মারাঠি পরিবারে জন্মালেও লতার বাংলা শিল্পসংস্কৃতির প্রতি অদম্য আসক্তি ছিল প্রথম থেকেই। শুধু বাংলা গানের প্রতি আকর্ষণ নয়, বাংলা ভাষা বোঝার ও শেখার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক বাসু ভট্টাচার্য লতাকে বাংলা শিখিয়েছিলেন দীর্ঘ কয়েক বছর। সুরসম্রাজ্ঞীর বাংলা গান বললে মাথায় আসে দুই কিংবদন্তি সুরকার সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম। তবে লতার কণ্ঠে প্রথম বাংলা গান মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে, ভি শান্তারামের ‘অমর ভূপালি’ ছবির হাত ধরে। ফিল্মটি বাংলায় ডাব করা হয়েছিল। বাংলা আর ব্রজভাষা মেশানো ভক্তিসঙ্গীতের আবেশে রচিত গানগুলি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
এই ছবির মাধ্যমে বাংলা গানের জগতে প্রবেশ ঘটে মান্না দে ও আশা ভোঁসলেরও। এই ফিল্মে লতার গাওয়া গানগুলি– ‘ঘনশ্যাম সুন্দর শ্রীধর অরুণ অয়ি জ্বালা’ (মান্না দের সঙ্গে ডুয়েট), ‘বঁধুয়া কাহঁ দূরদেশে যাও’, ‘তুয়া পিরিতে হে দুঃখ সদা দিও না মোরে’, ‘সুখে মাতে চিত হরষে হাসে নয়ন’, ‘লটপট লটপট তুয়া চলনলো মৃদু ছন্দা গো’ ও ‘মরি মরি ওরে মনমোহন’ (মান্না দের সঙ্গে ডুয়েট) এক অপূর্ব সংযোজন।
লতাকণ্ঠে প্রথমবার বাংলা বেসিক গান শোনা গিয়েছিল ১৯৫৭ সালে, পবিত্র মিত্রের কথায় ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে। গানদুটি – ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’ এবং ‘কত নিশি গেছে নিদহারা ওগো’ (রেকর্ড নং – GE 24813)। দুটি গানের সুরের চলন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যা আপামর বাঙালি শ্রোতার মন জয় করে নিয়েছিল। কে ভুলতে পেরেছে ১৯৫৭ সালে ভূপেন হাজারিকার সুরে এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা দাদরা তালে আধারিত দুটি অনবদ্য নিবেদন– ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ ও ‘মনে রেখো ওগো আধো চাঁদ?’ লতার অনুপম কণ্ঠলালিত্যে গানদুটি স্বমহিমায় বিরাজ করছে মেলডিপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায়। ১৯৫৮ সালে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা পরিবেশন করেছিলেন ভিন্ন স্বাদের দুটি চমকপ্রদ গান। ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ এবং ‘ও পলাশ ও শিমূল’ প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে, সলিল চৌধুরীর সুরে প্রথম বাংলা আধুনিক গান প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। ‘যারে, যারে উড়ে যারে পাখি ও ‘না যেও না, রজনী এখনো বাকি’ আজও জনপ্রিয়তার নিরিখে শীর্ষস্থান অধিকার করে রয়েছে।
‘অমর ভূপালি’ ছাড়াও অমর হয়ে আছে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া অন্যান্য বাংলা ছায়াছবির গান। কিছু ফিল্মের নাম দেখে নেওয়া যাক– ‘অসমাপ্ত’ (১৯৫৬), ‘একদিন রাত্রে (১৯৫৬), ‘শেষ পরিচয়’ (১৯৫৭), ‘কড়ি ও কোমল’ (১৯৫৭), ‘জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), ‘ও আমার দেশের মাটি’ (১৯৫৮), ‘জোনাকির আলো’ (১৯৫৮), ‘যৌতুক’ (১৯৫৮), ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯), ‘পঙ্কতিলক’ (১৯৬১), ‘আলোর পিপাসা’ (১৯৬৫), ‘দোলনা’ (১৯৬৫), ‘মণিহার’ (১৯৬৬), ‘সুভাষচন্দ্র’ (১৯৬৬), ‘শঙ্খবেলা’ (১৯৬৬), ‘বাঘিনী’ (১৯৬৮), ‘অদ্বিতীয়া’ (১৯৬৮), ‘মন নিয়ে’ (১৯৬৯), ‘চৈতালি’ (১৯৭১), ‘কুহেলী’ (১৯৭১), ‘অনিন্দিতা’ (১৯৭২), ‘মর্জিনা-আবদাল্লা’ (১৯৭৩), ‘সোনার খাঁচা’ (১৯৭৩), ‘রাগ অনুরাগ’ (১৯৭৫), ‘কবিতা’ (১৯৭৭), ‘সানাই (১৯৭৭), ‘প্রক্সি’ (১৯৭৭), ‘মাদার’ (১৯৭৯), ‘অনুসন্ধান’ (১৯৮১) ইত্যাদি।
