[১]
১৮৮৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর বর্ধমান দেবীপুরের দত্তপাড়া গ্রামে জন্ম জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের (Jyotishchandra Ghosh)। বাঁকুড়ায় মামা বাড়িতে কেটেছে ছোটোবেলা। পুরুলিয়া জেলা স্কুল থেকে স্কলারশিপ নিয়ে এন্ট্রান্স পাশ করে চলে আসেন কলকাতায়। এলবার্ট কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন, কিন্তু প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ইংরাজিতে এম.এ পরীক্ষা আর দেওয়া হল না। ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ছিল অগ্রণী সচেতন ছাত্রদের সেইসময়ে স্বাভাবিক প্রবণতা। বঙ্গে তখন ‘জাতীয় শিক্ষা সংসদ’ বা National Council Of Education তৈরি করা হয়েছে। নিবেদিতা প্রমথনাথ মিত্র বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী আরও সবাই বিদেশী শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করার চেষ্টা করেন। তৈরি হয় জাতীয় স্কুল ও কলেজ এবং অরবিন্দ ঘোষ বরোদা থেকে এসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন। জ্যোতিষ ঘোষ এবং কিছু ছাত্র প্রেসিডেন্সী কলেজে এম.এ পরীক্ষা না দিয়ে যোগ দিল জাতীয় শিক্ষা সংসদের কলেজে। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে তাঁর আলাপ জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের জীবনে একটি মাইল ফলক। তাঁর জীবন দর্শনে সমাজতন্ত্রের আধুনিকতার সঙ্গে অরবিন্দের আধ্যাত্মিকতাবাদের বিরল সংমিশ্রণ দেখা গেছে। কিন্তু আশ্চর্য এক উদারতায় তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন জীবন প্রণালীতে। তিনি অরবিন্দের শিষ্যত্ব নিয়েছেন যে মননে সেই মনন দিয়েই তিনি ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র বঙ্গানুবাদ করেছেন। অরবিন্দের ধর্মবিশ্বাসের একনিষ্ঠ সমর্থক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষকে হুগলী জেলার সিপিএম সাংসদ বিজয় মোদক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি অরবিন্দ আশ্রমে গেলেন না কেন?’ তিনি অম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দেশের অগণিত জনগনের মুক্তিই আমার কাছে কাম্য – তার আগে আমার মুক্তি কামনা করি না।’ (বিজয় মোদকের লেখা – বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র : আমাদের মাস্টারমশাই)।
প্রাদেশিক সম্মেলন নিয়ে উত্তেজিত কলকাতা তথা বঙ্গের নেতারা। মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা চুঁচুড়ায়। অরবিন্দ ঘোষ চুঁচুড়ায় এসে নামবেন। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক স্টেশনে। আয়োজন করা হয়েছে বিরাট শোভাযাত্রা অরবিন্দ ঘোষের জন্য। পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক অরবিন্দ ঘোষকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাবেন ‘ডাচভিলা’, দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের বাড়ি।
৬ই সেপ্টেম্বর ১৯০৯। অরবিন্দ ঘোষ সঙ্গী সাথী নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেন হাওড়া থেকে। চুঁচুড়া যাবেন। অনেকেই বারণ করেছিল এক্ষুনি এক্ষুনি কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে। পুলিশের নজর তো আছেই। ৬ই মে জেল থেকে সবে ছাড়া পেয়েছেন। কলকাতায় তখন প্রচন্ড গরম। বড় সাহেবরা অনেকেই চলে গেছেন দার্জিলিং। দার্জিলিং-এ বাংলার চিফ সেক্রেটারি এফ ডব্লিউ ডিউকের কাছে একটি কনফেডেন্সিয়াল চিঠি গেল (Confidential No. 3135SB dated 6th May,1909)… “Beachcroft delivered judgment in the Alipore Case at about 11 o’clock this morning… Arabindo, as usual, looked stoically indifferent, but seemed well pleased with himself when he was allowed to walk out and leave the court.” প্রাদেশিক সম্মেলন নিয়ে উত্তেজিত কলকাতা তথা বঙ্গের নেতারা। মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা চুঁচুড়ায়। অরবিন্দ ঘোষ চুঁচুড়ায় এসে নামবেন। