুঝি একাধারে পেতে চাই।
‘সেখানে আবার কী গান গাইলুম গো? সেই পার্কে? সেটা কি গান করবার জায়গা ছিল নাকি?’
‘আহা! চাপা গলায় গাইলি না একটুখানি? আপন মনেই গেয়েছিস, মনের ভুলেই হয়তো বা। টের পাসনি তুই-কিন্তু বেশ লেগেছিল আমার। সেই যে… বহুদিন পরে/বঁধুয়া এলে/দেখা না হইতো/জীবন গেলে। পদাবলী কীর্তনের এই কলিটা ধরেছিলি না তুই। ঐ একটা কলিই… তারপর সভায় কে একজন হোমরাচোমরা লোক এসে গেল, আর তোর কলিটা ভাল করে ফুটতে না ফুটতেই ঝরে পড়ল। সে আসতেই যা চেঁচামেচি পড়ে গেল না। তুইও থেমে গেলি তখন।’
‘সে কলি তো সেদিনের গো, আজ আবার কেন? আজ তো সে কলি ফুল হয়ে ফুটেছে। এসে গেছি তো আমরা। …সে গান ফের এখন কিসের জন্যে?’ (Shibram Chakraborty)
‘সেখানে আবার কী গান গাইলুম গো? সেই পার্কে? সেটা কি গান করবার জায়গা ছিল নাকি?’
‘আহা! চাপা গলায় গাইলি না একটুখানি?
‘সেই সুরটা কানে লেগে রয়েছে কিনা আমার এখনো, শুনছি সব সময়। তাই বলছিলাম। কী মিষ্টি যে গাইছিলি না।’
সেদিনের আত্মবিস্মৃতক্ষণের তার স্বগতোক্ত সম্ভাষণের সেই অস্ফুট কলি-তার সুমৃদু সুরভি এখনো যেন আমার কানে লেগে। কোনোদিন প্রস্ফুটিত না হয়েই অকালে যদি ঝরেও যায়, তবু বুঝি তা চিরকালের মতই আমার প্রাণে লেগে থাকবে।
‘জেলখানায় কি কেউ গান গায়? এই কি গান গাইবার জায়গা?’ রিনি বলে- ‘উপযুক্ত পরিবেশ কি এটা?’
‘নয় কেন? যেখানে কী না একটি বেশ পরী আমার পাশটিতেই, তার মতন পরিবেশ আর আছে নাকি? আমার সামনে গঙ্গা আর পাশেই এই সুরধুনী-এর চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে বল?’
‘গঙ্গা আর সুরধুনী আবার আলাদা নাকি? অবাক করলে।’ (Shibram Chakraborty)
আরও পড়ুন: প্রকাশগলির ভিতর দিয়ে
‘গঙ্গা সবার আর সুরধুনী শুধু আমার-শুধু আমারই।’ আমার ভাষ্যকরণঃ ‘তুই-ই আমার সুরধুনী।’
‘আমি আবার কিসের সুরধুনী!’
‘প্রথম সুর আমি তোর গলাতেই শুনি। সুরের সাড়া আর আমার প্রাণের সাড়া পাই তোর কাছ থেকেই। তোদের দিকের বারান্দা থেকে গাইতিস না, এধার থেকে আমি শুনতাম… কত শুনেছি…সেই যে একদিন গেয়েছিলিস, ও গো দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে/আমার সুরগুলি পায় চরণ/আমি পাইনে তোমারে।…তোর ওই গানটা শুনেই না আমার প্রাণে সাড়া পড়ল প্রথম। প্রথম যেদিন এই গানটা শুনি… আমাকে লক্ষ্য করেই গাইছিলিস তো?’ (Shibram Chakraborty)
তুমি আমার গানের ওপারে/আমার সুরগুলি পায় চরণ/আমি পাইনে তোমারে।…তোর ওই গানটা শুনেই না আমার প্রাণে সাড়া পড়ল প্রথম।
রিনি হাসতে থাকে। ‘তোমার মাথা। কী না কী। ছেলেরা কী যে সব আলতু-ফালতু ভাবে… কিসের থেকে কোথায় আসে, নিজের মনেই কতো কী যে ধরে নেয়!… আশ্চয্যি! এটা যে রবিঠাকুরের গান গো, তাও জানো না? ভগবানের উদ্দেশে রচনা-কোন মানুষ-টানুষের উদ্দেশে নয় আদপেই! তোমার জন্যে গাইতে যাবো কেন-কোন দুঃখে?’
