‘সুকল্পবাবু, আপনাকে কি সামান্য বাংলা দিয়ে আপ্যায়িত করতে পারি?’। মে-মাসের খর নিদাঘ দুপুর। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। তিনি ফ্ল্যাটের দরজা খুলে নিয়ে গেলেন ভিতরে। আমার সঙ্গে ধানসিড়ি প্রকাশনার কর্ণধার শুভ বন্দ্যোপাধ্যায়। মাটিতে স্তূপাকার জীবনানন্দের (Jibanananda Das) পাণ্ডুলিপি। শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরিহিত বৃদ্ধের মুখে আপ্যায়নের এমন বায়না শুনে আঁতকে উঠেছি। অন্যদিকে পরক্ষণেই শুভর দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে, আপনার জন্য সরবত আনছি। আত্মরক্ষার্থে আমিও সরবত খাবো বলায়, অখুশি দৃষ্টিতে বাংলার গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঢুকে পড়লেন গভীর আলোচনায়।

ভূমেন্দ্র গুহ-র সঙ্গে আমার আলাপের সূত্র চিকিৎসা নয়, সাহিত্য। তিনি তখন পেশাদারি চিকিৎসা জগত থেকে দীর্ঘকাল স্বেচ্ছানির্বাসনে, ডুব দিয়েছেন জীবনানন্দের (Jibanananda Das) পাণ্ডুলিপির মূলানুগ পাঠোদ্ধারে। আর তাঁর চেতনার দ্বারে কড়া নাড়ছে ‘পিতৃদায়’, কীভাবে সঞ্জয় ভট্টাচার্যর কথাসাহিত্য এবং ডায়েরিকে গ্রন্থবদ্ধ করা যায়। এমত অবস্থায় একদিন বিকালে কবি রাহুল পুরকায়স্থর বাড়িতে ভূমেনদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। বহু দার্শনিক বিষয়ে তর্ক-আলোচনার ভিতর দিয়ে জন্ম হয় এক অসমবয়সী বন্ধুত্বের। পরে জেনেছি ভূমেন্দ্র গুহ প্রবাদ প্রতিম চিকিৎসক। পেশাগত নাম ডাঃ বি এন গুহ রায়। এম এস, এম সি এইচ। ছ-এর দশকে ভারতের প্রথম ওপেন হার্ট অপারেশনটিতে সামিল ছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজের থোরাসিক সার্জারি বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন ১৪ বছর।
সিউরিতে সরকারি হাসপাতালে কাজ করছেন তখন। উত্তাল সত্তর দশক। একদিন হঠাতই একদল যুবক ভূমেনদার বাড়িতে এসে হাজির। বোমা বাঁধতে গিয়ে এক কমরেডের হাতের আঙুল কাটা পড়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পুলিশের কড়া নজর। আহত কমরেডের হাতের আঙুল জুড়তে ভূমেনদা সুতোর বদলে ব্যবহার করেছিলেন নার্সের চুল। তাঁকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন, চুলকে আগুনে স্টেরিলাইজ করে দিলে নাকি তা হয়ে যায় এমন শক্তিশালী, তাকে আর ছেঁড়া যায় না। বছর বিশেক বাদে ভূমেনদা সিউড়িতে গেলে, সেই যুবক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। হাতের আঙুল ছিল অটুট।
শঙ্খবাবুর মুখে শুনেছি, ডাক্তারবাবুর চিকিৎসার নানা কাহিনি। একবার শঙ্খ ঘোষের একজন পরিচারিকা অসুস্থ হওয়ায় তাঁকে কেবল ওষুধ দিয়েই নয়, যাবতীয় পথ্যও কিনে দিতেন ভূমেনদা। এখানেই শেষ নয়, পরিচারিকার বাড়ি গিয়ে দেখে আসতেন তিনি সেইসব ওষুধ এবং পথ্য ঠিকঠাক খাচ্ছেন কী না।
ভূমেনদাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। আমরা যে ভূমেনদাকে পেয়েছি, সেই ভূমেন্দ্র গুহ সম্পূর্ন সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ। বিধাননগরের ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে বিড়ি সহযোগে বাংলা খেতে খেতে বিবিধ আতশ কাচে চোখ রেখে পাঠোদ্ধার করছেন জীবনানন্দর পাণ্ডুলিপি। আর এই জীবনানন্দেরই শেষ চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন ভূমেনদা।
তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহ। চিকিৎসাবিদ্যার সহচর এবং অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে সম্পাদনা করেন ‘ময়ূখ’ পত্রিকার। এই পত্রিকায় জীবনানন্দও লিখেছেন। তাঁর লেখা চাইতে গিয়েই ভূমেন্দ্র গুহ-র সঙ্গে কবির আলাপ। এরপর আলাপ গড়িয়ে কবির ভরসার পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি এবং ময়ূখ গোষ্ঠীর অন্যান্যরা। জীবনানন্দের আরেক স্বজন ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যর সঙ্গেও প্রায় আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়েছিলেন ভূমেনদা। সেই সূত্রেও জীবনানন্দকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তাঁর।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর দেশপ্রিয় পার্কের কাছাকাছি কোনও জায়গায় ট্রামের ধাক্কায় আহত হন জীবনানন্দ। কবি ভগিনী সুচরিতা দাশ এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যর নির্দেশে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে জীবনানন্দের সেবায় নিয়োজিত হন ডাক্তারির ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহ এবং তাঁর বন্ধুরা।
প্রধানত ভূমেনদার নেতৃত্বে এই চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের সেবাদল গড়ে ওঠে যাঁরা চিকিৎসক এবং নার্সদের পাশাপাশি কবির চিকিৎসায় যাতে কোনও ত্রুটি না ঘটে সেদিকে নজর রাখেন। কবির সুচিকিৎসার জন্য সঞ্জয় ভট্টাচার্যর উদ্যোগে ভূমেন্দ্র এবং তাঁর সাথীরা শনিবারের চিঠির সম্পাদক এবং কঠোর ‘জীবনানন্দ সমালোচক ও নিন্দুক’ সজনীকান্ত দাসের কাছে যান। সজনীবাবুর উদ্যোগেই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় হাসপাতালে গিয়ে কবির সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করে আসেন। হাসপাতালের হট্টগোলের মাঝখানে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই জীবনানন্দের বেডটিকে একটি পার্টিশনের মাধ্যমে আলাদা করে দেওয়া সম্ভব হয়। অসুস্থ কবি কিছুটা নিভৃতিতে থাকার সুযোগ পান।
বড় ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা, ভূমেন্দ্রবাবু ও তাঁর সেবাদলের বিনিদ্র রাত্রি জাগরণেও শেষ রক্ষা হয়নি। জীবনানন্দের মৃত্যু হয়।
তাঁর জীবনবাবুর জীবনের শেষ দিনগুলোর অমোঘ সাক্ষী ভূমেন্দ্র গুহ কি সেদিন জানতেন, জীবনানন্দের জীবনকৃতির একটা বিরাট অপ্রকাশিত অংশ তাঁর হাত ধরেই পাঠকের সামনে আসবে?
মেডিকেল কলেজের তরুণ ছাত্রটিকে একদিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সাহিত্যসাধনা থেকে দূরে থেকে নিজের পরিচয়কে কেবল ডাঃ বি এন গুহ রায়-এ বেঁধে রাখার। কারণ সংসারের দারিদ্রমোচনের জন্য তাঁকে চিকিৎসক হতে হবে আর সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁকে বলেছেন চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করে প্রতিষ্ঠার পথ আর সাহিত্যসাধনার নির্জন রাস্তা দুটো আলাদা এবং পরস্পর বিরোধী। সুচরিতা দাশ তাঁর আদরের ভাই ভূমেনকে নিয়ে গেছেন জীবনানন্দর কাছে। সেখানে তাঁকে শুনতে হয়েছে, দ্যাখ খুকি, ভূমেন ছেলেমানুষ, ওর মুখের ওপর একথা বলাতে তুই আমাকে বাধ্য করাসনি যে, ভালো লিখতে হলে, অন্তত এখন পর্যন্ত এ দেশে, বেঁচে থাকার সহজ সাফল্যগুলো সব ছাড়তে শিখতে হয়। অনেকটা কাপালিকের মতো হয়ে যেতে হয় প্রায়।
পেশাগত ভাবে ডাক্তারি ছাড়ার পর বেঁচে থাকার সহজ সাফল্যগুলো ছেড়ে জীবনানন্দের মৃত্যুশয্যার সাথী ভূমেন্দ্র গুহ, ঝাঁপ দিয়েছিলেন সাহিত্যসাধনায়। নিজের লেখালেখির থেকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও জীবনানন্দের অপ্রকাশিত রচনাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার ব্রত পালন করে গেছেন আমৃত্যু।
জন্ম- ১৯৮০, একদা পেশা ছিল যথাক্রমে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা। বর্তমানে মান্দাস প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক।