একটি ছেলে মন দিয়ে ইংরিজি ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করছে। সামনে বসে আছেন তার গৃহশিক্ষক, একেবারে বিলেত থেকে আসা সাহেব। নাম, স্যর স্টুয়ার্ট ফ্রেজ়ার। এই ফ্রেজ়ার সাহেবকে ভারতের শাসনব্যবস্থার ইতিহাস মনে রাখবে অ্যাংলো-টিবেট কনভেনশন বা ভারত, তিব্বত ও চিনের মধ্যে হওয়া প্রথম ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে নেতৃত্বের জন্য।
তবে তখন তার দেরি আছে। ফ্রেজ়ার সাহেব এই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে নেতৃত্ব করবেন ১৯০৪ সালে। আর ছেলেটি যখন বসে পড়েছে তখন সময়টা সবে ১৮৯০। ছেলেটির বয়স ১২। ইতিহাস তাকেও মনে রাখবে অনেকখানি। সে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, দলিতদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবে, কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে। ইতিহাস তাকে চিনবে ছত্রপতি সাহু নামে।
ইংরেজি শিক্ষায় সত্যিই অভিনিবেশ ছিল ছত্রপতির। সাবিত্রীর থেকে প্রায় একশো বছর এগিয়ে থাকা ছত্রপতি এ ব্যাপারে অজান্তেই ছিলেন জ্যোতিবা-সাবিত্রীর সঙ্গে সমমনস্ক। যেভাবে জ্যোতিবা শুরু থেকে মনে করতেন দলিতদের নিষ্পেষণ বন্ধ করতে প্রয়োজন শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষা, ঠিক সেভাবেই ইংরেজি শিক্ষা, দলিতদের শিক্ষার ব্যবস্থা, মেয়েদের শিক্ষার জন্য সর্বমুখী চেষ্টা করেন ছত্রপতি। তাই একইসময় অবস্থান না করেও জ্যোতিবা-সাবিত্রীর যথার্থ ভাবশিষ্য ছিলেন ছত্রপতি, আবারও প্রমাণিত হয়।

ছত্রপতি চতুর্থ শিবাজির দত্তকপুত্র ছত্রপতি সাহু সিংহাসনে বসেন ১৮৯৪ সালে। তিনি যে মৎসজীবীর পুত্র, তাঁর অসাধারণ মেধা ও বুদ্ধি দেখেই যে রানি আনন্দীবাঈ তাঁকে দত্তক নেন, তা আমরা আগেই বলেছি। যে সময়ের কথা, তার কিছুদিন আগে দত্তকপুত্রের অধিকারের বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেবের ঘটনা থেকেই জেনেছে ইতিহাস। মহাবিদ্রোহের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল দত্তকপুত্রদের অধিকার না মেনে ইংরেজদের রাজ্য হস্তগত করার বিষয়টি। এরকম স্পর্শকাতর সময়েই দত্তকপুত্র হিসেবে রাজা হন ছত্রপতি। ১৮৯৪ সালে রাজা হওয়ার পরে ঘটে ‘বেদাকোটা বিতর্ক’, যার কথা আমরা আগের পর্বে জেনেছি। ব্রাহ্মণ পুরোহিত, ব্রাহ্মণ রাজন্যবর্গকে অপসারিত করা, অব্রাহ্মণদের নিযুক্ত করা আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও কম কথা নয়।
ছত্রপতি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, দলিতদের পক্ষে জ্যোতিবা সাবিত্রীর সত্যসোধক সমাজে যোগদান করেন ১৯০২ সালে। এই ধর্মসংস্কার কতটা ধর্ম, কতটা সমাজসংস্কার ছিল এবং জ্যোতিবা সাবিত্রীর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা-ও আমরা আগে উল্লেখ করেছি। এই কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ১৯০৩ সালেই ইংল্যান্ডে আমন্ত্রণ পান ছত্রপতি, রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ও রানি আলেক্সান্দ্রার অভিষেক উপলক্ষে।
