আধুনিক বাংলাসাহিত্যে কিছুদিন ধরে একটা বিদ্রোহের সুর শোনা যাচ্ছে এবং সে সুর ক্রমাগতই উদারা মুদারা থেকে তারায় উঠেছে। বিদ্রোহ ব্যাপারটা জীবনেই হোক আর সাহিত্যেই হোক, অধিকাংশ সময়েই সুস্থ লক্ষণ, তবে পতাকার রঙ বিচার করা দরকার। কারণ যা অভিনব তা সত্য বা মূল্যবান নাও হতে পারে। ইদানীংকালের সাহিত্যের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন তাঁদের অনেকের মুখেই শুনতে পাই যে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে উপন্যাসে এই নোতুন ধারার সার্থক রূপ দেখতে পাওয়া যায়। আর বিদ্রোহের ব্যাপারেও তিনি হদ্দমুদ্দ করেছেন। (Little Magazine)
তাই তাঁর কতকগুলি ছোটগল্প ও একটি উপন্যাসকে অবলম্বন করে তাঁর সম্পর্কে এবং সেই সঙ্গে সাহিত্য এবং বিদ্রোহ সম্পর্কে গোটাকয়েক কথা বলার জন্য এই প্রবন্ধের অবতারণা। সন্দীপনবাবুর যে রচনাগুলির সঙ্গে আমি পরিচিত সেগুলি হল “ক্রীতদাস ক্রীতদাসী” আর “সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য” নামে দুটি গল্প সংগ্রহ, “এখন আমার কোন অসুখ নেই” নামের উপন্যাস, আর ইংরিজীতে অনূদিত গল্প “Revolution and Rajmohon” (New Writings in India, Penguin Books)। মূল গল্পটি আমি দেখিনি।
ইদানীংকালের সাহিত্যের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন তাঁদের অনেকের মুখেই শুনতে পাই যে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে উপন্যাসে এই নতুন ধারার সার্থক রূপ দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু এই রচনাগুলির সম্বন্ধে কিছু বলবার আগে কয়েকটি সাধারণ কথা পরিষ্কার করে নিতে চাই। তাদের প্রথমটি হ’ল সাহিত্যের সত্যের প্রকৃতি সংক্রান্ত। সত্য কি? এই প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য যীশুর দণ্ডদাতা পাইলেট প্রতীক্ষা করেননি। সেটা কোন গুহায় নিহিত আমরা জানিনা, কিন্তু একটা মোটা কথা এই যে, যে সত্যের সঙ্গে সাহিত্যের কারবার তা মানবিক সত্য। মানুষের চৈতন্যে মানুষের জীবন মৃত্যুর নানাদিক সম্পর্কে যে প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে তাকে আশ্রয় করেই মানবিক সত্য। সর্বব্যাপী সত্য বলে যদি কিছু থাকে তার সঙ্গে সাহিত্যের সত্যের যোগ হয়ত থাকবে কিন্তু সে যোগ ঘনিষ্ঠ নয়। সাহিত্যের রাজ্যে কোপার্নিকাসের বিপ্লব ঘটেনি। কারণ সাহিত্যের প্রথম Postulate-ই হল—সবকিছুর গোড়ায় মানুষ।
আরও পড়ুন: আঙ্গিক : সম্পর্কের অন্তঃসঞ্চার: সুমন গুণ
তত্ত্ববিদ্যায় যে সত্যের অনুসন্ধান করা হয় সে সম্বন্ধে নীট্শে মন্তব্য করেছেন যে তা তত্ত্ববিদের কামনা বাসনার অভিক্ষেপ মাত্র। তা থেকে জগত ও জীবন সম্পর্কে কোন ধ্রুবকের বোধ লাভ করা যায় না। আমরা কেবল দার্শনিক মানুষটিকে চিনি। বুঝতে পারি, যেমন father confessor বা মনোবিকলনবিদ বোঝেন, দার্শনিকের অন্তর জীবনের রূপটি কী। নীট্শের ভাষায় তা human all too human। অর্থাৎ দর্শনও একজাতের সাহিত্য। তত্ত্ববিদ্যা সম্পর্কে এ মত সর্বজনগ্রাহ্য নয় কিন্তু শিল্প সাহিত্যের সত্য যে নিছক এই জাতের সে নিয়ে বিতর্কের বিশেষ অবকাশ নেই।