‘না গাইতেও পারিস, কিন্তু আমার তাই মনে হয়েছিল, তাই আমি বলছিলাম। রবিবাবুর গানগুলো সব কেমনধারা। সব কিছুতেই খাপ খায়-সবখানেই লাগে। মশারির মতন চারদিকেই খাটানো যায়। গানটাকে তুই ভগবানের জন্যে বলছিস? তাও হতে পারে, সত্যি। ভেবে দেখছি তাও হয়। কিন্তু অন্য কাউকে বাগানোর জন্য হলেও এমন কিছু মিথ্যে হয় না।…. আমি ভাবছিলাম তুই আমার কানটাকে হাতের নাগালে পাচ্ছিস না, কান ধরে টানতে পারছিস না আমার, তাই ওই সুরের আঁকশি বাড়িয়েছিস। (Shibram Chakraborty)
কিন্তু যাই বল তুই,
ওই গানটা, কানে আসা মাত্রই তোদের বাড়ি ছুটে গেছলাম, মনে আছে তোর?’
‘তুমি তো হরদমই আমাদের ধারটায় ছুটে আসতে তোমাদের ভাঁড়ারের দরজার ছিটকিনি খুলে-তা যে আমার জন্যেই আসতে তা কী করে জানব। আমি ভাবতাম বুঝি খাবার লোভেই। মা তোমাকে এটা ওটা সেটা খাওয়াতেন না…
‘এখন তো জানলি …..তাতে কী হয়? বিস্কুটের জন্যে গেলে আর অমৃত হাতে পেলে…. কিংবা যদি একটু ঘুরিয়ে বলি, অমৃতের নাগালে যেতে অযাচিত বিস্কুট গালে এলে এমন কি ইতরবিশেষ হয় শুনি? কোনো পাওয়াটাই তাতে মিথ্যে হয়ে যায় না। তারপরে তোর সেই গানটা? আমার বকুল বনে/যেদিন প্রথম ধরেছে কলি/তোমার লাগিয়া/তখনই বন্ধু ।/ গেঁথেছিনু অঞ্জলি! ‘এটা…. এটাও কি তোর সেই ভগবানের জন্যেই গাওয়া। ভগবানের জন্যেই বাঁধা কবির এ গানটাও?’
‘জানিনে বাপু। ছেলেরা এত কিছু ভাবতেও পারে। এমন সব ধরে নেয় যে, তার কোনো মাথামুন্ডু যদি পাওয়া যায়?’
‘তারপর, তোদের সেই কলকাতায় চলে আসার দিনটায় সকালে সেই আমাদের ছাদে ছুটে এলি না? সেদিন যে গানটা তুই গেয়েছিলি, এখনো তা আমি ভুলিনি… সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে/ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা/ভুলো না… ভুলো না। সেদিন বাতাসে কী ছিলে তা জানো?/তোমারই মনের মাধুরী’ মাখানো/আকাশে আকাশে আছিলো ছড়ানো/তোমারে হাসির তুলনা….!’ (Shibram Chakraborty)
বিস্কুটের জন্যে গেলে আর অমৃত হাতে পেলে…. কিংবা যদি একটু ঘুরিয়ে বলি, অমৃতের নাগালে যেতে অযাচিত বিস্কুট গালে এলে এমন কি ইতরবিশেষ হয় শুনি?
‘মানেটা কী এর শুনি?’
