ভারতীয় পুরাণে মূল দেবতা তেত্রিশ জন বা তেত্রিশ কোটি—ত্রয়স্ত্রিংশত ইত্যেতে দেবাঃ। তাণ্ড্যব্রাহ্মণে ও বৃহদারণ্যক-উপনিষদে অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি এবং ইন্দ্র—এই তেত্রিশ জন দেবতা। মহাভারতে নীলকন্ঠের টীকাতেও তাই দেখা যায়। রামায়ণে ইন্দ্র ও প্রজাপতির জায়গায় অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে গ্রহণ করা হয়েছে। তেত্রিশ কোটি দেবতা, কোনও দেবী সেখানে নেই।
ভারতীয় শাস্ত্র বলে, মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে চায়। মোক্ষলাভ তার অন্তিম পুরুষার্থ। এই জগতে রয়েছে ত্রিবিধ দুঃখ—আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক। এই দুঃখ-শোক থেকে মুক্তির জন্য তাই ইহলোকবাসী রামচন্দ্র দুর্গার উপাসনা করেন। যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের কঠিন সময়ে মনে মনে ত্রিভুবনেশ্বরী দুর্গার স্তুতি করেছিলেন। সকল প্রকার দুর্গতি থেকে উদ্ধার করেন বলে উপাসকগণ ভগবতীকে দুর্গা-নামে উপাসনা করে থাকেন—দুর্গাত্তারয়সে দুর্গে তত্ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ। অপরাজেয় অসুর দুর্গকে নাশ করেছিলেন বলে দেবী হলেন দুর্গা। ‘দুর্গ’ মানে হল অশক্যগমন, অসাধ্যগমন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শুরুতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গার স্তুতি করতে বলেন। সেই স্তুতিতে কীর্তিত বহু শব্দ পরম ব্রহ্মের বাচক।
বঙ্গদেশে যে দুর্গাপূজা হয় তার ক্যানভাস কিঞ্চিৎ অভিনব ও বিস্তৃত। সেখানে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছেন। তাঁর পাশে রয়েছেন সিদ্ধিদাতা গণেশ, ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী, বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী যিনি দণ্ডনীতি বা পলিটিক্সের সৃষ্টি করেছিলেন—সসৃজে দণ্ডনীতিং সা ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতা। আর রয়েছেন কার্তিক। মাথার উপর বাবা মহাদেব। এক কোণে গণেশের কলাবউ—যদিও গণেশের দুই স্ত্রী ঋদ্ধি ও সিদ্ধি যাঁরা পূর্বে কুবেরের সহগামিনী ছিলেন। আর রয়েছে বাহন—সিংহ, মোষ, ইঁদুর, পেঁচা, হাঁস, ময়ূর।
গণেশ ছিলেন শূদ্রদের দেবতা, এমন আখ্যান পাওয়া যায়। এক বার শূদ্র ও নারীদের মিছিল দেখে ভয় পেয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি দেবী দুর্গার শরণ নিলে বিঘ্নেশ্বর গণেশকে সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতীয় পুরাণের বহু পথ পেরিয়ে সেই গণেশ হয়ে ওঠেন বিঘ্ননাশক। শাস্ত্রে তাই তিনি দ্বিদেহক, তিনি প্রণম্য। দেবতা ‘শ্রী’ হলেন সম্পদ, তিনি লক্ষ্মী—শুভ আদর্শ। সরস্বতী বিদ্যার দেবী। চার বিদ্যা—আন্বীক্ষিকী (যুক্তিশাস্ত্র), ত্রয়ী (তিন বেদ), বার্তা (অর্থবিদ্যা) ও দণ্ডনীতি (রাজনীতি)। তাঁর কাছেও প্রণত হন ভক্তকুল। মহাদেব বা শিব হলেন প্রযতি, তিনি জগতের হিত কামনা করেন। কিন্তু কার্তিক কে? তাঁকে কেন প্রণাম করতে গিয়ে হোঁচট খান ভক্তরা?