বলা হয়েছে, “An artist believes in what he sees”; কিন্তু সে যা দেখে তা একান্তই ব্যক্তিগত ভাবনা-কামনার রঙে রঞ্জিত। সকলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, সকলে একভাবে দেখেনা। আর—“একজনের দেখা অন্যের দেখার চেয়ে বেশী সত্য”—বলার কী অর্থ তা বোঝা কঠিন। শেলী এবং তাঁকে অনুসরণ করে আরো অনেকে বলেছেন যে, সাহিত্যস্রষ্টা যেন তুঙ্গ গিরিশীর্ষে দাঁড়িয়ে অন্যের আগে ভোরের আলো দেখেন। তাঁর রচনার মধ্যদিয়ে সেই আলো উপত্যকার অধিবাসী সাধারণ মানুষের চোখে গিয়ে লাগে। কবি-সাহিত্যিকের কাজের বৈশিষ্ট নিয়ে এটি বহুল প্রচলিত কিন্তু ভ্রান্ত ধারণা। সাহিত্য রচয়িতাকে প্রফেট মনে করা থেকেই এই ভ্রান্তির উৎপত্তি। হোরেব বা সাইনিয়াই-এ মুসা বা যীশু সত্য লাভ ক’রে পরে তা সাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। শেলীর মনের তলায় এই বাইবেলীয় স্মৃতি কাজ করেছিল।
সাহিত্য রচয়িতাকে প্রফেট মনে করা থেকেই এই ভ্রান্তির উৎপত্তি। হোরেব বা সাইনিয়াই-এ মুসা বা যীশু সত্য লাভ ক’রে পরে তা সাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। শেলীর মনের তলায় এই বাইবেলীয় স্মৃতি কাজ করেছিল।
শিল্পী যা দেখেন তা তাঁর মনের গুণে গোটা হয়ে দেখা দেয়, তার বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক যোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু শিল্পীর যা বিশেষ গুণ, যা দিয়ে তিনি অন্যদের থেকে আলাদা তা হয় শিল্পের মাধ্যমের উপর তাঁর অধিকার। যে শিল্পী নয়, তার অনুভূতি দুর্বল মাধ্যমের ছিদ্রকুম্ভের মধ্যদিয়ে ঝরে পড়ে। যে শিল্পী সে বেশ কিছুটা রঙ দিয়ে, সুর দিয়ে, ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারে। Art-এর সঙ্গে Craft-এর যোগ অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু ভাষা জিনিসটা, যা আদতে সামাজিক, তার সাহায্যে নিজের অনুভূতিগুলি প্রকাশ করতে গিয়ে লেখক কিছুটা খুইয়ে ফেলেন। যত মুকুল হয় তত আম হয় না। কিন্তু যা আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হ’ল ভাষার গড়ন জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে নোতুন প্রয়োজনের চাপে বদলে যায়। ভাষার সঙ্গে সাহিত্যিকদের এই দুমুখো সম্বন্ধ আছে। ভাষা তাঁকে শাসন করে আবার তাঁর তৈরী পণ্যের চাপে ভাষা-থলির আকার পাল্টায়। যখন এই বদলের পরিমাণ বেশী হয় তখন কোথাও কোথাও ফাটল ধরে—যেমন হয়েছে শ্রীমধুসূদনের রচনার জন্য।
আরও পড়ুন: ‘কৌরব’ নিয়ে দু’চার কথা : সম্পাদকীয়
