পি এম বাগচীর (P M Bagchi) সাবেকি সেই বাড়ির কথা কখনওই ভোলা যাবে না। ভোলা যাবেনা জয়ন্ত বাগচীকেও। তিনি অতীত আগলে বসে যেমন নেই তেমনি অতীতের প্রতি উপযুক্ত সম্মান অন্তর থেকে মানবার চেষ্টা করেন। আমি বহুবার ওখানে গেছি, আমার সন্ধানে তিনি যতটা পেরেছেন সহযোগিতা করেছেন। তাঁর মুখ থেকেই জেনেছি তাঁর দাদু কিশোরী মোহন বাগচী (Kishori Mohan Bagchi) সামান্য চাকরি করতেন। কিন্তু সামান্য চাকরি করলেও তাঁর ছিল অসামান্য সম্ভ্রম বোধ এবং স্বাধীন ভাবনা। দেশে তখন (উনিশ শতকের শেষ দিকে) স্বদেশী আবহাওয়া। কিশোরী মোহন সামান্য কারণে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়িতে নিজে কালি তৈরি করে বোতলে ভরে লেবেল লাগিয়ে বাজারে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা শুরু করলেন। ক্রমে কালির চাহিদা বাড়তে লাগল। পত্তন করলেন ‘দর্জ্জিপাড়া কেমিক্যালস’। ধীরে ধীরে ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ল। তখন রেল কোম্পানি থেকে নিয়মিত অর্ডার পাচ্ছেন। তারপর নামের সঙ্গে যুক্ত হলো রাবার স্ট্যাম্প। থেমে তিনি থাকলেন না এবং একজন বাঙালি ব্যবসায়ী হিসেবে সকলের সমীহ আদায় করলেন। তাঁকে সহযোগিতা করলেন স্বয়ং প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

এরপর একের পর এক ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে ক্রমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছতে লাগল তাঁর কোম্পানির পণ্য। কোম্পানি শাখা বিস্তার করতে থাকে। এবারে তিনি নজর দিলেন প্রকাশনা শিল্পে– পঞ্জিকা প্রকাশে এগিয়ে গেলেন, এতে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন পঞ্জিকাতে ভালোভাবে প্রকাশ করতে সুবিধা হবে। পঞ্জিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে তা বহু মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে। নিজের পঞ্জিকা না থাকলে অন্যর উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। ভালো ছাপা না হলে মন খারাপ হতো। বাজারে তখন অনেক পঞ্জিকা এসে গেছে। তিনি নিজের কোম্পানি থেকে পঞ্জিকা প্রকাশ করলেন। ভাল ছাপার জন্য ভাল ভাল মেশিন আনলেন। কিন্তু অন্য পঞ্জিকার থেকে ভিন্ন চেহারা ও আরও নতুন কিছু পাঠককে দেবার ভাবনা থেকে অচিরেই এক নতুন ধরনের পঞ্জিকা প্রকাশ করলেন যার নাম ডিরেক্টরি পঞ্জিকা। এই ডিরেক্টরিতে কী নেই! এক পরিবারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য এতে পাওয়া যাবে, কোথায় কোন ব্যবসা আছে তার হদিস, কোন বাড়িতে কে থাকেন তার হদিস, কোর্টের মামলার জন্য যাবতীয় তথ্য, যানবাহনের ভাড়া, পোস্টাল সার্ভিসের যাবতীয় তথ্য ইত্যাদি। পঞ্জিকার কাটতি হু হু করে বেড়ে গেল। পঞ্জিকার অন্দরে ছবি ছাপলেন ভাল ভাল কাঠ খোদাই শিল্পীদের দিয়ে। এর মধ্যে ছিলেন প্রিয় গোপাল দাস যার কথা পরে বিশদে লিখব।

সবচেয়ে উল্লেখ্য যে এই কোম্পানি অনেক নাম নিয়ে শুরু করলেও পরিচিত হলো পি এম বাগচী হিসেবে। কিশোরী মোহন নিজের নামে করতে পারতেন কিন্তু করলেন না। বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন বাবার নামেই ব্যবসার নাম রাখলেন– পিয়ারী মোহন বাগচী (Peary Mohan Bagchi) সংক্ষেপে পি এম বাগচী। বিশ শতকের তিরিশের দশক অবধি কিশোরী মোহন ব্যবসাকে এক উল্লেখযোগ্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ওঁর প্রয়াণের পর পুত্ররা এবং তাদের সন্তানরা আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে।
আমি জয়ন্তবাবুকে বললাম, আমি আসব আপনাদের পুরনো পঞ্জিকার ছবি ও বিজ্ঞাপনের ছবি তুলে নিয়ে যাব। তিনি সমস্ত রকম সহযোগিতার অঙ্গীকার করলেন। আমি দিনের পর দিন গিয়ে আমার ক্যামেরায় যতটা পেরেছি ছবি তুলে রেখেছি। ওইসব পঞ্জিকার ছবি ভাগ্যিস আমি তুলেছিলাম, কারণ এখন সেসব আর নেই। কিছু অসৎ মানুষ চুরি করে নিয়ে গেছে। মূল অফিস ঘরও আর নেই, কেবল ওদের পঞ্জিকা আর প্রেসটি বেঁচে আছে। বাকি সব প্রোমোটারের গ্রাসে চলে গেছে। ভাগ্যিস আমি কিছুটা ডকুমেন্টেশন করে রেখেছিলাম এই ইতিহাসকে। নিজের কাছে রেখেছি ওদেরই দেওয়া পুরনো কালির বাক্স, এসেন্সের শিশি, কিছু লেবেল যা বিদেশ থেকে ছেপে আসা, কিছু বটতলা সাদৃশ্য বই সহ আরও কিছু নিদর্শন। এক ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহ্যের পি এম বাগচী আজও আছে সেই ইতিহাসকে বুকে নিয়ে পুরনো খণ্ডিত কিছু ইমারতের মধ্যে। প্রতি বছর নিয়ম করে ওদের পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।