আসলে কার্তিক একটি প্রত্যয়। তাঁর পিতা কে, এ নিয়ে বহু ধন্দ আছে। কোথাও তিনি মহাদেবের পুত্র, তাই পার্বতীরও সন্তান। আবার কোথাও অগ্নির পুত্র, তাঁর নাম স্কন্দ। কখনও তাঁর মাতা গঙ্গা বা স্বাহা; কখনও হিমালয়, কাঞ্চনকুণ্ড কিংবা ছয় কৃত্তিকা। বেশ জটিল বিষয়।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বলে, কার্তিক মহাদেবের তেজে গ্রহণ করেন। পার্বতীর সঙ্গে বিহারকালে মহাদেবের বীর্য পৃথিবীতে পতিত হয়। তিনি সেই তেজ ধারণ করতে না পেরে অগ্নিতে নিক্ষেপ করেন। অগ্নিও তা সহ্য করতে না পেরে তা গঙ্গায় ফেলে দেন। তার পর ভাসতে ভাসতে শরবনে কার্তিকের জন্ম। কৃত্তিকারা তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে নিজেদের স্তনদুগ্ধে লালন পালন করেন। সারস্বতোপাখ্যানেও এমন উল্লেখ আছে। তবে সেখানে শরবনে কার্তিকের জন্ম নয়। গঙ্গা মহাদেবের বীর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে তা হিমালয়ে পরিত্যাগ করেন, সেখানেই কার্তিকের জন্ম।
অগ্নি সপ্ত ঋষির পত্নীদের দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন। দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন। তিনি একে একে ঋষিপত্নীদের রূপ ধারণ করে অগ্নি সঙ্গে মিলিত হন। এক এক বার স্বাহা অগ্নির শুক্র নিয়ে কাঞ্চনকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। এই ভাবে ছ বার। স্বাহা বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতীর রূপ ধারণ করতে সক্ষম হননি। এই সম্মিলিত শুক্র থেকে স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিকেয়র জন্ম। তাঁর ছ খানা মাথা।
আবার আর একটি আখ্যান থেকে জানা যায়, কার্তিকের জন্ম তারকাসুরকে বধ করার নিমিত্ত। দেবতারা তারকাসুররের দাপটে ভয়ে কুঁকড়ে থাকতেন। তাই কার্তিকের আবির্ভাব। কার্তিক দুই অর্থে দেবসেনাপতি। তিনি দেবতাদের দেনাপতি আবার প্রজাপতির কন্যা দেবসেনার পতি। তারকাসুরকে বধ করার পর পার্বতী কার্তিককে বসুন্ধরা ভোগ করার আশীর্বাদ দেন। কার্তিক তখন দেবতাদের পত্নীদের সঙ্গে সঙ্গম করতে শুরু করেন। এতে করে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্গাকে নালিশ জানালে দেবী দুর্গা পুত্রকে নিরস্ত করেন। কার্তিক যে কোনও স্ত্রীলোকে উপগত হতে গেলেই সেই নারীতে দুর্গার প্রতিমূর্তি দেখেন এবং অজাচারের ভয়ে পালিয়ে আসেন। এই ভাবে কার্তিককে ব্রহ্মচারী বা কুমার বানিয়ে দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতে কার্তিকের নাম মুরুগান, সেখানে তাঁর প্রেমিকা ও স্ত্রী হলেন বল্লী। সে আখ্যান ভিন্ন। শিবপুরাণে আছে, শিবের ঔরসে উমার গর্ভে কার্তিকের জন্ম, যেখান থেকে কালিদাস কুমারসম্ভব মহাকাব্য রচনা করেছিলেন।
মহাভারতে আছে, স্কন্দ বা কার্তিকেয় হলেন সহস্রশীর্ষ, অনন্তরূপ, ঋতস্য কর্তা ও সনাতনানামপি শাশ্বত—যে শব্দগুলি পরমব্রহ্মেরই বাচক। স্কন্দ শুধু তারকাসুরকে নয়, মহিষাসুরকেও বধ করেছিলেন।
অথচ আমরা দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুরকে দেখি। কালিকাপুরাণে কাত্যায়ন মুনির শাপে নারী দুর্গার হাতে মহিষ নিহত হন। কার্তিক নয়, তাঁকে বধ করছেন দেবী দুর্গাই। এক্ষেত্রে মহাভারত নয়, কালিকাপুরাণকে মানেন আপামর বাঙালি। মণ্ডপে তাই মহিষাসুরকে দুর্গা বধ করছেন, এই চিত্রে দেখা যায়–পাশে মিটিমিটি হাসছেন মহাভারতে মহিষাসুরধকারী কার্তিক। কে এই মহিষরূপী অসুর?