শক্তিশালী লেখক শুধু ভাষার গড়নই বদলান না জীবনকে দেখার তাঁর ভঙ্গী নিজের জাতের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেন। বহু মানুষ তাঁর চোখ দিয়েই সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা খানিকটা চেষ্টাকৃত অনুকরণ দিয়ে ঘটে ভক্তির রাস্তা দিয়ে, আর খানিকটা ঘটে অজ্ঞাতে—কারণ ভাষার গড়ন সূক্ষ্মভাবে বদলে দিলেই মনের গড়ন বদলায়। ভাষা আর মন এমনই জোড়কদমে চলে। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা চিন্তা করলেই একথা বুঝতে পারা যায়। সাধনা, বেদনা, পূর্ণতা—শব্দগুলির অর্থ থেকে নরনারীর সম্পর্ক মায় কৃষ্ণচূড়া, রজনীগন্ধার আধুনিক খ্যাতি সর্বত্রই এই প্রভাব অনুভব করা যায়। এর থেকে এক ধরণের pose বা ভঙ্গিমার সৃষ্টি হয়, মুখোশের কারখানা বসে। যে মানুষ এর ফাঁক আর ফাঁকি দেখতে পায় তার যদি শিল্পের ক্ষমতা থাকে তো সে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ করে সত্যের নামে। বিদ্রোহটা ঠিক, কিন্তু সত্যের নামটা পুরোপুরি ঠিক নয়। সন্দীপনবাবুর “সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী” বইটির প্রশংসা করতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “বাংলা সাহিত্য যদি কোনদিন সত্যভাষী হয় তবে আজ থেকে ৩০ কি ৫০ বছর পরে এই কৃশকায় গল্পগ্রন্থটির আবার খোঁজ পড়বে।” সুনীলবাবুর এই কথা এত naive যে একমাত্র বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন মনে করা ছাড়া কোন উপায় নেই। তিনি যে অর্থে ‘সত্যভাষী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সে অর্থে কোন সাহিত্য সত্যভাষী? আর যদি সাহিত্যের সত্যের কথা ওঠে তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে মুকুন্দের ফুল্লরা কালকেতু চরিত্রে, শ্রীমধুসূদনের রাবণে, তারাশঙ্করের “পিতাপুত্র”, ‘অগ্রদানী’, ‘তারিণী মাঝি’ প্রভৃতি গল্পে, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শশী কুসুমে বিভূতির দুর্গা অপুর বনবাদাড়ে ঘোরার চিত্রে সত্য আছে কিনা?
“বাংলা সাহিত্য যদি কোনদিন সত্যভাষী হয় তবে আজ থেকে ৩০ কি ৫০ বছর পরে এই কৃশকায় গল্পগ্রন্থটির আবার খোঁজ পড়বে।” সুনীলবাবুর এই কথা এত naive যে একমাত্র বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন মনে করা ছাড়া কোন উপায় নেই।
আসলে এক তৃতীয় প্রকার সত্যের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তার পরিচয় নিতে হলে কিছুটা পিছনে সরে গিয়ে পুরো ছবিটা দেখার চেষ্টা করতে হয়। এ প্রসঙ্গে য়ুরোপের সাহিত্যের দুটি ধারার কথা উল্লেখ করতে হয়। প্রথমটি হল confession সাহিত্যের ধারা। সাধু অগাস্টাইন, মঁতেঞ, রুষো, টলস্টয় প্রভৃতিরা এই সাহিত্যের কেষ্টবিষ্টু। নিজের জীবনের ত্রুটি বা দুর্বলতা যা সচরাচর লোকে অন্যের দৃষ্টির আড়ালে রাখার চেষ্টা করে, সেগুলিকে স্পষ্ট ভাবে সকলকে জানানো এই জাতীয় রচনার উদ্দেশ্য। মিষ্টি মিথ্যে কথার বদলে খাঁটি সত্যের কারবার করা হচ্ছে এমন ভাব লেখক বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকেন। অনেক পাঠক ঠকে। নিজেকে কোন লোক বিবিক্ত নিরাসক্ত ভাবে দেখেন। অহংকার কী সূক্ষ্মরূপে ঐ স্বীকারোক্তির মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে তা আলবেয়ার কাম্যু তাঁর The Fall উপন্যাসে দেখিয়েছেন। টলস্টয়ের জীবনীর সঙ্গে তাঁর confessionকে মিলিয়ে পড়লেই বুঝতে পারা যায় স্বীকারোক্তিটির কী মূল্য। অমায়িক (ঠিক অর্থে) হওয়াটাও pose, বোধহয় সবচেয়ে জটিল ও কঠিন pose। কিন্তু ভিতরের কথা জানার ইচ্ছা মানুষের এত প্রবল যে এ জাতীয় রচনা বহুলোকে প্রকাশ করেছে, হয়তো পরেও করবে।