‘যাই মানে হোক, ভগবানের কিছু নয়। আমি ভগবানের হাসি কখনো দেখিনি ভাই- তুই হয়তো দেখে থাকতে পারিস। আমি মা কালীর জিভ ভ্যাঙানি পর্যন্ত দেখেছি….. দেখলে ভয় করে। তবে হ্যাঁ, আমার মা দুর্গার মুখ টিপে টিপে ঐ হাসিটা আমি ভালোবাসি। কী মিষ্টি যে। তবে এই চর্মচক্ষে নয়, দেখেছি তোর ঐ প্রতিমাতেই। তুইও দেখেছিস। সকলের দেখা।’
‘গানের মানে….. মানে, তার মর্মটা তুমি কী টের পেয়েছিলে বলো তো?’
‘মানে, এই যে আমার সামনেই। তোর হাসি তো তুই নিজে দেখতে পাসনে, কী বুঝা তার। ভগবান তোদের নিজেদের দিকে দেখতে দেননি, নিজেকে দেখতে পাস না তা রক্ষে-নইলে তোরা কি কোনোদিন এই সব কালো ভূত ছেলেদের দিকে ফিরে তাকাতিস কোনো ছেলে কি তোদের কৃপাদৃষ্টি পেতো আর? নিজেদের দেখে, নিজেদের নিয়ে মশগুল হয়ে থাকতিস। ভুলেও তাকাতিসনে আমাদের দিকে।’
‘এই বুঝি সেই গানের মর্ম?’
‘আমার মনে হয়েছিল কী-বলব? মনে হয়েছিল যাবার আগে, সেই যে আমরা বিকেলে রোজ মাঠের ধারে ধারে ঘুরতাম, পাটালি গুড় দিয়ে চিঁড়ে খেতাম না? আবারও সেই কথাটাই গানের ছুতোয় মনে করিয়ে দিচ্ছিলি তুই আমায়। সেদিন দুজনে দুলেছি বনে-ওর মানে হচ্ছে সোজা বাংলায় গদ্য করে বললে, গুড় চিঁড়ের দোলনায় সেদিন আমরা যে ঝুলে পড়েছিলাম, সে কথাটা যেন তুমি কখনো ভুলে যেয়ো না ।….’
‘এই তুমি বুঝেছিলে। চিঁড়ের ভোরে চিরতরে বাঁধা পড়ে গেছি আমরা-এই?
আরও পড়ুন: আংরেজ বিবির অসম্পূর্ণ উপাখ্যান
গানটায় তো তোর কথা ছিল না, আমার মনের কথাটাই ছিল যে। যে কথাটা নাকি আমার বলবার, সেইটাই তুই আমার হয়ে বলে দিয়েছিলিস। ওটা আমারই মর্মের গাথা ছল…. আমার মর্মেই গাঁথা হয়েছিল….সেই আমার মর্মগাথা এখনো এই মর্মে গাথা হয়ে আছে…. এইখানটিতে।’ ওই সুরের ভিতে আমার মর্মর-গাঁথনি খাড়া করি নিভৃতে- ‘আসল কথাটা হচ্ছে, তোর গানের কোনো তুলনা হয় না-যেমন কিনা আমার কাছে তোর কেউ মিতুল নেই। এত গান আর এত এত সুর তুই তুলোর মতন আমার মনের মধ্যে ধুনেছিস না! তাতে তোকে আমার জীবনের সুরধুনী ছাড়া আর কিছুই আমি ভাবতে পারিনে।’
এক কথায় ওর গানের সঙ্গে ওকে আমি তুল্যমূল্য করি। খুনে ধূল পরিমাণ করে দিই।
‘এতক্ষণে বুঝলাম! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার।’ সে হাসতে থাকে।
তুলনাহীন যে হাসিটি নাকি আকাশে আকাশে ছড়ানো ছিল সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার আমার ফুরসত নেই তখন-তাই যেন নিমেষের মধ্যে আমার সকাশে সুরের নির্বারিণী হয়ে প্রকাশ পায়-সেই রিনি।
এমন সময় সদরে ঘণ্টা পড়ে।
তৎক্ষণাৎ আমি সচকিত-‘গান থাক, খাবার ডাক পড়েছে এখন। চল আপিসে যাই, তোর নাম লিখিয়ে লোটা কম্বলগুলো নিয়ে আসি গে…’
‘লোটা কম্বল? লোটা কম্বল কিসের?’