‘অসুর’ শব্দটি অত্যন্ত ভারি ও সমৃদ্ধ। সাধারণত সুরবিরোধী বা দেববিরোধীদের অসুর বলা হয়। দেবাসুরের যুদ্ধে দেখা যায়, অসুররা মৃতকে বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। তাঁদের সেই মন্ত্র শিখিয়েছিলেন দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য। দেবগুরু বৃহস্পতিপুত্র কচের সঙ্গে দেবযানীর বিবাহ হয় না, ক্ষত্রিয়রাজা যযাতি ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর পাণিগ্রহণ করেন। দেবযানীর সঙ্গে যযাতির অনুগমন করেন অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাও। শর্মিষ্ঠার সন্তান থেকে যাদব, পৌরব-কৌরবদের উৎপত্তি। অসুর মানেই খারাপ, এমন সাধারণীকরণ না করাই ভাল। ঋগ্বেদে ‘অসুর’ শব্দের অর্থ প্রাণবান, বলবান এবং ক্ষেপ্তা। জেন্দাবেস্তায় ‘অহুর’ হল The Life giver and the Omniscient, God। ঋগ্বেদও বলছেন, অসুরঃ সর্ব্বেষাং প্রাণদঃ (১.৩৫.৭)।
আমরা জানি, মহিষ হল পশু। কিন্তু মহিষের অন্তর্গত যে ধাতু ‘মহ্’, তার অর্থ হল পূজা। রম্ভ মহিষের পিতা। মহাভারতে আছে, অনুহ্রাদ বা অনুহ্লাদ হলেন মহিষের পিতা। অনুহ্রাদ হিরণ্যকশিপুর তৃতীয় পুত্র। দেবীভাগবত অনুযায়ী, মহাদেবের বরে রম্ভ নামক অসুরের এক ত্রিলোক-জয়ী পুত্র জন্মান। তিনিই দুর্দান্ত মহিষাসুর। দেবতাদের তাড়িয়ে স্বর্গ অধিকার করেন। তখন দেবতারা বিষ্ণুর শরণ নেন। বিষ্ণু জানান, এই দুর্দান্ত মহিষকে কোনও পুরুষ হত্যা করতে পারবেন না। দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে এক দেবীর উৎপত্তি হয়। সেই দেবীকে বিবাহ করার জন্য মহিষ দূত পাঠান। দূতকে তিরস্কার করে দেবী মহিষের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং তাঁকে হত্যা করেন। কালিকাপুরাণে অবশ্য ভিন্ন কথা আছে। মহিষ দেবীর পূজা করতে আরম্ভ করেন। একদিন দেবী তাঁর কাছে আবির্ভুত হলে মহিষ বলেন, তিনি যেন সর্বযজ্ঞে পূজিত হন এবং দেবীর পদসেবা করার অধিকার পান। দেবী উত্তরে জানান, সমস্ত যজ্ঞভাগ দেবতাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছে, আর কিছুই অবশিষ্ট পড়ে নেই; তবে তুমি আমার পদসেবায় নিযুক্ত থাকবে এবং যেখানে আমার পূজা হবে, সেখানে তুমিও পূজা পাবে।
ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রজাপতি ও ইন্দ্রবিরোচন সংবাদে আছে, প্রজাপতির কাছে দেবগণের প্রতিনিধি হয়ে ইন্দ্র এবং অসুরদের হয়ে বিরোচন গেলেন আত্মা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে। সমস্ত কিছু শুনে দুজনেই যখন প্রস্থান করছেন, প্রজাপতি মনে মনে বললেন, আত্মাকে উপলব্ধি না করেই দুজনে চলে গেল। এদের মধ্যে যে একেই উপনিষদ বা গুহ্যজ্ঞান বলে গ্রহণ করবে সে দেব হোক বা অসুর, বিনাশপ্রাপ্ত হবে। সেই বিরোচনের উত্তরসূরী হলেন মহিষাসুর আর দেবগণের সম্মিলিত তেজের নাম দুর্গা।
তাই দেবী দুর্গার পাশাপাশি অসুরও পূজা পান। কেউ কেউ বলেন, মহিষাসুর কোনও অশুভ শক্তি নন, তিনি পরাজিত মাত্র। বিপথগামী দেবতাদের শিক্ষা দিতেই নাকি ভক্ত ও নিষ্ঠাবান মহিষাসুরকে বেছে নিয়েছিলেন দেবী। তাই মহিষাসুর আজও জীবিত ও প্রাণবন্ত। দেবী দুর্গার পূজার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও স্মরণীয়, সহিষ্ণুতার দেশ বাংলা তথা ভারতে।
শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।