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক স্টেশনে। আয়োজন করা হয়েছে বিরাট শোভাযাত্রা অরবিন্দ ঘোষের জন্য। পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক অরবিন্দ ঘোষকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাবেন ‘ডাচভিলা’, দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের বাড়ি। অরবিন্দ ঘোষ ডেকে নিয়েছিলেন জ্যোতিষচন্দ্রকে তাঁর গাড়িতে। রিজলি সার্কুলার অনুযায়ী কোনও রাজনৈতিক জমায়েতে কোনও কলেজ বা স্কুলের ছাত্র বা শিক্ষক যোগ দিতে পারবেন না আইনত। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই মাস্টারমশাই জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ তাঁর ছাত্রদের নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন প্রাদেশিক সম্মেলনে এবং অরবিন্দ সান্নিধ্যে। এই সান্নিধ্য তাঁর জীবনদর্শনে ও জীবনপথে আমূল পরিবর্তন সূচিত করেছে। জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের মধ্যে যোগ সাধনার আত্মশক্তি এবং মানব মুক্তির সংগ্রাম এই দুয়ের আধার তৈরি হয়েছে তাঁর ভেতর। কলেজ কর্ত্তৃপক্ষ ছাত্রদের পাঁচ টাকা করে জরিমানা করে ছেড়ে দিলেও তাদের মাস্টারমশাইকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল। মাস্টারমশাই তারপর বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। ইংরাজি ও ইতিহাসে ডবল এম.এ তিনি, ইংরাজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী তাঁকে বাঁকুড়া থেকে এনে কলকাতার রিপন কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হতে সহায়তা করেন। জ্যোতিষচন্দ্র কলকাতায় একদিকে বিপ্লবী গোপন সংগঠনের কাজ করে চলেছেন আর অপর দিকে রিপন কলেজের অধ্যাপনা। কিন্তু সেখানেও বাধ সাধল। রিপন কলেজের বিল্ডিং গ্রান্ট এল ব্রিটিশ সরকার থেকে কিন্তু সঙ্গে একটি শর্ত – জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ যদি অধ্যাপক হিসাবে থাকে তা’হলে এই গ্রান্টের টাকা কলেজ কর্ত্তৃপক্ষকে দেওয়া যাবে না। ব্যস, কলেজ কর্ত্তৃপক্ষের অনুরোধে চাকরি চলে গেল মাষ্টামশাইয়ের। মনে রাখা জরুরি পুলিশ তখনও পর্যন্ত মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একবারও গ্রেপ্তার করেনি। ১৯০৮ সালের ২রা মে কলকাতার মুরারীপুকুর বাগানের বিপ্লবীদের গোপন ডেরা থেকে চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী গ্রেপ্তার করে ১৪ জন বিপ্লবীকে। ৩০ আগস্ট রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে জেলের ভেতর খুন করেন কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বোস। কানাইলালের ফাঁসি উত্তাল করেছিল চন্দননগর চুঁচুড়া। মুরারীপুকুর বোমা মামলা হয়ে গেছে, ১৯০৯ এর ১১ ডিসেম্বর খিদিরপুর ডক থেকে জাহাজ ভাসল আন্দামানের উদ্দেশ্যে দ্বীপান্তর সাজাপ্রাপ্ত বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো সমেত একঝাঁক বিপ্লবী নিয়ে। ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়ে গেছে ১৯০৮ সালের ১০ আগস্ট। এই জ্বলন্ত বাংলার মানচিত্র দিয়ে শান্ত হেঁটে চলেছেন মাস্টারমশাই। একটু তফাতে থেকেছেন যেন! দার্শনিক মন তাঁর এই স্থানিক উত্তেজনার ভেতর থেকে এক বৃহত্তর মুক্তির দিশা দেখার চেষ্টা করছিলেন। অনুসন্ধান। যোগাযোগ আলোচনা সবই চলছে গোপনে। পুলিশের নজরদারিও চলছে। জানেন তিনি। যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে না মাস্টারমশাইকে এই বহ্নিশিখায়। যদিও তাঁর কথাবার্তায় ফুটে উঠত সশস্ত্র সংগ্রামের পথের দিশা। ১৯১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাষ্টামশাইয়ের অনুগত ছাত্রদের মধ্যে একজন ননীগোপাল মুখোপাধ্যায় অত্যাচারী পুলিশ অফিসার শ্রীশ চক্রবর্তীকে হত্যা করেন এবং ডালহৌসিতে মি:ডেনহামের গাড়িতে বোমা ফেলেন। ননীগোপালের ১৪ বছর আন্দামান দ্বীপান্তর শাস্তি হয়। এই প্রথম বৃটিশ পুলিশ মাষ্টামশাইকে গ্রেপ্তার করে যেহেতু তাঁর ছাত্র ননীগোপাল। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কোনও প্রমাণাভাবে মাষ্টামশাইকে মুক্তি দেওয়া হয় কয়েকদিন জেল হেফাজতে রেখে।

চুঁচুড়া সোম ট্রেনিং ইনস্টিউশনে কিছুদিন পড়িয়ে জ্যোতিষচন্দ্র যোগ দিলেন উত্তর চন্দননগরের গড়বাটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে। চন্দননগর আর চুঁচুড়া তখন বিপ্লবীদের বিচরণক্ষেত্র। চন্দননগর থেকে রাসবিহারী বোস তখন সারা ভারতে বিপ্লব সংগঠনে যুক্ত। চন্দননগরে শ্রীষচন্দ্র ঘোষ, মতিলাল রায়, মনিন্দ্রনাথ নায়েক, নরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, প্রমুখ বিপ্লবীরা অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। চুঁচুড়ায় মাষ্টামশাইয়ের তত্ত্বাবধানে গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, হরিনারায়ণ চন্দ্র প্রমুখ এক ঝাঁক তরুণ। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে বৃটিশ পুলিশবাহিনী ফরাসী সরকারের অনুমতি নিয়ে সারা চন্দননগর এক ব্যাপক তল্লাসি চালায়। ম্যাপ, নথী, চিঠি এবং কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। সেখানে মাষ্টামশাইয়ের লেখা বিপ্লব সম্পর্কে কিছু প্রবন্ধ তারা পায়। ১৯১৭ সালের ৩ জানুয়ারি মাস্টারমশাই গ্রেপ্তার হলেন ভারত রক্ষা আইনে। মাষ্টামশাইয়ের দীর্ঘদিনের যোগভ্যাস এবং ঐশি শক্তির এক বিরলতম উদাহরণ দেখা গেল যা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাসে কখনও উল্লেখিত হয়নি। তাঁকে প্রথমে পাঠানো হল রাজশাহী জেলে। সেখানে তিনি ছ’দিন অনশন ও মৌনব্রত নিলেন এবং সমাধিস্থ হলেন। বৃটিশ পুলিশ অত্যাচার করেও তাঁর ব্রত ভাঙতে পারেনি। ইলেকট্রিক শক, বরফের উপর শুইয়ে রাখা, কম্বল ধোলাই সব হল। তিনি স্থির ও চুপ। ওখান থেকে বহরমপুর পাগলা গারদে আড়াই বছরের বেশি পঙ্গু হয়ে শুয়ে থাকেন নিশ্চুপ। নল দিয়ে তরল খাবার শুধু প্রাণবায়ু টিকিয়ে রেখেছে। দেশে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর এই শোচণীয় অবস্থার কথা। খবর পৌঁছে গেল কোপাই নদীর হাওয়ায় ভেসে শান্তিনিকেতনের ঐ দীর্ঘদেহী মানুষটির কানে।
ঋণ স্বীকার :
১। বিপ্লবাচার্য অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ রচনাসংগ্রহ, অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ জন্মশতবর্ষ কমিটি, প্রকাশকাল ১৯৮৪।
২। অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ জন্মশতবর্ষ স্মরণিকা।
৩। অবিস্মরণীয়: গঙ্গানারায়ন চন্দ্র
৪। স্মরণীয় স্মরণ: অমলকুমার মিত্র
৫। সূর্য সেন চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম: অমলেন্দু দে
স্মৃতিচারণমূলক লেখা: শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়, গনেশ ঘোষ, গঙ্গানারায়ন চন্দ্র, প্রতাপ বড়াল, বিজয় মোদক, বিনয় চৌধুরী। এ ছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।
আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিস্মৃত বাঙালি রজত চক্রবর্তীর চর্চার প্রিয় বিষয়। বর্তমান পত্রিকা, ভ্রমণআড্ডা, হরপ্পা, পরম্পরা, মাসিক কৃত্তিবাস, নতুন কৃত্তিবাস ইত্যাদি নানা পত্রিকায় তাঁর লেখালেখি দেখা যায়। পঞ্চাননের হরফ, গৌরপ্রাঙ্গনের গোরা, আশকথা পাশকথা, পান্থজনকথা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে 'ধুলো মাটি বাংলা' প্রকাশিতব্য।