দ্বিতীয় ধারাটিকে মানুষের চৈতন্যে একটি গুরুতর বিপ্লব থেকে উদ্ভূত বলে দাবী করা যেতে পারে। সমগ্র আধুনিক সাহিত্য এই বিপ্লবের ফলভাগী। প্রধানতঃ তিনজন লেখকের চিন্তাতে এই বিপ্লবের বাস্তিল দুর্গ পতনের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এঁরা হলেন বোদলেয়ার, ডস্ট্যভ্স্কি এবং নীট্শে। বোদলেয়ার আবিষ্কার করেন একঘেয়েমির বিষাদ নগর-সভ্যতার প্রতীক “hospital, brothel, prison” আর পাপবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয় সম্ভোগের শূন্যতা। ডস্টয়ভ্স্কি দেখতে পান নাস্তিকের দুঃখ আর সহজাত বৃত্তির সঙ্গে উপর থেকে চাপানো ব্যক্তিত্বের খোলসের বিরোধ। নীট্শে জানান যে ভগবান মৃত এবং তার অন্ত্যেষ্টি সৎকার করা দরকার। সর্বজন গৃহীত মূল্যমানের আমূল পরিবর্তন ছাড়া জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য একথাও তিনি জানান। এইসব চিন্তাকে অবলম্বন করে পরে অস্তিত্ববাদী এক দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হয় এবং সাহিত্যে তার গুরুতর প্রভাব পড়ে গিয়েছিল।
নীট্শে জানান যে ভগবান মৃত এবং তার অন্ত্যেষ্টি সৎকার করা দরকার। সর্বজন গৃহীত মূল্যমানের আমূল পরিবর্তন ছাড়া জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য একথাও তিনি জানান।
এ দুটি ধারা অনেকের রচনায় মিশে একাকার হয়ে গেছে। অবশ্য ডস্টয়ভ্স্কির “Notes from Underground”এ এর নজীর ছিল। কাফকার “Trial”, “Metamorphosis” প্রভৃতি গল্প, সার্ত্র-এর “Nausea”তে, কাম্যুর “The Outsider”, “The Fall”-এ সলবেলোর উপন্যাসে এই মিশে যাওয়া দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের সাহিত্যে ঐ পশ্চিমী হাওয়া বেশ কিছুদিন আগেই পৌঁছেচে।
সন্দীপনবাবুর লেখাতে যখন দেখি বিজন রাজমোহন প্রতুল একই ধরণের ব্যক্তি এবং তাদের স্মৃতির ভাণ্ডারও এক—দুটো কাঠি একসঙ্গে করে দেশলাই জ্বালানো, নিউমার্কেটে টিনের বাক্স ফেরত দেওয়া, বন্ধুর নাম বেচু তখন মনে হয় ইনিও confession সাহিত্য লেখক। বিভিন্ন নাম তাঁর ভিন্ন ভিন্ন মুখোশমাত্র, নাটকীয় দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা তিনি করছেন না। তিনি বিদ্রোহী—অনেক কিছুর বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ। খাঁটি সাহিত্যিক বিদ্রোহের যা লক্ষণ, ভাষা সম্পর্কে তীক্ষ্ণচেতনা এবং নবত্ব, তাঁর লেখাতে পাই।