‘দুখানা করে জেলের কম্বল দেবে না আপিস থেকে? বিছানা করে পাতবার আর গায়ে দেবার জন্যে-নিতে হবে তাই। সেই সঙ্গে রুটি তরকারি ইত্যাদি-রাত্তিরের খাবার যা দেয় তারপর।’
‘আর ঐ লোটাটা কিসের জন্যে?’
‘জল খেতে-লোটা মার্কা গেলাস দেবে একখানা। তাকে ঘটিই করো আর বাটিই বানাও।’
রিনির নাম রেজেস্ট্রি করে আপিসের থেকে কম্বল দুটো জোটানো গেল।
‘চল, এখন বিছানাটা পেতে ফেলা যাক গো…’
‘আর খাবার?’
দুখানা করে জেলের কম্বল দেবে না আপিস থেকে? বিছানা করে পাতবার আর গায়ে দেবার জন্যে-নিতে হবে তাই। সেই সঙ্গে রুটি তরকারি ইত্যাদি-রাত্তিরের খাবার যা দেয় তারপর।
‘খাবার এসে দিয়ে যাবে সীটে সীটে ওয়ার্ডাররা। একটু বাদেই দেবে আর। থালা রেডি করে রাখতে হবে।… খিদে পেয়েছে বুঝি তোর?’
‘তা একটু পেয়েছে… তবে খুব নয়…’
‘বাস, খাবার পর আর তো কোনো কাজ নেই। খেয়েই ঘুম। সারা রাত যত পারিস ঘুমো না। তবে শীত এখানে বেজায়, ঘুমোতে পারলে হয়। মাঝ রাত্তিরে না, হাড় কাঁপিয়ে দেয়-বলতে কি!’
‘কিন্তু কম্বলগুলোও বেশ ধক্কর দেখা যাচ্ছে।’ খুঁটিয়ে দেখে সে বলে- ‘ঘোড়ার কম্বল।’
‘জায়গাটা গঙ্গার ওপরেই তো, দারুণ ড্যাম্প-মেঝেটাও বেশ স্যাঁতসেঁতে। রাত্তিরে গোটা গুদোম জুড়ে যা কাশির সাড়া পড়ে যায় না-একাধার থেকে যা ঐক্যতান শুরু হয়! …..এটা গঙ্গার পশ্চিম কূল কিনা কে জানে
‘তার মানে?’
‘বাবা বলেন যে, গঙ্গার পশ্চিম কূল বারাণসী সমতুল। কাশীক্ষেত্রের মতই সেটা পুণ্যভূমি নাকি! এটা তাই হবে বোধ হয়। কাশীবাসের পুণ্যফলে কাশীপ্রাপ্তি না হয় শেষটায়… হাড় ক’খানা এখানেই না রেখে যেতে হয় আমাদের।’
‘তোমাকেও ধরেছে নাকি কাশিতে? সারা রাত তুমি কাশবে নাকি গো? তাহলে তো ঘুমোতে দেবে না দেখছি-‘
‘এখনো তো ধরেনি কাশিতে, পরে কী হবে কে জানে।’
গুদোম ঘরে ঢুকে দেখি আমাদের তাকটা একেবারে ফাঁকা। আমার কম্বলগুলো পড়ে রয়েছে কেবল। দেবেন তার কম্বল গুটিয়ে কোথায় চলে গেছে। যতদূর চোখ যায় তাকের পর তাক তাকিয়ে দেখি, কোনো ফাঁকে কোথাও আর তাকে দেখা যায় না। কোনখানে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে কে জানে!