১৯০৩ থেকে ১৯০৪ সাল ইংল্যান্ডেই থাকেন ছত্রপতি, অনুধাবন করেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের গতিপ্রকৃতি। এই অভিনিবেশ ছত্রপতির পরবর্তী সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারের ধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। কারণ ইংল্যান্ডের আবহাওয়া তখন আগের তুলনায় কম বিদ্বেষমূলক। উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, যা আমরা সমকালীন সাহিত্য যেমন চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড বা অলিভার টুইস্টে পাই, তার থেকে অনেক সরে এসেছিল ইংল্যান্ড। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী শোষণ ও বৈষম্য সরে গিয়ে এসেছিল শ্রমিক আন্দোলনের ফল, আধুনিক মানসিকতাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছিল পুরনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের দল। এই পরিবর্তিত মানসিকতার প্রধান প্রকাশ ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে। ১৯০২ সালেই পাশ হয় আর্থার বালফোরের ‘এডুকেশন অ্যাক্ট’, যার নিরিখে দেশের সব প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রকে আনা হয় সরকারের অধীনে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সরকারি উদ্যোগে সকলকে প্রায় বিনামূল্যে দেওয়া হতে থাকে শিক্ষা। সারা বিশ্বের অন্যতম প্রথম এই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটেনে এইসময়ই শুরু হয় বালফোরের অধীনে।

তাই অনেককিছু শিখে, জেনে দেশে ফেরেন ছত্রপতি। দেশের সমাজব্যবস্থায় জাতপাত, হিন্দু সমাজের মধ্যে বর্ণভেদ, দলিতদের প্রতি অস্পৃশ্যতার মনোভাব নিয়ে ছত্রপতি যে চিন্তিত, বিক্ষুব্ধ থাকতেন তা আমরা আগেই দেখেছি, বেদাকোটা বিতর্কে তার প্রমাণও পেয়েছি। এবার ছত্রপতি গুরুত্ব দিলেন শিক্ষাসংস্কারের উপর। বিলেতের অভিজ্ঞতা, সত্যসোধক সমাজের শিক্ষার আদর্শ বুকে নিয়ে ছত্রপতি গড়ে তোলেন রাজারাম কলেজ, যেখানে দলিত, মুসলমান ও পার্শি সম্প্রাদায়ভুক্ত মানুষেরও শিক্ষায় সমান অধিকার থাকবে। উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজের অভাব তো ছিলই, আর দলিত বা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য শিক্ষারই ছিল প্রবল অভাব, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো অকল্পনীয়। সবচেয়ে কাচের কলেজ ছিল বম্বের এলফিনস্টোন কলেজ, যেখানে দলিতদের প্রবেশাধিকারই ছিল না। রাজারাম কলেজ স্থাপিত হওয়ায় কাছাকাছি এত বড় উচ্চশিক্ষার যোগ পেয়ে বর্ণ হিন্দুরাও দলিত, মুসলিমদের সঙ্গে একই কলেজে প্রবেশ করল। তারপরই শুরু হল অশান্তি, ক্ষোভ। এক ক্লাসে এক জায়গায় বসতে রাজি হল না বর্ণহিন্দুরা। যাদের ছায়াও মাড়ায় না তারা, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কী করে পড়াশোনা করবে? এছাড়া অস্পৃশ্যতাজনিত ছোঁয়াছুঁয়ি ইত্যাদি সমস্যা তো ছিলই।
এ ব্যাপারে ‘বেদাকোটা বিতর্ক’-এর মতোই দৃঢ়, অনড় মনোভাব দেখালেন ছত্রপতি। কলেজে পড়ার সুযোগ নিতে গেলে সবাইকে একসঙ্গেই পড়তে হবে। তবে কলেজ সংলগ্ন যে ছাত্রাবাস গড়ে তোলা হয়, তাতে কিছুটা নমনীয় ব্যবস্থার আশ্বাস দেন ছত্রপতি। শুধু বর্ণহিন্দু, দলিতদের জন্য পৃথক আবাসের ব্যবস্থা নয়, পার্শি ও মুসলমান ছাত্রদের জন্যও ছিল পৃথক ব্যবস্থা।