সন্দীপনবাবু তাঁর “সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী” বইয়ের গোড়ায় লিখেছেন, “আমার লেখা যা আদৌ গল্প নয় তা কেন ও কী উপায়ে তার কাছাকাছি চলে যাবে, যার কোন অস্তিত্ব নেই! যা কবিতা? তা ছাড়া কোনটা গদ্য কোনটা পদ্য বুঝব কী করে, একি সম্ভব নাকি বোঝা, কোনটা কী!” একথাগুলো তাঁর রচনা সম্পর্কে মূল্যবান। তাঁর গদ্য কবিতার ধার ঘেঁসে চলে। কিন্তু সে কবিতা স্পষ্ট ইমেজের কবিতা। “রণপায়ে ছুটে আসা বৃষ্টি”, “শবযাত্রার খই-এর মতো আকাশ ভরা শারদীয় তারা”, “কী বেদনাহীন রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে সে আজ জানতে পারল যে, গান তার এমন প্রাণাধিক প্রিয়।”—এই গোটাকয়েক উদাহরণ তুলে দেখানো যেতে পারে তাঁর ভাষা কবিতার ভাষা। অথচ যা নিতান্ত prosaic তাঁর বর্ণনাতে ভাষা গোঁত্তা খেয়ে পড়েনা। নিশ্চিন্ত অভ্যাসের ঢিলেমি তাঁর ভাষায় নেই। তবে কোথাও কোথাও উপমাতে জবরদস্তির ভাব ও কষ্টকল্পনা আছে। যে শব্দগুচ্ছ চিন্তা না-করে লিখলে সুড়ুৎ করে কলমের মুখে এসে জোটে সেগুলি যথাসাধ্য এড়িয়ে চলেন, তাঁর ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর চিন্তাকে অনুসরণ করে। তবে তাঁর গদ্যে ইংরাজী বাগ্ধারার একটু বেশী প্রভাব আছে এবং তা প্রশংসার যোগ্য নয়।
আরও পড়ুন: কৌরব : কবিতা : স্বদেশ সেন
এ ভাষার প্রয়োজন হচ্ছে, অগ্রজের অটল বিশ্বাসে যার আস্থা গিয়েছে খোলা চোখে জীবনকে দেখে যে তার সম্বন্ধে লিখতে চায় অথচ অনর্থক খুঁটিনাটির মধ্যে নিজের আবেগকে শেষ করতে চায়না, তার আত্মপ্রকাশের জন্য। এলিয়টের প্রথম দিকের কবিতায় ভাষার যে জাতীয় প্রয়োগ আছে সন্দীপনবাবু তার কিঞ্চিৎ অনুকরণ করেছেন। আকাশটা অপারেশন টেবিলে শায়িত অজ্ঞান রুগী, ঘরের ভিতর মেয়েরা যাতায়াত করছে মিকেলএঞ্জেলো সম্বন্ধে কথা কইতে কইতে, পাতলুনের তলাটা ঢিলে হয়ে গেছে গুটিয়ে পরতে হবে—এই ধরণের সাজানো সন্দীপনবাবুর লেখায় আছে। যে অর্থে তিনি রিয়ালিজমে বিশ্বাসী নন। তিনি বলেছেন—“ভাষার খেলা যতই দেখাক খোকাখুকুরা—রিয়ালিজম নয়—যে কোন ঘটনার রিয়্যালিটির কেশ স্পর্শ করা যায় কি?’
“পণ্ডশ্রম-চেতনা” এই সমাসবদ্ধ শব্দটি তাঁর “এখন আমার কোন অসুখ নেই” উপন্যাসে আছে। তাঁর রচনার মর্মগ্রহণ করতে গেলে এইটেই আরিয়াডনের সূত্র। প্রচলিত সমস্ত মূল্যমানের উপর তাঁর আস্থা গিয়েছে। দেহের বাস্তবকে অস্বীকার ক’রে অথচ তারই অধীনে ক্রীতদাস ক্রীতদাসীর মত সাধারণ জীবনযাপনের কোন শ্রী আছে এ তিনি মানেন না। কোন কিছু করেই শেষপর্য্যন্ত কিছু লাভ হয়না—এই পণ্ডশ্রম-চেতনা তাঁর গল্প উপন্যাসের নায়কদের মনে চেপে বসে আছে। অথচ ইংরাজিতে যাকে kicking against the pricks বলে, তাঁর ইচ্ছা এবং যাতনা থেকে তারা মুক্ত নয়। শেক্সপীয়রের হ্যামলেট যখন নাটকের শেষের দিকে বারবার বলছে “it’s no matter” তখন সেও পণ্ডশ্রম-চেতনার দ্বারা পীড়িত।
প্রচলিত সমস্ত মূল্যমানের উপর তাঁর আস্থা গিয়েছে। দেহের বাস্তবকে অস্বীকার ক’রে অথচ তারই অধীনে ক্রীতদাস ক্রীতদাসীর মত সাধারণ জীবনযাপনের কোন শ্রী আছে এ তিনি মানেন না।
লক্ষ্য করা যেতে পারে যে এই চেতনা সন্দীপনবাবুর নায়কদের passive করে দিয়েছে। কিন্তু যে মানুষ কর্মের সঙ্গে বাসনার যোগে যুক্ত নয় সাধারণ মানুষকে সে কখনই বুঝে উঠতে পারে না। তাঁর উপন্যাসের নায়কদের যে রিরংসা তাও নিষ্ক্রিয় গোছের। ফলে ঘৃণা, বিবমিষা ও বিরাগ কামবৃত্তির সঙ্গে মিশে আছে। বিজন যখন রেণুর স্থূল দেহ ছুলি ধরা মুখ ও লালা ক্লিন্নতা দেখে তাকে ছেড়ে চলে আসছে তখন তার দ্বিধার মূল কারণ ধরা পড়ে। শোনা যায়, সন্ধ্যায় যাদের নাচগান বাজনায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ মুগ্ধ হয়েছিলেন গভীর রাতে তাদের নিদ্রিত শ্লথ লালানিঃসরিত রূপ দেখে তিনি সংসার ত্যাগ করেছিলেন।
বিজন সংসার ত্যাগ করেনি কারণ এই সংসারের বাইরে অন্য কিছুতে তার বিশ্বাস নেই। কোন নিত্যসত্যের সে ভরসা করে না। এই সংসার ও নিজের দেহমনের সাক্ষ্যই একমাত্র বাস্তব এটা সবগুলি প্রধান চরিত্রের মৌলিক বিশ্বাস। উপন্যাসের প্রতুল বলছে, “জীবনযাপন করতে গিয়ে কর্মের দিক থেকে রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, ইম্প্রেসনিজম কিউবিজম থেকে দাদাইজম প্রভৃতি হেন-তেন মায় মার্কসিজম ও নানারকম প্রয়োজনে লাগলেও কনটেণ্ট বা ফাণ্ডার ব্যাপারে বেঁচে থাকা কিন্তু বেশ ঝাড়াঝাপ্টা।” কেন ঝাড়াঝাপ্টা? এই জন্য যে কাম ঘুম ক্ষুধা নিয়ে কতকগুলি সোজা নিয়মের শাসন প্রত্যক্ষ করা যায়। তার বেশী যা কিছু তা নিয়েই সন্দেহ অবিশ্বাস। এই যে জীবন সম্পর্কে ধারণা, এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যুক্ত আছে মৃত্যুচেতনা। বিশেদার কাটা হাত। মনোজের পুরীর সমুদ্রে মৃত্যু। মনোজের কয়েকটি কথায় জীবন মৃত্যু আর রিয়ালিটি নিয়ে লেখকের ধারণা এইভাবে প্রকাশ পেয়েছে—“আমরা যখন জলে যাই, ছুঁতে চাই জলের তলা, এমন কি যারা সাঁতার জানেনা তাদেরও জলের কী একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার ওপর দিকে ঠেলে তুলতে থাকে না? এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাঁচার ইন্বিল্ট স্বাধীন ও সার্বভৌম ইচ্ছা—যারা সাঁতার জানে, তারা যার-পর-নেই পরাধীন ভাবে সেখানে উঠে আসতে বাধ্য হয়, যেখানে বাতাসও নিশ্বাস—বাঁচা যেখানে। যাঁরা জানেনা তারা ডোবে। ঐ তলদেশ ছোঁয়া যায় একমাত্র মরে গেলে! দুধের কার্ড বা আত্মহত্যা সে যাই হোক না কেন, কোন জিনিষ বা ঘটনার রিয়ালিটিকে বেঁচে থেকে ছোঁয়া যায় না, যায় না, যায় না।”
যারা সাঁতার জানে, তারা যার-পর-নেই পরাধীন ভাবে সেখানে উঠে আসতে বাধ্য হয়, যেখানে বাতাসও নিশ্বাস—বাঁচা যেখানে। যাঁরা জানেনা তারা ডোবে।
সুতরাং বলা যেতে পারে যে, উপর থেকে যা আমরা দেখতে পাই তা খোলামকুচি নিয়ে গঙ্গাযমুনা খেলা। সে খেলায় ক্ষণিক স্পর্শবিন্দু, পতিতালয়ে একজনের সাবান অন্যলোকে মাখা নিয়ে ঝগড়া হতে পারে, পিয়ানোর রীড নিয়ে পথে ছোঁড়াছুঁড়ি হতে পারে বা মাসের শেষে ধারের জন্য ঘোরাঘুরি হতে পারে। Being and Nothingness বইএ সার্ত্র বলেছিলেন “man as a useless passion”এর কথা, সন্দীপনবাবুর মনোভাব খানিকটা তার সঙ্গে মেলে।