‘এই উপরের তাকটায়…এই যে আমার কম্বল পাতা রয়েছে… দেখছিস তো? উঠতে পারবি এই তিনতলায়?’
‘অক্লেশে। তোমাদের দেশে গিয়ে কতো পেয়ারা গাছে উঠতাম দ্যাখোনি? তবে এটার একতলা দুতলা সবই তা খালি পড়ে রয়েছে-এগুলোয় বিছানা পাতলে হয় না?’
‘পাতা যায়। তবে বললাম না, ঠাণ্ডাটা বেজায়। ওপর থেকেও পড়ে আবার নীচের থেকেও ওঠে-ড্যাম্পো কিনা জায়গাটা। তেতালায় যা ঠাণ্ডা একতালায় তার তিন ডবল হবে বোধ হয়। এক কাজ করা যাক, আমাদের দুজনের চারখানা কম্বল তো? একটা কম্বল শুধু পাতি, তাতেই দুজনের কুলিয়ে যাবে-যাবে না? শীতের রাত্তিরে হাত-পা না ছড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুতেই আরাম…’
‘তাই হবে না হয়।’ তার দ্বিমত দেখি না- ‘শিবরাম আর আরাম একাধারে নিয়ে না হয় শোয়া যাবে এখন।’
‘আর তিনখানা কম্বল এক করে যদি গায়ে চাপাই? তা হলে শীতের বাবাও সেই দুর্গ ভেদ করতে পারবে না। তিনগুন শীত পড়লেও।’
‘বেশ, তবে তাই হোক।’
সন্ধ্যের খাবার সেরেই কম্বলের ‘ঘরে গিয়ে সেঁধুলাম দুজনায় ঘুমোনো যাক এবার, কী বলিস?’
‘হ্যাঁ। যা ঘুম পাচ্ছে না!…’ বলতে বলতে ওর চোখের পাতা বুজে এসেছে। সেদিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থেকেই আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনে।
মাঝরাতে গুদামঘরের ছাদে ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে আমাদের
‘ও কি গো? কিসের শব্দ ও?’
‘বৃষ্টি পড়ছে বোধ হয়। শীতকালে মাঝে মাঝে অকালবর্ষণ হয় না?’
‘এটা তো মাঘ মাস।’ খনার বচন আওড়ায় সে- ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।… ইংরেজকে তা হলে ধন্যি বলতে হয়। কী বলো?’
ইংরেজ আমাদের রাজা নাকি? তার রাজত্বের প্রজা আমরা? এখনো তাই আছি নাকি? আমাদের হচ্ছে গান্ধী মহারাজ-তিনিই ধন্য। তাঁকেই ধন্যবাদ! আর পুণ্য আমাদের এই চড়বড় করে আমার কথাটার সাড়া পাওয়া গেল ছাদের ওপর। রিনি চমকে উঠে বসেছে তৎক্ষণাৎ। ‘শিল পড়ছে। শিল পড়ছে!’ তার উৎসাহ দেখবার মতন।
‘কুড়িয়ে আনব বাইরে গিয়ে? কেউ কিছু বলবে না তো?’
‘পাহারাওলারা গার্ড দিচ্ছে না বাইরে? পাকড়ায় যদি?’
‘কী করবে আমার? জেল তো হয়েইছে, তার ওপর আবার কী হবে? আবার জেল দেবে নাকি? দেয় দিক, না হয় আরেক মাস জেল দেবে, তাই খাটব, তার কী হয়েছে?’
রিনি বলে, ‘তোমার ক’ মাস হয়েছে গো?’
‘দু’মাস। তোর?’
‘মোটে এক মাস। আমার সঙ্গী আর যারা ছিল, তাদের দু’মাস, তিন মাস করে সব।’
‘জজসাহেব তোর চাঁদপানা মুখ দেখে ভুলে গেছে, বুঝেছিস? তাই তোর এত কম। এক যাত্রায় পৃথক ফল সেই জন্যেই। বঙ্কিমবাবু বলে গেছেন না, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।’
আমি বঙ্কিম দৃষ্টিতে ওকে নজর দিই। বঙ্কিমের নজরানাও।
‘বঙ্কিমবাবুর বউ খুব সুন্দর ছিল বোধ হয়, তাই না?’
