[১], [২], [৩], [৪], [৫], [৬], [৭], [৮], [৯], [১০], [১১], [১২], [১৩], [১৪], [১৫], [১৬], [১৭], [১৮], [১৯], [২০]
‘রাগ-অনুরাগ’ লেখা যখন প্রায় শেষ, রবিশঙ্কর দিন দশেকের জন্য নিউইয়র্ক গেলেন। কমলাদি ফিরে গেলেন ভারতে। রবিশঙ্করকে হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছাতে গেলাম যখন, এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডন ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ধরে নিয়ে গেলেন ‘স্পিডওয়েজ’ হোটেলে। এলাহি ব্যাপার সেখানে। ইংলিশ বিয়ার দিয়ে গল্প শুরু করে পৌঁছে গেলাম জার্মান ওয়াইনে। রবিশঙ্কর সামান্য একটু ওয়াইন খেলেন। তারপর প্রায় টেন-কোর্স লাঞ্চ। লাঞ্চের শেষদিকে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
বিশেষ অনুমতি নিয়ে হিথরোর ভি আই পি ট্রার্নাজিট লাউঞ্জে গেলাম রবিশঙ্করের (Ravi Shankar) সঙ্গে। রবুদা বললেন, সিগারেট খেতে ইচ্ছে করলে খাও। পারমিশন পেয়ে সিগারেট ধরিয়ে আমি প্রশ্ন করতে থাকলাম ওঁর মার্কিন বান্ধবী স্যু জোনসকে নিয়ে। যাঁকে নিয়ে কমলাদির সঙ্গে মাঝে মধ্যে মনমালিন্য চলছিল। রবুদা স্বীকার করলেন ওই মেয়েটিকে তিনি ভালোবাসেন। যদিও তাতে কমলাদির প্রতি তাঁর ভালোবাসার বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা দেয় না। হঠাৎ খুব আবেগ জড়িত কণ্ঠে বললেন, আমি পারি জানো, দুটো আলাদা মানুষকে আলাদাভাবে ভালবাসতে। মনে হয় মেয়েরা এটা পারে না। তাই কমলাও পারছে না। তুমি আমাকে এতগুলো দিন এত কাছ থেকে দেখলে। আশা করি তুমিও বুঝতে পারছ এ আমার কোনও ভনিতা নয়। আমার কোনও ভনিতা নেই।

ডিপার্চার ঘোষণা করল যখন তখন ব্রিটিশ টাইম আড়াইটে। উঠতে উঠতে রবুদা বললেন, আমি ঘুরে আসি, তারপর একসঙ্গে দেশে পাড়ি দেব। তুমি পারলে এর মধ্যে কোথাও ঘুরে এসো। বললাম, আমি যাচ্ছি ঘুরতে।
-কোথায়?
-হল্যান্ড।
-হল্যান্ড!
-মেনলি আমস্টারডাম।
অমনি হো হো করে হেসে উঠলেন রবিশঙ্কর। বুঝেছি, বুঝেছি, উলঙ্গ মেয়ে দেখতে তো? সব জানি, সব বুঝে গেছি আমি। শুধু দেখো বাপু, কলকাতায় তোমায় যেন আস্ত নিয়ে যেতে পারি।
রবিশঙ্কর নিউইয়র্কে পৌঁছে রাত্তিরে ট্রাঙ্ক করলেন আমাকে, নিশীথদার বাড়িতে। প্রশ্ন শুধু, কেমন আছ? কী করছ? তারপর দু-একদিনে মধ্যে আমি হল্যান্ড রওনা হয়ে যাই। যেখানে বন্ধু হানস আডভিস এবং আডভিসের স্ত্রীকে খেপে খেপে রবিশঙ্করের গল্প শোনাতে হত। আডভিসের বাবা হল্যান্ডের সব চেয়ে বড় মদ ডিস্টিলারির মালিক। কিন্তু ছেলে মার্ক্সবাদী, বাবার থেকে এক পয়সাও নেয় না। স্বামী-স্ত্রী চাকরি করে ছোট সংসার চালায়। মদ, মেয়েমানুষ ছাড়াও আমস্টারডাম দার্শনিক স্পিনোজো ও শিল্পী রেমব্রান্টের শহর। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিত আমার। একবার মেয়েদের গলিতে পাক দিই, তারপর যাই রেমব্রান্টের রাস্তায়। এই করে সময় কাটিয়ে তুরীয় আনন্দে লন্ডন ফিরলাম একদিন দেরি করেই। শুনলাম রবুদা খুব উৎকণ্ঠায় আছেন, ছেলেটার কী হল?