পণ্ডশ্রম চেতনা ও মৃত্যু চেতনা থেকে আত্মহত্যার চিন্তা অনিবার্য্য ভাবে এসে পড়ে। সন্দীপনবাবুর লেখাতেও এসেছে। তবে আলবেয়ার কাম্যুর চিন্তার সঙ্গে তাঁর ভাবনার কোথায় মিল সেটা নিয়ে কয়েকটা কথা বলা দরকার। বিপ্লব ও রাজমোহন গল্পে নায়ক আত্মহত্যার ভাবনায় পীড়িত। আত্মহত্যার প্রয়োজন আছে এই বোধ যে নিছক নেতিবাচক নয় সেটা যে বিশ্বাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করে এটা রাজমোহন বুঝতে পেরেছে। এবং পেরেছে বলে তার চোখে জীবন অর্থহীন নয়। এই চিন্তা কাম্যুর আত্মহত্যা বিষয়ে একটি বিখ্যাত প্রবন্ধে আছে। আত্মহত্যা করা উচিৎ যে বলে, সে জীবনের উপর একটা অর্থ আরোপ করেছে। কারণ যদি কেউ মনে করে জীবন অর্থহীন তবে সব কাজই অকাজ মনে করে সে আত্মহত্যাও করে না। অথচ জীবনের অর্থ আছে তাই আত্মহত্যা করা দরকার এটাও একটা absurd অবস্থা।
কাম্যু সিসিফাস্ সম্বন্ধে লিখিত আর একটি প্রবন্ধে পণ্ডশ্রম চেতনাকে অবলম্বন করে স্বাধীনতা বোধে উত্তরণের একটা পথের ইঙ্গিত করেছেন। দেবতাদের অভিশাপে সিসিফাস একটা ভারী পাথরের চাঙড়কে ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় তোলে আবার সে পাথর গড়িয়ে নিচে পড়ে। সে আবার নিচে নেমে আসে সেটাকে উপরে তোলবার জন্য। অনন্তকাল ধরে এই পণ্ডশ্রমকে মেনে নিতে পারলে ব্যর্থ ছোটাছুটির ফাঁকে স্বাধীনতার আস্বাদ পাওয়া যায়। সন্দীপনবাবু সিসিফাসের এই সমাধানকে স্বীকার করেননি। বিজনের রক্তমাংস গল্পের শেষ অংশ পড়লে সেটা বুঝতে পারা যায়—
“স্পেশালিষ্ট বললেন যে বিজনের অতি গুরুতর অসুখ হয়েছে, এর কোন ওষুধ নেই, এর কোন চিকিৎসা হয় না; কিন্তু যে কোন মুহূর্তে এর ওষুধ বেরিয়ে যেতে পারে, এই জন্যে, যতদিন সম্ভব বেশী বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, তিনি এখুনি বিজনের চিকিৎসা শুরু করবেন। বিজনের ততদিন বেঁচে থাকা দরকার।”
কাম্যু সিসিফাস্ সম্বন্ধে লিখিত আর একটি প্রবন্ধে পণ্ডশ্রম চেতনাকে অবলম্বন করে স্বাধীনতা বোধে উত্তরণের একটা পথের ইঙ্গিত করেছেন।
দুঃখের বা শূন্যতার কোন চক্রাবর্ত-ক্রিয়াকে অবলম্বন করে নয় শুধু বাঁচার জন্যে বাঁচাকে তিনি এই গল্পে স্বীকার করেছেন। তাঁর শূন্যতা বোধের সঙ্গে কোন ট্র্যাজিক মহিমাকে তিনি যুক্ত করেননি। রাজমোহনের আত্মহত্যার ভাবনা শেষ হয়েছে নিজের শেলফের বইগুলি পুড়িয়ে ফেলে। এটা অনেকটা সন্ন্যাসী হওয়ার আগে নিজের শ্রাদ্ধ সেরে ফেলার মতো।
শেষ শুধু একটি কথাই বলার আছে। সন্দীপনবাবুর অধিকাংশ রচনায় যে বিচ্ছিন্ন কল্পচিত আছে সেগুলি অনেক সময় এলোমেলো। এক একটি রচনার ইমেজগুলি একযোগে কোন অর্থকে পরিস্ফুট করে না। অনেকগুলি খণ্ড অভিজ্ঞতার কথা আছে যাদের আত্মজৈবনিক মূল্য যাই হোক সাহিত্যিক মূল্য কী তা বোঝা কঠিন। সাহিত্যের শিল্পপদ্ধতিকে ভেঙে যে সত্যপ্রকাশের চেষ্টা হয় তা সাহিত্যের অংশ হয় কী করে? এখানে যে হেরফের আছে তার দোষে সন্দীপনবাবুর অনেক লেখাই দুষ্ট। বিশেষ করে “এখন আমার কোন অসুখ নেই” সম্বন্ধে এডুইন মুইরের ভাষায় বলা চলে……
“Its design is arbitrary, its development feeble, its unity questionable…..it proceeds by agglomeration, not by development. The plan area is purely contingent and theoretical, not the animating principle of the whole.”
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।