আগেই বলেছি, লতা মঙ্গেশকরের মারাঠী গানের প্রতি আগ্রহ জন্মায় বাবা দীননাথের গান শুনে। তিরিশ বছরে পা দেওয়ার আগেই মাস্টার দীননাথ খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। একসময় তাঁকে মারাঠী নাটকের শ্রেষ্ঠ গাইয়ে-অভিনেতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ ছিল দীননাথের, সঙ্গে ছিল তেমনি গলার রেঞ্জ। নাট্যসঙ্গীতের পাশাপাশি রাগসঙ্গীতেও তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাবার শেখানো রাগসঙ্গীতের পাশাপাশি মারাঠী থিয়েটার ও সিনেমার গানও সাবলীল গলায় তুলে নিতেন লতা। সাংগলির অপেরা হাউসে থিয়েটারের শতবার্ষিকী উৎসবে বাবার নাটকের গান গেয়ে বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন শিশু শিল্পী লতা। ফলে মারাঠি ছবির জগতেও লতার জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। বস্তুত, হিন্দি ও বাংলা ছাড়া ভারতের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ভাষাতেই গান গাওয়ার রেকর্ড রয়েছে লতার ঝুলিতে। সেইদিকেই এবার তাকানো যাক।

মারাঠী ফিল্মসঙ্গীত ও আধুনিক গানের এক সাধক সুরকার ছিলেন সুধীর ফাড়কে। লতা তাঁর সুরে প্রথমবার গেয়েছিলেন প্রভাত ফিল্ম কোম্পানি লিমিটেড-এর ব্যানারে নির্মিত ছবি ‘সন্ত জনাবাঈ’ (১৯৪৯)–তে। জি.ডি. মদগুলকর লিখিত ‘ভরলি গ চন্দ্রভাগা’ গানটি জনমনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ভালজি পেনঢারকার প্রযোজিত ছবি ‘মায়ে বহিনি’ (১৯৫২)–তে লতা সাবলীল ভঙ্গিমায় দুটি অসাধারণ গান পরিবেশন করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ‘মাগতা ন যেথে মিলালতে’ আজও শুনলে মনকে স্পর্শ করে। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘মহারানী যেশুবাঈ’–তে লতা তাঁর অনুপম কণ্ঠমাধুর্য্যের নিদর্শন রেখেছিলেন। সুধীরের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশিত গান– ‘রাত আর্ধি চাঁদ আর্ধি’ আজও মনকে স্মৃতিমেদুর করে তোলে। দুঃখের বিষয়, এ ছবির গানের কোনো গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া লতা-সুধীর জুটির আরও কিছু ছবির গান পপুলার হয়েছিল যার মধ্যে ‘ওভালানি’ (১৯৫৪), ‘সেভগ্যয়াচ্যা সেংগা’ (১৯৫৫), ‘মাঝে ঘর মাঝি মানসা’ (১৯৫৬) মানুষের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল।

১৯৪২ সালে মারাঠী ছবি ‘কিতি হসাল’–এ সর্বপ্রথম প্লে-ব্যাক করেন লতা, যদিও ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়নি। তবে সেই বছরেই মুক্তি পাওয়া মারাঠী ফিল্ম ‘পহিলি মঙ্গলাগৌড়’–এ গাওয়া গান ‘নতলি চৈত্রছি নবলাই’ (রেকর্ড নং– N 15158, লেবেলে লেখা ছিল ‘বেবি লতা’ নামটি) ওঁর প্রথম পার্শ্বগায়ন ধরা হয়ে থাকে। প্রথম হিন্দি ভাষায় গান করেন মারাঠী ছবি ‘গজাভাউ’–তে ১৯৪৩ সালে। গানটি ছিল– ‘মাতা এক সপুত কি দুনিয়া দে তু’। ‘আনন্দঘন’ ছদ্মনামে লতা কয়েকটি মারাঠী ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন। ফিল্মগুলি– ‘রাম রাম পাহুনে’ (১৯৫০), ‘মোহিত্যাঞ্চি মঞ্জুলা’ (১৯৬২), ‘মারাঠা তিতুকা মেলবাবা’ (১৯৬৪), ‘সাধী মানসে’ (১৯৬৫) এবং ‘তাম্বডী মাতি’ (১৯৬৯)। এ সকল ছবির গানগুলি আজও সমস্ত সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
