(Jyeshtha month) বৈশাখ ফুরিয়ে জৈষ্ঠ্য এলো। গাছে গাছে ফল পাকুড়ের বেলা এখন। মাঝে মাঝে এ’কথা মনে হয়, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ফারাক রয়েছে। জৈষ্ঠ্য যেন পরিণতির মাস। কোন সে পাকা ফলের গন্ধে নীল মাছিদের উড়ে আসার মাস। প্রতিটা মাস কী ভীষণ রকম স্বতন্ত্র, কী ভীষণ রকম নিজের মতো করে সুন্দর। (Jyeshtha month)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২]
আমাদের কৃষিজীবনের দিনক্ষণ বদলে গেছে বটে, গাঁয়ে গাঁয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায় থেকে থেকে মানুষেরা এখন আষাঢ়ে আর সব সময় ধান রুইতে পারে কই! বর্ষার ছায়া গড়াতে গড়াতে এখন শ্রাবণের দিনকে ছুঁয়ে থেকেছে কেবল। এই গ্রীষ্মদিনের মরে আসা পুকুর, খাল আর গোড়ালি ছোঁয়া জলের কাঁদড় কী প্রত্যাশায় তবু আকাশ দেখে। একেকদিন খুব কালো করে মেঘ করে। পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে থাকে কালোমেঘের তলায়। কোন শৌখিন তাঁতির হাতে বোনা ধনেখালি শাড়ির পাড় যেন।(Jyeshtha month)
এই পৃথিবীর গাছগাছালি আর কিছু না পারুক মানুষের পাতে আম জাম ফলসা তুলে দিতে পারে অনায়াসে। অনাবাদি সেসব মালিকানাহীন বাগান ফুরিয়ে গেল কবে! আশ্চর্য ভোজবাজির মতো উবে যেতে যেতে ক্রমে তা ব্যক্তিমালিকানার হিসেবের খাতা ভরিয়ে তুললো। তবুও একেকদিন ওই মেঠোপথ পেরিয়ে পরে থাকা জঙ্গলে ঢুকে পড়লে দেখা যায় খোকাখুকিরা পিয়াল কুড়োচ্ছে, লাল লাল কাজুবাদামের ফল দেখে মুগ্ধ হচ্ছে।
ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় গাছ, খড়ের চাল, পাখির বাসা। বিদ্যুৎ চমকে ওঠে আকাশের এপার থেকে ওপারে। বৃষ্টি আসে। তবু সে কি আর বর্ষার জল! মজে আসা পুকুরের কাদায় ডুবে থাকা মাছেদের খানিক শরীর জুড়োয়। মাটির মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা বৃক্ষশিশুর ঘুম ভাঙে। গিমেশাকের জাজিম তো মেঘের প্রত্যাশী নয়! সে যেন সত্যেন দত্তের ‘চম্পা’র মতো। (Jyeshtha month)

কিন্তু এই জৈষ্ঠ্যের মাঠে মাঠে মেঘের জল পড়তে না পড়তেই কত যে শাকপাতারা মাথা তুলে দাঁড়ায়! আসলে সব শাকেদের কি আর পরিচিতি আছে! আবাদি শাকপাতাদের সঙ্গে তাদের তুলনা চলে না। তারা যেন ভারী নিরাভরণ, অথচ কী লাবণ্য! এই মাঠ, কাঁদড় আর ডাঙাজমিদের সঙ্গে যাদের বহুদিনের সম্পক্কো তারাই কেবল এদের খোঁজ রাখে। (Jyeshtha month)

খানিক ছায়ায় ছায়ায় যেখানে আমরুল শাকেদের বিছানা পাতা! সেখানে চুপড়ি ভরে শাক তোলে ও পাড়ার সেজদিদি। গরম ভাতের পাতে এই গুমশুমি গরমের দিনে আমরুল শাকের টক খেতে যে কী সুখ! শুধু কি আর আমরুল! শুসনি, গাথ ফড়োনি, নুনিয়া…শাকপাতার শেষ নেই। কেউ কেবল তারে চেনে, কারো কাছে সে আগাছা। শাকভাতের কাছে মানুষের ঋণ তাই ফুরোয় না। ফুরোবার নয়। (Jyeshtha month)

এই পৃথিবীর গাছগাছালি আর কিছু না পারুক মানুষের পাতে আম জাম ফলসা তুলে দিতে পারে অনায়াসে। অনাবাদি সেসব মালিকানাহীন বাগান ফুরিয়ে গেল কবে! আশ্চর্য ভোজবাজির মতো উবে যেতে যেতে ক্রমে তা ব্যক্তিমালিকানার হিসেবের খাতা ভরিয়ে তুললো। তবুও একেকদিন ওই মেঠোপথ পেরিয়ে পরে থাকা জঙ্গলে ঢুকে পড়লে দেখা যায় খোকাখুকিরা পিয়াল কুড়োচ্ছে, লাল লাল কাজুবাদামের ফল দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। (Jyeshtha month)

আমি এক বৃদ্ধাকে চিনতাম, সেই কোন বাংলাদেশের গ্রামে ছিল তার শ্বশুরের ভিটে, স্বামীর ভিটে। তখন নেহাতই বালিকা সে। তবু তার স্পষ্ট মনে পড়ে, এমন জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুরে এক পুটলি চিড়ে-মুড়ি দিয়ে তার শাশুড়ি একখানা বাটি হাতে ধরিয়ে বলতো, “আমগাছের তলায় বইস্যা থাক। আম পড়লে চিড়া দিয়া খাইস”। (Jyeshtha month)

