(Egg Shell Art) এবার একটু আমার নিজের কথায় আসা যাক…..
ডিমের খোলা দিয়ে কাজ বা এগ শেল আর্ট আমার কাছে নতুন নয়, ছোটবেলা থেকেই আমি আর্ট এন্ড ক্রাফট খুব ভালবাসতাম, বিশেষ করে ক্রাফট। বিভিন্ন রকমের জিনিস যেমন মাটি, কাঠ, কাচ, বাঁশের কাঠি, নানান ধরণের ডাল, খড়ের টুকরো এমন কী ইঞ্জেকশনের শিশি দিয়েও নানা রকমের শো-পিস এবং গিফট আইটেম বানাতাম। (Egg Shell Art)
ভাবনা এবং ডিজাইন সবই আমার নিজস্ব ছিল, কারণ ৫৫/৫৬ বছর আগে তো আর ইন্টারনেটের সুবিধা ছিল না! তারপর একদিন আবর্জনায় পড়ে থাকা কয়েকটা আধখানা ডিমের খোলার আকৃতি দেখে ডুগি-তবলার সঙ্গে সামঞ্জস্য পাই। তখন সেই ডিমের খোলা কাঁচি দিয়ে কেটে একটা ডুগি তবলা বানিয়ে ফেলি। ডিমের খোলার কাজের সেই শুরু, ৪৭ বছর আগে বানানো একটি ডুগি-তবলা আজও অক্ষত আছে। ডিমের খোলার জিনিসও যে কত টেকসই হতে পারে এ তারই নিদর্শন। (Egg Shell Art)








ছবি গুলিতে ক্লিক করে স্লাইডে দেখুন
২০১৩ সালে অবসর নেওয়ার পর আবার সেই পুরনো আর্ট এন্ড ক্রাফটের শখ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আসলে এই শিল্প-কলা ব্যাপারটা অনেকটা ক্যান্সার জীবাণুর মতো। মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে। প্রায় ৪০বছর পর সে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আবার সেই ডিমের খোলা নিয়ে মেতে উঠলাম। এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করলাম। ইন্টারনেটে খোঁজখবর নিতে থাকলাম। (Egg Shell Art)

কিন্তু মুশকিল হল এই যে, এ কাজ ভারতের বাইরে হয় বটে, কিন্তু ভারতে তেমন হয় না। তাই এ ব্যাপারে শেখার কোনও সুযোগই নেই, অগত্যা নিজে নিজেই শেখার চেষ্টা করতে থাকলাম। এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি অর্থাৎ হাইস্পীড মিনি-ড্রিলিং মেশিন এবং নানা ধরণের সুক্ষ্ম ড্রিলিং-বিটও জোগাড় করলাম। (Egg Shell Art)

এইভাবে প্রায় একটানা বছর দশেক লেগে থাকার পর আমি এই এগ শেল আর্টকে সামান্য একটু পরিচিতি দিতে পেরেছি। আরও অনেক কিছু শেখার আছে, আরও অনেক রকমের কাজ করার ইচ্ছেও আছে। জানি না আর কতদিন করে উঠতে পারব, কারণ এই কাজে খুব ধৈর্য এবং মনোনিবেশ লাগে, সেইসঙ্গে হাতের পটুতাও জরুরি। তাই আমি চাই, এই ডিমকারি শিল্পে নতুন প্রজন্ম আকৃষ্ট হোক, এগিয়ে আসুক এই আর্টকে তুলে ধরতে এবং নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে। আমার এই ১০/১১ বছরের অধ্যবসায়ে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি, আমি তা পরের প্রজন্মকে দিয়ে যেতে চাই। (Egg Shell Art)

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের সহায়তায় এই বছরের শুরুতে একটি ওয়ার্কশপ করেছি। আগামী বছরের শুরুতে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে আমার ডিম-শিল্পের একটি এক্সিবিশন এবং ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হবে। আশাকরি এইভাবেই এগ শেল আর্ট একটু একটু করে বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে পড়বে, এইটুকুই আমার চাওয়া। (Egg Shell Art)