এবার দেশে ফেরার তোড়জোড়। লেখাপত্তর, কাগজপত্র, বই, দেশের লোকজনের জন্য গিফট্, জামাকাপড়, বিলেতে তোলা সব ছবি – সব সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হল সুটকেসে। আর সব কিছুর ওপর পরিপাটি করে রাখা হল ‘রাগ-অনুরাগ’- এর বিশাল পাণ্ডুলিপি।
এবার দেশে ফেরার তোড়জোড়। লেখাপত্তর, কাগজপত্র, বই, দেশের লোকজনের জন্য গিফট্, জামাকাপড়, বিলেতে তোলা সব ছবি – সব সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হল সুটকেসে। আর সব কিছুর ওপর পরিপাটি করে রাখা হল ‘রাগ-অনুরাগ’- এর বিশাল পাণ্ডুলিপি।
আর এই প্রস্তুতির মধ্যেই ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। সেই তারিখটিও ভোলার নয়। ২রা নভেম্বর, ১৯৭৭, ভর সন্ধ্যা, লন্ডন জুড়ে দেদার ঠান্ডা, আর টেলিভিশনের পর্দায় এক অসাধারণ ভয়ের ছবি ‘হ্যান্ড অফ দ্য রিপার’। সুভাষ ডিউটিতে ফিরতে রাত দশটা। তাই কয়েক কৌটো কার্লসবার্গ বিয়ার নিয়ে একা-একাই মনের সুখে দেখে যাচ্ছি ভয়ের ছবি। দরজায় নক করল কেউ একজন। খুলে দেখি সুভাষদের ফ্ল্যাটবাড়ির ম্যানেজার মিক। ছোকরা মিক ৯ ওয়ারিংটন ক্রেসেন্ট প্রপার্টি দেখভাল করে, মিশুকে টাইপ, দিন পনেরো আগে সুভাষ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বাড়ির উল্টোদিকে প্রিন্স অ্যালফ্রেড পাব-এ।

আমায় দেখেই মিক বলল, শঙ্কর, তোমাদের ওপরের তলায় জেনি-র ফ্ল্যাট থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। Must be fine. তুমি একটু আমার সঙ্গে দেখবে এসে?
হে ভগবান আগুন? কিছু না ভেবে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে তরতর করে মিকের পিছু নিয়ে আমাদের সাততলা থেকে উঠে গেলাম আটতলায়। দেখি জেনি-র ফ্ল্যাটের দরজা খোলা আর ভেতরে সব দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর তার মধ্যে বেচারি তরুণীটি পাগলের মতো চেষ্টা চালাচ্ছে ওর দামি জিনিসপত্র খুঁজে বার করতে। মিক প্রায় ধমকের সুরে বলল, জেনি জিনিস খোঁজা ছাড়ো, আগে প্রাণটা বাঁচাও।
বলে মেয়েটার হাত ধরে টেনে বার করে আনল ও। সিঁড়ির গায়ে অ্যালার্ম বেলটা অন করে দিতে বিকট সুরে সাইরেন বাজা শুরু হল। দুদ্দাড় করে সুভাষের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দেখি ঘরের দরজা হাওয়ার ঝাপ্টায় বন্ধ হয়ে গেছে, আর ঘরের চাবিও ঘরের ভেতরে! আমার গায়ে শুধু একটা সোয়েট শার্ট আর পায়ে পাতলা চটি।
মিক আমার পিঠে হাত রেখে বলল, শঙ্কর, শিগগির চলো নিচে, এখানে দাঁড়ানো যাবে না। এক্ষুনি ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করতে হবে।
সোয়েটার, কোট তো বটেই, অনেকেই গায়ে লেপ কম্বল জড়িয়েও নেমে এসেছে আর সবাই দেখছে আমাকে। লন্ডনের মাইনাস দুই ডিগ্রি ঠান্ডায় একটা সোয়েট শার্ট আর চটি পরে রাস্তায়।