অনেক ভেবে দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে দারিদ্র্য তো এই পোড়াদেশে নতুন কিছু নয়! তবুও সেই আম-কাঁঠালের বাগান মানুষকে স্বাদু ফলের সাহচর্য দিয়েছে। কাঁঠালের রস দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে মাছি তাড়ানো দাওয়া কমতে কমতে মুছে গেছে কিনা আমার ভালো জানা নেই। চিড়ে মুড়ি খই দিয়ে সাজানো জৈষ্ঠ্যদিন অরণ্য ষষ্ঠী’র ব্রতকথায় ডুবে যেতে যেতে খেজুর আর করমচা’র কাছে ফিরে যায়। (Jyeshtha month)

এই ফিরে যাওয়া কত স্বাভাবিক ছিল একদিন। গাছগাছালির মতো ছায়া আর কে দিতে পারে! সেই ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়া মানুষই তো ফুলকাটা থালায় চাটাইয়ে আমসত্ত্ব বিছিয়ে দিত! শুকিয়ে আসা আমসত্ত্বের শরীরে তখন নকশার আলপনা। বেলা ফুরিয়ে আসার আগে আগে সেসব যত্ন করে তুলে রাখা হাত কত যত্নে রৌদ্রের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল ভরা গ্রীষ্মেও। কেবল শূন্যতাকেই দেখবো, তাও কি হয়! জৌষ্ঠ্যের দিনের কাছে ফিরে ফিরে আসি তাই রৌদ্রের আশ্বাসে, ফলপাকুড়ের গন্ধে। আম কাঁঠালের ছায়ার কাছে ফিরে যেতে কার না ইচ্ছে করে! (Jyeshtha month)
কুমড়ো আর আমসি দিয়ে মুরগি
উপকরণ : মুরগি ছোটো টুকরো করে কাটা, মিষ্টি কুমড়ো, আমসি অল্প পরিমাণে, পেঁয়াজ দুই তিনটি, নুন, সর্ষের তেল, জিরে, আদা, লঙ্কা, ভাজা জিরের গুঁড়ো, পুঁই ডাঁটা এবং খুব সামান্য পাঁচ ফোড়ন।
পদ্ধতি : মুরগি ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখুন। জিরে-আদা-লঙ্কা বেটে নিন। কুমড়ো ডুমো ডুমো করে কেটে নিন। আমসি জলে ভিজিয়ে রাখুন। পেঁয়াজ কুচি করে নিন। কেটে রাখা কুমড়ো সাঁতলিয়ে তুলে রাখুন।

কড়াইয়ে তেল গরম হতে দিন। গরম হলে কুচিয়ে রাখা পেঁয়াজ দিয়ে ভাজুন। নরম হয়ে এলে বাটা মশলা, নুন আর হলুদ দিয়ে কষিয়ে নিন। মশলা কষে গেলে মুরগি দিয়ে ভালো করে কষান। সব ভালো করে কষানো হয়ে গেলে গরম জল দিন। ফুটে উঠে খানিক সেদ্ধ হয়ে এলে, পুঁই ডাঁটা দিন এবং আমসি দিন। রান্না প্রায় শেষের দিকে এগোলে আগে থেকে সাঁতলে রাখা কুমড়ো দিন। এবং আঁচ বাড়িয়ে দিন। কুমড়ো সেদ্ধ হবে কিন্তু গলে যাবে না। বেশ মাখামাখা রান্না হবে। শেষে স্বাদ অনুযায়ী অল্প চিনি আর ভাজা মশলা দিন। গরমকালে একেকদিন মন্দ লাগবে না।
পাকা-করলার তিতঝুরি
উপকরণ : পাকা করলা (কাঁচাও দিতে পারেন), মটর ডাল অল্প, সর্ষের তেল, মেথি, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, ঘি, আদাবাটা খুব অল্প, চিনি।

পদ্ধতি : মটর ডাল ভিজিয়ে রাখুন, সারারাত ভেজালে খুবই ভালো। নরম হয়ে যাওয়া ডাল মসৃণ করে বেটে নিন। করলা ধুয়ে সরু সরু করে কেটে নিন। কড়াইয়ে সর্ষের তেল দিন। গরম হলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তেলটা কড়াইয়ের গায়ে লাগিয়ে নিন। অন্যদিকে সামান্য নুন দিয়ে মটর ডাল বাটা ফেটিয়ে হাতে চেপে চেপে চাপটির মতো কড়াইয়ের গায়ে লাগিয়ে লাগিয়ে দিন। একটু পরে উল্টেপাল্টে ভেজে তুলে রাখুন।

পাকা-করলার তিতঝুরি
ওই কড়াইয়েই তেজপাতা মেথি শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে করলা গুলি ছাড়ুন। সামান্য নেড়েচেড়ে নুন দিয়ে ঢাকা দিন। পাকা করলা নরম, সহজেই সিদ্ধ হয়ে যাবে। বেশ ভাজা ভাজা হলে ডালের চাপড়গুলো ভেঙে ভেঙে দিয়ে দিন। ভালো করে মিশিয়ে অল্প আদার রস আর সামান্য চিনি দিন। ঘি ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। করলার পাকা বীজগুলি শুকিয়ে আবার মাটিতে বুনে দিতে পারেন। গরম ভাতের প্রথম পাতে এই তিতাঝুরি ভালো লাগে।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Facebook, Wikimedia Commons, Amazon.in, Girl in the Green, Village Square,
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।