ইংরেজ আমাদের রাজা নাকি? তার রাজত্বের প্রজা আমরা? এখনো তাই আছি নাকি? আমাদের হচ্ছে গান্ধী মহারাজ-তিনিই ধন্য।
‘সে আর বলতে! জান কী হয়েছিল একবার? বঙ্কিমজীবনীতে আমি পড়েছি। বঙ্কিম সস্ত্রীক যাচ্ছিলেন ট্রেনে। কোন ষ্টেশনে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। একটা ছোকরা তাঁর বউয়ের দিকে ঘুরেফিরে আড়চোখে তাকাচ্ছিল আর ঘুরঘুর করছিল তাঁর কামরার সামনে। বঙ্কিম তাকে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী করো তুমি, কতো মাইনে পাও, এই সব। তারপরে বললেন, দেখ বাপু, তাকাতে হলে ভাল করে তাকাও। কোনো আপত্তি নেই। দোষও নেই কোনো-সুন্দর জিনিস দেখবে-তাতে কী। সুন্দর তো দেখবার জন্যই হে, তবে অমন চোবা চাহনি হানা কিসের জন্যে? ও তো কিছু ঘোমটা টেনে বসে নেইকো। তাকিয়ে দ্যাখো না ভালো করে! দেখবার মতন মুখখানা বটেই তো। তবে মুখ দেখেই যা, মন পাওয়া ভার। আমি আড়াই হাজার টাকার চাকরে, মাসকাবারে সব টাকাটা পায়ের গোড়ায় ধরে দিয়েও মন পাইনে ওঁর। আর তুমি কি ওই সামান্য টাকায় পাবে আশা করো?’
ছেলেটা বোধ হয় মাথা নামিয়ে চোঁচা দৌড় দিয়েছিল তার পর?’
‘কে জানে! তা আর লেখেনি বইটায়। তবে আমি ভাবছি কি, বাইরে গেলে পাহারাওলারা তোকে ধরে যদি…’
‘ধরে ধরুক। আমার কুড়োনো শিলের আদ্দেক ভাগ দেবো না হয়…’
‘তারা যদি অতো সুশীল না হয়। তাতে না ভোলে যদি… এমন কি, তোর এমন সুন্দর মুখ দেখে-?’
‘এর জন্যে আরো এক মাস জেল হয় যদি আমার? ভালোই হবে তা হলে বলব। দুজনে মিলে এক সাথে বেরুতে পারব এখান থেকে।’
‘আরে না না, সে কথা ভাবছিনে। ধর যদি তোকে পাকড়ে নিয়ে জেলখানার বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসে। বলে যে, যাও ভাগো হিয়াসে। চরে খাওগে যেখানে খুশি-এখানে আর তোমার ঠাঁই হবে না। তা হলে?’
‘তা হলে তো মুশকিল। সেটা ভাবনার বিষয় বটে।’ ওর মুখে গুমোট দেখা দেয়।
‘তোর চেয়ে আমার ভাবনা আরো।’ বৈষ্ণব পদাবলীর একটি কলি, ঠিক গুঞ্জন-ধ্বনিতে নয়, আমার বেসুরো গলার গঞ্জনায় দক্কা গমক হয়ে বেরয়। তিমির দিক ভরি ঘোরা যামিনী/অথির বিজুরিক পাতিয়া/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/কৈসে কাটাওঅ দিন রাতিয়া।’
‘রাখো! কী সব উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছো-বলো তো।’
‘কি রকম? এটা মাঘ মাস নয় তাই বলছিস বুঝি। বৃষ্টি পড়লেই বাদলা হলেই মাঘ মাস ঘনিয়ে আসে। ঋতুতে না হলেও-মনের মধ্যে। মানে মনের মাঘ-বুঝেছিস?’