তখনও জেনি হাউ হাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। মিক আর আমি ওর দুটো হাত ধরে প্রায় হিড়হিড় করে নামিয়ে আনলাম। আমাদের পিছনে পিছনে নেমে এল জেনির পাশের ফ্ল্যাটের সুন্দরী তরুণী আইরিনও। আর যত নামি দেখি প্রত্যেক তলা থেকে ছেলেমেয়েরা দলে দলে ঘর ছাড়ছে। শেষে বাড়ির গেটের সামনে এসে দেখি এক মস্ত ভিড় ফ্ল্যাটবাসিন্দাদের। সোয়েটার, কোট তো বটেই, অনেকেই গায়ে লেপ কম্বল জড়িয়েও নেমে এসেছে আর সবাই দেখছে আমাকে। লন্ডনের মাইনাস দুই ডিগ্রি ঠান্ডায় একটা সোয়েট শার্ট আর চটি পরে রাস্তায়।
আর এই হচ্ছে লন্ডনের ফায়ার ব্রিগেড- ফোন করার তিন মিনিটের মধ্যে তিন গাড়ি লোক, যন্ত্রপাতি, পাম্প, মই সব হাজির। কালো সুট, হেলমেট দেখতে প্রায় সৈনিকদের মতো। আর সৈনিকদের মতোই জনা বারো ব্রিগেডিয়ার ঝড়ের গতিতে উঠে গেল আটতলায়।
মিনিট পনেরোর মধ্যে আগুন-টাগুন নিভিয়ে ফায়ার বিগেড ফের ফিরে গেল। বেরোবার সময় ওদের ক্যাপ্টেনের গলা গর্জে উঠল- All clear! You may all get in.
সবাই তখন ঘরে ঢোকা শুরু করল। একটি মেয়ে মিশেল এসে আমায় বলল, তুমি এই গেঞ্জি, চটি পড়ে দাঁড়িয়ে কেন?
বললাম, আমার চাবি ঘরের ভেতর। আর ঘর বন্ধ।
ও জিজ্ঞেস করল, কেন বুবু (সুভাষের ডাকনাম) কোথায়?
বললাম, ডিউটিতে। দশটা নাগাদ ফিরবে।
মিশেল বলল, তাহলে তুমি আমার ঘরেই চলো, বুবু এলে ঘরে যেও। মিশেলের সঙ্গে বাড়ি ঢুকব এমন সময় একতলার ফ্ল্যাটের অস্টিয়ান যুবক অ্যান্টন দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, সে কী, বসতে হলে তুমি আমার ঘরে গিয়ে বসবে চলো। তোমার তো আমার ঘরে আমার মোৎজার্ট কালেকশন শোনার কথা। তোমার গায়ে তো গরম কাপড়ও নেই, একটু ব্র্যান্ডিও দিতে পারি তোমাকে।

আমার মনে পড়ল কিছুদিন আগে প্রিন্স অ্যালফ্রেড পাব-এই ওর সঙ্গে আলাপ। বলেছিল তুমি যখন রবিশঙ্করকে নিয়ে কাজ করছ তাহলে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালেও উৎসাহ আছে নিশ্চয়ই। আমার দুশোর মতো লং প্লে আছে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের। একদিন শুনতে এসো সময় করে।
ইচ্ছে ছিল মিশেলের সঙ্গে যাওয়ার, কিন্তু ওর এভাবে বড় মুখ করে বলায় ফাঁপরে পড়লাম। বিব্রত হল মিশেল, বলল -তাহলে তোমরা ছেলেরা গান শোনো, আড্ডা মারো।
অ্যান্টনের ঘরে ঢুকে বিলকুল ধাঁ মেরে গেলাম। বইয়ে বইয়ে রেকর্ডে রেকর্ডে ছয়লাপ। আর একধারে ওয়াইন বার। সে ওয়াইন যে কত রকমের। আমাকে এক গ্লাস দামি ব্র্যান্ডি দিয়ে ও নিজেও একটা নিট স্কচ নিয়ে বসল। আর বসেই বলল, কী কপাল আমার! ওই যে সামনে গোটা দশেক এল পি দেখছ ওগুলো আজই জেনির ঘর থেকে তুলে এনেছিলাম। ভাগ্যিস! নাহলে ওগুলো শেষ হয়ে যেত।
জিজ্ঞেস করলাম, শুনতে দিয়েছিলে?