তবে দলিতদের উৎসাহদানের প্রসঙ্গ সবসময়েই অগ্রাধিকার পেত। দলিত ছাত্রদের জন্য বিশেষ পুরস্কার ও স্কলারশিপের বন্দোবস্ত ছিল। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে কোনও শাসক দলিতদের জন্য ছাত্রাবাস করছে, স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে তাদের উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে দিচ্ছে, এটা ভাবাই কঠিন। আর এখানেই ছত্রপতি সাহুর বিশালত্ব, এখানেই জ্যোতিবা-সাবিত্রীর ভাবশিষ্য হওয়ার বিন্দু। কারণ ছত্রপতিরও পঞ্চাশ বছর আগে, অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে পুণের এক নববিবাহিত দম্পতি, যাদের বয়স কুড়ি বছর ও সতেরো বছর মাত্র- তারা শুধু দলিতদের পড়াতে চেয়ে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল কিন্তু দলিতদের শিক্ষার উদ্দেশ্য থেকে সরে আসেনি। ঠিক জ্যোতিবা সাবিত্রীর মতোই শুধু দলিত ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হননি ছত্রপতি। সচেষ্ট হন মেয়েদের এবং দলিত মেয়েদের পড়াশোনার জন্য। মেয়েদের জন্য গড়ে তোলেন মিস ক্লার্কস স্কুল, যা পুরো কোহলাপুরে প্রথম মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে।
মনে রাখতে হবে, এর থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মহারাষ্ট্রের মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন জ্যোতিবা সাবিত্রী। সঙ্গে ফতিমা শেখ, আর তাঁর দাদা উসমান শেখ। দুই বান্ধবী জ্যোতিবা-ফাতিমার সংগ্রামের কথা, সংঘর্ষের গল্প বলেছি আমরা। কীভাবে দুটো শাড়ি নিয়ে বেরতেন দুই বান্ধবী, কীভাবে তাদের দিকে ছোড়া কাদা, আবর্জনাতে ক্লিষ্ট হত তাদের শাড়ি, আবার হাসিমুখে জোড়া শাড়ির অন্য শাড়িটি পরে তারা বাড়ি ফিরতেন।

তারপর কেটে গেছে অর্ধশতক। প্রথমদিকে গমগম করে চলা আঠেরোটি মেয়েদের স্কুলের বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে যায় মহাবিদ্রোহ ও রানির শাসনের পর। আর সেই ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় ছত্রপতির প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের স্কুলের মাধ্যমে। তবে এক্ষেত্রে মেয়েদের সমস্যা সমাধানে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান ছত্রপতি। ছাত্রদের মতই, ছাত্রীদের জন্যও থাকার জায়গা– ছাত্রী আবাস– গড়ে তোলেন। জ্যোতিবা সাবিত্রীর সময়েও মেয়েরা পড়াশোনা করতে এগিয়ে এলে, তাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাবার সুযোগ থাকত না। ফতিমা শেখের বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হত। সে ছিল একরকম আশ্রয় আর ছত্রপতি সাহুর প্রতিষ্ঠিত এ এক সম্মানজনক ছাত্রী আবাস। সারা দেশের বিচারে এই ছাত্রী আবাস ছিল অগ্রগণ্য।
পায়ে পায়ে পথ চলা, একটু একটু এগিয়ে যাওয়া। কখনও সাবিত্রীবাঈ, কখনও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, কখনও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কখনও জ্যোতিবা ফুলে বা কখনও জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন, কখনও বা ছত্রপতি সাহু। মেয়েদের পড়াশোনা পাখা মেলতে থাকে, যে ডানায় ভর করে আজ আমাদের উড়ান। স্বল্প হলেও, উড়ান তো বটেই।
* তথ্যঋণ:
‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্ অফ্ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।