‘আহা! আমি জানিনে বুঝি? পদাবলীর বই পড়িনি নাকি? তোমাদের বাড়ির সব বই-ই তো তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়ে পড়েছি-কেবল একটা বাদে। একটা সংস্কৃত বই-তবে তার সঙ্গে বাংলা মানে দেওয়া ছিল। বাৎসায়ন না কার যেন-কামসূত্র না কী! বইটা তুমি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলে, পড়তে দাওনি।’
‘খুব খারাপ বই কিনা তাই। তার মধ্যে বিচ্ছিরি সব কথা। আমার হাতে একদিন দেখে না মা আমাকে পড়তে মানা করেছিলেন-এই বয়সে ওসব বই পড়তে নেই নাকি।
‘তুমি পড়োনি?’
‘আগাগোড়া। কামসূত্রের তামাম আমার পড়া। লুকিয়ে লুকিয়ে আমি পড়েছিলাম, টের পায়নি মা। টের না পেলেই তো হলো। মা’র মনে দুঃখ না দেওয়া নিয়ে কথা।’
‘কী ছিলো সেই বইটায়, শুনি?’
‘সেসব কথা মুখে আনা যায় না। মানেও বোঝা যায় না ঠিকঠিক। আন্দাজে বুঝে নিতে হয়-তবে একটুখানি ওঁর আঁচ পেয়েছি তার মধ্যেই। এককথায়, সেসব বলবার নয়, বলনীয় না, করণীয়।’
‘তাহলে মা’র কথাটা তুমি রাখোনি? শোনোনি একেবারে?’
কোন্ কথাটা শুনেছি মা’র? জীবনে কোন্ কথাটা রাখলাম! মা’র কথা শুনলে তো মানুষ হয়ে যেতাম রে। এ দশা কি হতো আজ আমার! চাইলে কোনো মহামানব হয়ে যেতেও পারতাম হয়ত। কী সর্বনাশটা যে হতো আমার তাহলে।’
‘মহামানব হওয়াটা কি সর্বনাশের?’
‘কোনো স্বাধীনতা থাকত না তখন কোনো কিছুর। আষ্টেপৃষ্টে বাঁধাছাঁদা ছক বাঁধা গণ্ডীর ভেতর একলাটি-এদিকে ওদিকে তাকাবার যো নেই-এ পাশে সে পাশে বেড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে যে, উপায় নেই তার। সর্বদা ঘেরাওয়ের মধ্যে বাস করো। ঘোরো ফেরো দিন রাত।’
‘তোমায় বলেছে! কেন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ হওয়াটা কি খারাপ?’
‘কে বলেছে? তাঁরা সব ওপর থেকে নামেন, একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন-ভগবানের বিশেষ নির্দেশ নিয়ে। তাই পালন করতে আসা তাঁদের। এ কথা তো মা-ই বলেছেন। আর আমরা? মাটি ফুঁড়ে উঠেছি সব-ভুঁইফোড় সবাই। যা খুশি করার, যা কিছু হওয়ার স্বাধীনতা গেলে সবই গেল, আমাদের রইলো কি আর। ব্যক্তিস্বাধীনতা সবার চেয়ে বড়ো। তা জানিস? একথাটাও মা’রই বলা। কিন্তু এটা আমার মনের মতন কথা। এটাই আমি মানলাম। এত উল্টোপাল্টা কথা বলে না মা।’
কে বলেছে? তাঁরা সব ওপর থেকে নামেন, একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন-ভগবানের বিশেষ নির্দেশ নিয়ে। তাই পালন করতে আসা তাঁদের।
‘মানেটা কী ওর? ঐ ব্যক্তিস্বাধীনতার?’
‘কে জানে কী মানে! তবে মোটামুটি আমি বুঝেছি যা-বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর হতে গেলে আর রঙ্গলাল হওয়া যায় না।’
‘রঙ্গলালটা কে আবার?’