অ্যান্টন বলল, গিফটই করেছিলাম। তবে ভুল লোককে। এ জিনিস ওর মাথায় ঢোকার নয়।
জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে দিয়েছিলে কেন?
এক ঢোকে পুরো স্কচটা শেষ করে অ্যান্টন বলল, প্রেমে পড়ে মানুষ কতই তো ভুল করে। এও তেমন একটা।
-তার মানে এরকম আরও ভুল করেছ?
নিজের জন্য স্কচ বানাতে বানাতে জোরে হাসল অস্ট্রিয় যুবক, তারপর একটা বেঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়ে গায়ের সোয়েটার, শার্ট সব খুলে ফেলল। আমি চমকে উঠে দেখি ওর বুকের বাঁ পাশ জুড়ে একটা বিশাল চওড়া কাটা দাগ। সেটা দেখিয়ে বলল, এই পাড়ারই পাবে একটা ইংলিশ ছেলে একটা ড্যাগার দিয়ে এভাবে কাটল আমাকে।
জিজ্ঞেস করতেই হল, কেন!
অ্যান্টন বলল, ওর প্রেমিকার প্রেমে পড়েছিলাম বলে।
-তারপর?
-একটা বিয়ারের বোতল ভেঙে ওর পেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।
-তো?
-দুজনই মরতে মরতে বাঁচলাম আর চার বছর করে জেল খাটলাম।
অ্যান্টনকে ও কাটিয়েছে বলে পাগলাটা নাকি ওর সমস্ত রেকর্ড ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। শাসিয়েও গেছে দেখে নেবে।
জিজ্ঞেস করলাম আগুনটা তাহলে কি অ্যান্টনই লাগিয়েছিল?
সুভাষ বলল, দেখা যাক।
শিউরে উঠতে উঠতে তিনটি ব্র্যান্ডি খাওয়া হয়ে গেছে আমার। পাগলের কেচ্ছা শুনতে শুনতে ভেতরে পালাই পালাই ভাব, কিন্তু পালাব কোথায়? ঘরের চাবি তো নেই। এমন সময় বেল বাজল ফ্ল্যাটের, দেখি সুভাষ আমাকে নিতে এসেছে। হাতে পাকিস্তানি দোকানের অপূর্ব বিরিয়ানি। যা খেতে খেতে অ্যান্টনের ব্যাপারগুলো শোনালাম ওকে। ও বলল, আইরিন বলছিল জেনির নতুন প্রেমিক হয়েছে এক মরোক্কান ছোকরা। অ্যান্টনকে ও কাটিয়েছে বলে পাগলাটা নাকি ওর সমস্ত রেকর্ড ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। শাসিয়েও গেছে দেখে নেবে।
জিজ্ঞেস করলাম আগুনটা তাহলে কি অ্যান্টনই লাগিয়েছিল?
সুভাষ বলল, দেখা যাক।
বেশি দেরি লাগেনি দেখতে। ঘুম থেকে উঠে চায়ে প্রথম চুমুক দেওয়ার আগেই দেখলাম একদল পুলিশ এসে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল অ্যান্টন ভের্ডার নামের অস্ট্রিয় যুবককে। ওর রেডিওগ্রামে নাকি তখন পাদেরুস্কির বাজানো পিয়ানো কনচের্তো বাজছিল। যেটা আমাকে শোনাবে বলে বার করেছিল।
(চলবে)
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।