আগেই বলেছি, পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিভাষিক ছবি ‘অমর ভূপালী’-তে লতাকণ্ঠের সুরধারা মাতোয়ারা করে দিয়েছিল তামাম ভারতবাসীকে। সুরসংযোজনায় ছিলেন সুরসম্রাট বসন্ত দেশাই। এছাড়া ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে গাওয়া মারাঠী ফিল্মের গানও লতাকে বিপুল পরিচিতি দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য গানগুলি– ‘ভাত দাওয়ান ভিজুন গেলি’ (ফিল্ম– পাবানাকথচা ঢোঢিঁ– ১৯৬৬), ‘তুমহি্ রে দোন দোনাচ মানসে’ (চানি– ১৯৭৭), ‘মি রাত তাকলি’ (জ্যাত রে জ্যাত– ১৯৭৭), ‘ভিসারু নাকো শ্রীরামা মালা’ (জানকী– ১৯৭৯), ‘মি সোদুন সারি লাজ’ (জানকী– ১৯৭৯), ‘সুন্যা সুন্যা মাইফিলিত মাঝইয়া’ (উমবারথা– ১৯৮২), ‘মাজো লাভতায়ে দাওয়া ডোলা’ (মহানন্দা– ১৯৮৪), ‘মোহে নইহর সে অব তো’ (সরজা– ১৯৮৭) ইত্যাদি।

১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া, জয় ভবানী চিত্র প্রযোজিত ছবি ‘নাইকিনিচা সজ্জা’ সিনেমাপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল মূলত হনসা ওয়াডকর, বাবুরাও পেনঢারকার, রঞ্জনা, ঊষা কারভে, মাস্টার বিঠ্ঠল প্রমুখের মনমাতানো অভিনয়ের দৌলতে। প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার হেমন্তকুমার সৃষ্ট ছটি অসাধারণ গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গানগুলি হল – ‘জিয়া নাহি লাগে মোরা কা করুঁ রাম’, ‘নশিবি মাতে দুঃখাছি লিহিতানা নেত্র তুঝে’, ‘অ্যায়সি তিরছি নজর সে না দেখো হায় হায়’, ‘গড়ে পহিলেচ পাউল হে’, ‘আ মুরলী ভাজে সখি বৃন্দাবনি অজি’ ও ‘তান্ডা চালে চালে রে, সোডোনিয়া গাওঁ রে’। শেষের গানটির সহশিল্পী ছিলেন হেমন্তকুমার স্বয়ং। সঙ্গে ছিল কোরাসের অনন্যসাধারণ ব্যাকিং।

এছাড়া সি রামচন্দ্র, বসন্ত প্রভু, শঙ্কর রাও কুলকার্নি, স্নেহল ভাটকর, দাদা চান্দেকর, শ্রীধর পারসেকর, বসন্ত পাওয়ার, মাস্টার কৃষ্ণরাও, রাম কদম, জিতেন্দ্র অভিষেকি, মীনা মঙ্গেশকর, সলিল চৌধুরী, মহম্মদ শফি, যশবন্ত দেব, প্রভাকর যোগ, শ্রীনিবাস খালে, বাল পার্তে, ভাস্কর চন্দাভারকর, ঊষা মঙ্গেশকর, অনিল মোহিলে প্রমুখের সুর করা মারাঠি ফিল্মি গানের অনন্য ভাণ্ডার লতা কণ্ঠের মাধুর্যে সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছে।
এবার আসা যাক পাঞ্জাবি গান-দুনিয়ায়। একসময় লতার গাওয়া পাঞ্জাবি ভক্তিমূলক গানের লং-প্লে রেকর্ডটি (মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে) জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। সিং বন্ধুদের পরিচালনায় গান– ‘সৎগুরু নানক পরগাতিয়া’, ‘হর যুগ যুগ জগৎ’, ‘মিল মেরে প্রীতমা’ রেডিও সিলোনে প্রায়শই বাজতে শোনা যেত। ডোগরি ভাষায় গাওয়া, মিষ্টি সুরের গানগুলি আজও মন মাতিয়ে চলেছে সঙ্গীতপ্রেমী আঞ্চলিক শ্রোতাদের। কিছু উল্লেখযোগ্য মেলোডি যেমন ‘ভলা সিপাহিয়া ডোগারিয়া’, ‘জম্মু দিয়াকাঁ দিয়া’, ‘গোর রঙ্গ দা করিয়াঁ’ এখনও সুরের আবেশে মনকে মাতাল করে তোলে। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Hamara Photos, Laxmikant Pyarelal, Pinterest,
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।