যদি আক্ষরিক অর্থেই কাউকে ঠোঁটকাটা বলতে হয়, তবে সেটা বলতে হবে ইথিওপিয়ান আদিবাসী মুর্সি গোষ্ঠীর মহিলাদের। তাঁদের মতো ঠোঁটকাটা পৃথিবীতে আর দুটো নেই। সেই ক্যালেন্ডারে কিংবা সিরিয়ালে যেমন ছবি দেখি, হনুমান বুক চিরে রামসীতা দেখাচ্ছে, মুর্সি মেয়েরা তেমনই নিজেদের নীচের ঠোঁট চিরে চায়ের প্লেট ঢোকায়। ছবিতে না কিন্তু। বাস্তবে। অমনটাই ফ্যাশন ওদের। ভাবুন একবার!!
মুর্সিরা থাকে ইথিওপিয়ার দক্ষিণ ওমো উপত্যকার বনে-জঙ্গলে। এই দক্ষিণ ওমো উপত্যকায় কয়েকদিন এসে থাকলে মুর্সি, বানা, হামার, কারো, দসানচ এমন নানা আদিবাসীদের দেখা পাবেন। দেখা পাবেন বললে কম বলা হয়। দেখতে বাধ্য হবেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আফ্রিকার অর্ধ-উলঙ্গ বনচারী আদিবাসী সবাই। কারও গায়ে পশুর ছালের পোশাক, মাথায় পালক, চুলে জবজব করছে মাখনমিশ্রিত লাল মাটি, কারও গা ভরে হরেকরঙা পুঁতির, ধাতুর বা পশুর হাড়ের গয়না, কারও কারও সারা গায়ে-মুখে খড়িমাটি দিয়ে নকশা আঁকা। দুর্দান্ত ফটোজেনিক ব্যাপার স্যাপার! দেখলেই রিফ্লেক্স অ্যাকশনে হাত চলে যাবে ক্যামেরায় বা মোবাইলে। তবে ফটোজেনিক হওয়ার দৌড়ে এইসব আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সব চেয়ে এগিয়ে থাকবে মুর্সি গোষ্ঠীর ঠোঁটকাটা মেয়েরা।
পনেরো-ষোলো বছর বয়স হলেই ওদের নীচের ঠোঁট চিরে, কাটা জায়গায় কাঠের টুকরো গুঁজে দেওয়া হয়। পরদিন টুকরোটা বের করে আর একটু বড় সাইজের টুকরো ঢোকায়। তারপর দিন আর একটু বড়। এইভাবে রোজ কাটা ঠোঁটে টান পড়তে পড়তে কাটা অংশের ফাঁকটা বাড়তে থাকে। তখন মাটির গোলাকার চাকতি লাগিয়ে দেওয়া হয় ওইখানে। কয়েকমাস ছাড়া ছাড়া চাকতি বদলানো হয়। একটু বড় চাকতি, তারপর আর একটু বড়। এরকম করে করে ঠোঁটের কাটা অংশ বাড়তে বাড়তে যখন চায়ের প্লেটের সমান সাইজের চাকতি ধারণ করতে সক্ষম হয়, তখন সেইটাই হয়ে যায় স্থায়ী অলংকার। সেই মাটির প্লেটে আবার সাদা-কালো-হলুদ দিয়ে নকশা আঁকা থাকে। অতবড় প্লেটের ভারে নরম ঠোঁট উলটে ঝুলে থাকে গলা অবধি। নিচের পাটির দাঁত, মাড়ি সব বেরিয়ে পড়ে।
জঙ্গলটার নাম মাগো ন্যাশানাল পার্ক। সেটা পেরিয়ে আমরা গেছিলাম মুর্সিদের গ্রামে। আমাদের সারথি মাইক আর গাইড মামারু। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় থেকে থেকেই থামতে হচ্ছিল হরেকরঙা পাখিদের ফ্রেমবন্দি করতে। এই জায়গায় যে এত রকম রঙের পাখি দেখা যায়, তা এখানে আসার আগে জানতামই না। আমরা কেবল রঙবেরঙের মানুষ আছে বলেই জানতাম। গত কয়েকদিনের দক্ষিণ ওমো ভ্যালি ঘোরার অভিজ্ঞতায় বারেবারে মনে হয়েছে, প্রকৃতির কোলেপিঠে বড় হয়ে ওঠা এই মানুষরা প্রকৃতির মতোই সুন্দর হয়ে উঠতে চায়। তাই পাখির পালকের বর্ণ-ঔজ্জ্বল্যের অনুসরণ তাদের গয়নাগাঁটিতে ফুটে ওঠে।

মুর্সিদের গ্রামে গিয়ে বুঝলাম, মানুষের বিচিত্র সাজগোজের কাছে পাখিরাও হার মেনে যাবে। টিভি, ইন্টারনেটের সূত্রে ঠোঁটে-প্লেট মুর্সি মেয়েদের ছবি তো আগেই দেখেছি। তা সত্ত্বেও শরীরের ওপর এই স্বেচ্ছা-যন্ত্রণা যে মানুষ সত্যি সত্যি প্রয়োগ করে, তা জলজ্যান্ত চোখের সামনে ঘুরতে না দেখলে বিশ্বাস হতে চাইত না! এরকম ঠোঁটের নিচে প্লেট ঝুলিয়ে ওরা খায়, ঘুমায়? মামারু বললেন– না না। সবসময় নয়। গয়না তো। ইচ্ছেমতো খোলে-পরে। তবে উৎসব-অনুষ্ঠানে, নাচগানের সময়, বাড়ির পুরুষদের খেতে দেওয়ার সময় পরবেই। আর পরে গ্রামে টুরিস্ট এলে। কারণ টুরিস্টরা এরকম ঠোঁটে চাকতি ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখলেই ছবি তোলে। আর নিয়ম হল কারও ছবি তুললে তাকে পাঁচ বির (ভারতীয় বারো টাকা) দিতে হবে। কাজেই…