‘সেই যে-যিনি বলেছিলেন-স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়?’
‘সে হচ্ছে ইংরেজের অধীনতার থেকে মুক্তি-সেই স্বাধীনতার কথাই ওতে বলেছিলেন কবি।’
‘আমি সেটা সব রকমের স্বাধীনতায় ধরে নিয়েছি। স্বাধীনতার কি আবার ভাগাভাগি আছে নাকি? যোগবিয়োগ হয়? তবে তুই যে বললি, আমি উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়েছি-কোথায় চাপালাম শুনি?’
‘পদবলী কীর্তনে ছিলটা কী, আমার মনে নেই নাকি? ছিল যে, সখিরে/ হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শুন্য মন্দির মোর।’ বলতে বলতে সে গুনগুনিয়ে ওঠে মৌমাছির মতইঃ তিমির দিক ভরি/ঘোরা যামিনী/অথির বিজুরিকো পাতিয়া/কান্ত পাহনু/বিরহ দারুণ/ফাটি যাওত ছাতিয়া…’
‘এই ছিল?’
‘এই ছিল, নয় তো-বিদ্যাপতি কহে কৈসে গোঙায়ব/হরি বিনু দিন রাতিয়া….. এও হতে পারে।” বিদ্যাপতি খুব বিদ্বান লোক হতে পারেন কিন্তু সত্যবাদী নন। আমি বলব।’
‘সত্যবাদী নন?’
‘এ ক্ষেত্রে যে না, তা আমি বলতে পারি। বাদলার দিনে মোটেই হরির জন্যে বিদ্যাপতির প্রাণ কাঁদছিল না…’
‘তবে কার জন্যে শুনি?’
‘হলে পরে বিদ্যাপত্নীর জন্যেই হবে…’
শুনে সে হাসে-‘বিয়ে না হতেই বউয়ের কান্না কাঁদতে লেগেছো? বউ-এর বিরহ বুঝতে শিখেছ? টের পেয়ে গেছ এর মধ্যেই? বটে?’
‘বৈষ্ণব পদাবলীর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের মনে কী জিজ্ঞাসা ছিল তা জানিস?- ‘শুধু বৈকুন্ঠের লাগি বৈষ্ণবের গান?’ বলেছিলেন না তিনি-তাঁর কবিতায়? পড়িসনি?’
‘পড়েছি তো।’
‘আবার নিজেই সেই প্রশ্নটার জবাবও দিয়ে গেছেন। বৈকুন্ঠ কুণ্ঠিত রহে নিজ কুণ্ঠাভরে। বৈষ্ণবের গান শুধু বৈষ্ণবীর তরে।’
‘কোথাও বলেননি এমন কথা, আমার মনে আছে বেশ। এটা তুমি মুখে মুখে বানালে এক্ষুনি।’
‘মুখে মুখে বানাবো এত বড়ো কবি আমি হইনি এখনো। মুখে মুখে শুধু একটা জিনিসই আমি বানাতে পারি, কবিতাই হয়ত সেটা, না হলেও কবিতার মতই প্রায়। বানাবো? বানাবো এখন? একটা মোটে!’ আমি সাধি- ‘কিংবা আধখানাই-যদি বানাই?’
‘না না না।’ সে নিজের মুখ চাপা দিয়ে কয়, ‘এখানে ওসব নয়। কেউ যদি দেখতে পায় না-পেলেই আমাদের ধরে জেলের বাইরে বার করে দেবে। দু’জনকেই। ব্ল্যাক লিস্টে নাম তুলে দেবে আমাদের। কক্ষনো আর জেলে ঢুকতে দেবে না। তোমার এই ব্যক্তি স্বাধীনতা শিকেয় উঠবে-কি করে রঙ্গলাল হবে তখন?’
শিবরাম চক্রবর্তী রচিত উপন্যাস ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’র ছেচল্লিশতম অধ্যায়
অলংকরণ: অনুপ রায়
বানান অপরিবর্তিত
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।