(Jagjit Singh) তাঁর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অভিনেতা অনুপম খের বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রথম প্রকৃত গজল গায়ক ছিলেন তিনি, তাঁর আগে যাঁরা গাইতেন তাঁরা পুরোনো গজল গায়কদেরই অনুকরণ করতেন। তাঁদের নিজস্ব কোনও গায়কী ছিল না। তবে ওঁর গজল ছিল কাব্যময়তায় ভরপুর।’ যাঁর প্রসঙ্গে এই উক্তি তিনি উপমহাদেশের অবিসংবাদী ‘গজল সম্রাট’, ভারতীয় সংগীত জগতের অন্যতম নক্ষত্র জগজিৎ সিং! তাঁর গাওয়া ও সুর করা বিভিন্ন গজল আজও ফেরে আমাদের মুখে মুখে। অপূর্ব সুরেলা গলার অমন বিষণ্ণ মাদকতার হাত থেকে নিস্তার পাননি কেউই। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে জলন্ধরের এক রেডিও স্টেশন থেকে শুরু হয়েছিল জগজিৎ সিং-এর কেরিয়ার। আজ তাঁর জন্মদিনে ফিরে দেখা শিল্পীর বর্ণময় সংগীতজীবনের দিকে। (Jagjit Singh)
১৯৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, রাজস্থানের এক শিখ পরিবারে তাঁর জন্ম। আসল নাম জগজীবন সিং, যদিও পরে নাম বদলে হয়ে উঠলেন জগজিৎ। অল্প বয়সে শ্রী-গঙ্গানগরে পণ্ডিত ছাগনলাল শর্মার কাছে দু’বছর সংগীতশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করেন তিনি। এরপর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম ধারা – খেয়াল, ঠুমরী, ধ্রুপদ শেখেন উস্তাদ জামাল খানের ‘মাইহার ঘরানা’ থেকে।
মাত্র ২০ বছর বয়সে, ১৯৬১ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় গান গাওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর সংগীত জগতে পদার্পণ। যদিও এরপরের যাত্রাপথ খুব মসৃণ ছিল না, কয়েক বছরের মধ্যে হঠাৎ বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই গায়ক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে পাড়ি দেন মুম্বাই। সেখানে প্রথমদিকে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পার্টিতে গান গাইতে শুরু করেন জগজিৎ। এভাবেই কিছুদিন থাকার পর ১৯৬৬ সালে ‘বহুরূপী’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ এসে যায়, তবে তারপরেও হাতে যে কাজ খুব ছিল তা বলা যায় না। (Jagjit Singh)
এই সময়েই জগজিতের আলাপ হয় চিত্রা সোমের সঙ্গে, যিনি পরে চিত্রা সিং হন জগজিতকে বিয়ে করে। ধীরে ধীরে তাঁদের জুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৭৭ সালে ‘দ্য আনফরগটেবল’ নামে জগজিৎ-চিত্রার এক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, ভারতীয় শ্রোতাদের মধ্যে যা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অ্যালবামের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও গাইতে শুরু করেন তাঁরা। ১৯৭০ ও ৮০’র দশকে গজলের সর্বাধিক জনপ্রিয় জুটি হয়ে ওঠেন তাঁরা। ১৯৮২ সালে ‘অর্থ’ ও ‘সাথ সাথ’ ছবিতে ব্যবহৃত তাঁদের গাওয়া গজলের সংকলন এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়, যা কালক্রমে হয়ে ওঠে তাঁদের সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবাম। তাঁরাই প্রথম ভারতীয় সুরস্রষ্টা যাঁরা ডিজিটাল মাল্টি-ট্র্যাক রেকর্ডিং পদ্ধতিতে গান রেকর্ড করেন। ১৯৮৭ সালে এই পদ্ধতিতে রেকর্ড করা তাঁদের প্রথম অ্যালবামটি ছিল ‘বিয়ন্ড টাইম’। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় ‘সাজদা’ অ্যালবামটি। (Jagjit Singh)
ভিডিও: ভারতীয় চলচ্চিত্রের তানসেন মহম্মদ রফি – জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
‘প্রেম গীত’ চলচ্চিত্রের জন্য গাওয়া ‘হোঁঠো সে ছুঁ লো তুম’, বা ‘হোঁশওয়ালো কো খাবর কেয়া’, ‘কোই ফারিয়াদ’, ‘হে রাম’-এর মতো তাঁর অসংখ্য গজল আজও মানুষের মনে অমর হয়ে আছে। যে গজল এতদিন রাজা-মহারাজা আর অভিজাতদের বিশেষ আয়োজনের ঘেরাটোপেই বন্দি ছিল, জগজিতের দৌলতে তা চলে আসে তামাম সাধারণ মানুষের নাগালে। জটিল গায়কীর ঘেরাটোপ থেকে গজলকে সহজিয়া সুরের এক অসামান্য জনপ্রিয়তায় পৌঁছে দেন তিনি। তাঁর প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী সংগীতজীবনে প্রকাশিত হয়েছে মোট ৮০-টি অ্যালবাম।
হিন্দি, পাঞ্জাবি, উর্দু, বাংলা, গুজরাটি, সিন্ধি ও নেপালির মতো একাধিক ভাষায় গান শুনিয়েছেন উপমহাদেশের শ্রোতাদের। ১৯৮৮ সালে গুলজারের পরিচালনায় ‘মির্জা গালিব’ সিরিয়ালে জগজিতের গাওয়া ও সুর করা গানগুলি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গালিবের কবিতাকে গানের মাধ্যমে পরিচিত করে তোলায় ১৯৯৮ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারও পান। ২০০৩ সালে সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতে অবদানের জন্য ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ দিয়ে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। (Jagjit Singh)
সংগীতের পাশাপাশি জগজিৎ ছিলেন একজন দায়িত্বসচেতন সমাজকর্মী ও শিল্পোদ্যোগী। রবিশঙ্কর ও অন্যান্য সংগীতশিল্পী ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে তিনি ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। শাস্ত্রীয় ও লোকশিল্পীদের তিনি নানাভাবে সাহায্য করতেন। মুম্বইয়ের সেন্ট মেরি স্কুলের লাইব্রেরি নির্মাণ, বম্বে হসপিটাল গঠন এবং ক্রাই, সেভ দ্য চিলড্রেন ও আলমা প্রভৃতি সংগঠনের কাজকর্মেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
গজলের প্রসঙ্গ উঠলেই সারা দেশের মানুষের কানে আজও ভেসে আসে তাঁর ওই অপরূপ কণ্ঠস্বর। তাই ২০১১ সালে আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেও আজও জগজিৎ সিং একইরকম জীবন্ত, একইরকম প্রাসঙ্গিক! জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Jagjit Singh)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।