ডিম-শিল্পের কিছু কাজের কথা…
সব শিল্প-কলারই নানান ধরণের বিভাগ থাকে, উপবিভাগ থাকে। ঠিক তেমনই এই “এগ শেল আর্ট”-এর কয়েকটি বিভাগ আছে, সে কথা আগেই বলেছি। পুরাকালে মূলত ডিমের খোলা বা সেদ্ধ ডিমের উপর পেন্টিং-এর কাজ হত নানান ধরণের রঙ এবং মোম-রঙ ব্যবহার করে। এইসব এগ আর্ট সাধারণতঃ মুরগী, হাঁস, রাজ-হাঁসের ডিম দিয়েই বানানো হত, তবে অস্ট্রিচের ডিমের উপরেও এই ধরণের কাজের নমুনা রয়েছে। পূর্ব ইউরোপে এই আর্ট “ইস্টার এগ” হিসেবেই বিখ্যাত ছিল, যা উপহার সামগ্রী হিসেবে আদান প্রদান করা হত। (Egg Shell Art)

পরবর্তীকালে পেন্টিং এর বদলে ডিমের খোলায় কাটিং এবং এনগ্রেভিং এর কাজ শুরু হয়। সাধারণত সেগুলো করা হত অস্ট্রিচের ডিমের খোলায়, কারণ এই ডিমের খোলা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ডিমের খোলার চেয়ে অনেক বড় এবং শক্ত। এভাবেই অস্ট্রিচের ডিমের খোলায় নানা ধরণের সূক্ষ্ম ডিজাইনের কাজের প্রচলন শুরু হয়, যা পৃথিবীর অনেক জায়গায়, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলিতে খুবই প্রচলিত এবং বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তার মূল কারণ ঐসব দেশে অস্ট্রিচের ডিম সহজেই পাওয়া যায়।






ছবি গুলিতে ক্লিক করে স্লাইডে দেখুন
মুরগী বা হাঁস জাতীয় পাতলা ডিমের ছোট খোলায় সাধারণত ঐ ধরণের ছিদ্র ও খোদাই-এর কাজ খুব একটা হয় না, পেন্টিং-এর কাজই বেশি হয়। আমি সেটাই করার চেষ্টা করেছি। এবং এটাই প্রমাণ করতে চাই যে ঐ ধরণের সূক্ষ্ম ডিজাইনের কাজ ছোট ডিমের খোলাতেও করা সম্ভব।








ছবি গুলিতে ক্লিক করে স্লাইডে দেখুন
এই ডিম-শিল্পের কাজ লিখে বা বলে শেখানো হয়তো যাবে না, তবে এই কাজের পদ্ধতির একটা সম্যক ধারণা দেওয়া যেতেই পারে। যেমন প্রথমে কাঁচা ডিমের মধ্যে দুদিকে দুটো ছোট ফুটো করা হয় ড্রিলিং মেশিন ব্যবহার করে, একদিকের ফুটোটা একদম আলপিনের সাইজের হবে, আর তার ঠিক উল্টোদিকের ফুটোটা একটা সরু পেন্সিলের সাইজের মতন হবে, এবার ছোটো ফুটোতে মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে ব্লো করলে বড় ফুটো দিয়ে ডিমের কুসুম এবং সাদা অংশ বেরিয়ে আসবে। এইভাবে পুরো জিনিসটা বার হয়ে গেলে ডিমটি ভাল করে জল দিয়ে বারবার ধুয়ে নিতে হবে, তারপর সেই ডিমের খোলাটিকে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।

যে কোনও রকম শিল্পকলা করার জন্য একটা ক্যানভাস এর প্রয়োজন, সে কাগজ, কাপড় কিম্বা দেওয়াল যাই হোক না কেনো, এক্ষেত্রে ঐ খালি ডিমগুলিই ক্যানভাসের কাজ করে, যার উপরে বিভিন্ন ধরণের শিল্পকলা দিয়ে ভরিয়ে তোলা যায়।
ছবি সৌজন্য: লেখক
ভূপদার্থবিদ, ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানী (ওএনজিসি) থেকে জেনারেল ম্যানেজার পদে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আর্ট ও ক্রাফটের প্রতি অনুরক্ত। কাঠ, কাচ, মাটি এবং ডিমের খোলা দিয়ে নানান রকমের জিনিস বানাতে ভালবাসেন। বিগত প্রায় ১০/১১ বছর "এগ শেল আর্ট" নিয়ে কাজ করছেন, বাংলা তথা ভারতে যার চল নেই বললেই চলে। কলকাতার অ্যাকাডেমিতে কয়েকবার এক্সিবিশনও হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। লেখালেখিও করেন, মূলত রম্যরচনা। দেশ প্রত্রিকা এবং সংবাদ প্রতিদিনের পূজাসংখ্যায় তাঁর রচিত রম্যরচনা প্রকাশিত। রম্যরচনা সংকলনের দুটি বইও আছে।