আমাদের দেখে এক মহিলা ঠোঁট থেকে মাটির চাকতিটা খুলে হাতে নিয়ে দেখিয়ে আবার পরে নিলেন। আমি তো ভারি বীরাঙ্গনা, তাই এক চোখ বন্ধ করে আর এক চোখ পিটপিট করে সেই সব খোলা-পরা দেখলাম। বাস্তবিক, ব্যাপারটা ওদের জন্য কষ্টকর কিছু না। ঠোঁটের ঘা তো সেই কবেই শুকিয়ে গেছে। এখন চাকতি খোলা-পরা আমাদের কানের দুল খোলা-পরার মতোই পাতি ব্যাপার। কিন্তু খোলার পর গোল করে কাটা বিশাল বড় নিচের ঠোঁটটা চিবুক ছাপিয়ে ঝুলছে দেখে গা শিরশির করে উঠল। খেয়াল করলাম ওদের কানের লতিতেও অমনভাবে ফুটো করে মাটির চাকতি লাগানো। তবে ঠোঁটের মতো অতবড় না। ইঞ্চিচারেক চওড়া হবে। আর মেয়ে-ছেলে সকলেই কানে চাকতি পরে; ঠোঁটে অবশ্য শুধু মেয়েরা। আমাদের অরুণাচলের আপাতনি জনগোষ্ঠীর মহিলারাও কেউ কেউ নাকে এরকম চাকতি পরে। তবে সেগুলো মুর্সিদের চাকতির তুলনায় অনেক ছোট।
ওদের ছেলেমেয়ে সকলের হাতে, পিঠে, বুকে, পেটে দেখলাম অজস্র ক্ষতচিহ্ন। কোনও মারপিট, দুর্ঘটনার ব্যাপার নয়। নিজেদের শরীরে নিজেরা বা অন্য কাউকে দিয়ে কাচের টুকরো বা ছুরির সাহায্যে খুঁচিয়ে ঘা করে। চামড়া ভেদ করে মাংস পর্যন্ত কেটে যায় তাতে। তারপর কাটা জায়গায় গাছের রস, কাঠকয়লার গুঁড়ো দিয়ে ইচ্ছে করে ইনফেকশন বাঁধায়। তাতে হয় কী, ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পরেও কাটা অংশ বরাবর চামড়া ফুলে উঁচু হয়ে থাকে। যে যেমন প্যাটার্নে কাটবে, তেমন নকশা হয় তার শরীরে।
সরলরেখায় জ্যামিতিক নকশা, জিলিপির প্যাঁচ, ঢেউ, ফুলছাপ, ডোরাকাটা যা খুশি হতে পারে। কেউ কেউ পাশাপাশি ছোট ছোট ঘা বানিয়ে বুটি বুটি প্যাটার্ন বানায়। এর আগে দসানচ বা কারো জনগোষ্ঠীর আদিবাসীদের গায়েও এমন দেখেছি, কিন্তু মুর্সিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই ব্যাপারটা। আদিবাসীদের থ্রি-ডি ট্যাটু বলা যায় কি একে? কিন্তু ট্যাটু করা হয়তো এর চাইতে ঢের কম যন্ত্রণাদায়ক। সে তো শুধু চামড়ার ওপরের স্তরে খোঁচাখুঁচি। অল্পদিনেই ঘা শুকায়। আর এখানে কমের পক্ষে ছ’মাস থেকে এক বছর লেগে যায়!

কিন্তু এসব কেন? কেন? কেন? মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। মামারু বললেন, সবই নাকি সৌন্দর্যায়ন! গায়ের ঘা যার যত বেশি, তার যৌন আবেদন তত বেশি! আর ঠোঁটের চাকতি যার যত বড়, সে মেয়ে ওদের চোখে তত সুন্দরী; ম্যারেজ মার্কেটে তার ভ্যালু বেশি। এখানে বিয়েতে কন্যাপণ দেওয়া হয়। মুর্সিরা জোয়ার, ভুট্টা চাষ করলেও মূলত পশুপালক। পণ হিসাবে গরুছাগল দেয় বরের বাড়ি। যে মেয়ের ঠোঁটের চাকতি যত বড়, তার বাপ তত বেশি গরু পাবে মেয়ের বিয়েতে।
ভারী অবাক হয়ে বলতে যাই– এ আবার কী কথা! ঠোঁটে চাকতি লাগালে তো অদ্ভুত দেখায়, ভয়ংকর দেখায়। সুন্দর দেখায় না মোটেই! কিন্তু বলতে গিয়েও বলি না। কারণ, আসলে তো সৌন্দর্যবোধ একেবারেই আপেক্ষিক বিষয়, তাই নয় কি? সুন্দরের ধারণাটা নিজের রুচি আর প্রবণতা অনুযায়ী তৈরি হয়। যে বিষয়টাকে যে যতটা গুরুত্ব দেয়, সেটাই তার কাছে সৌন্দর্যের মাপকাঠি, যেমন মুর্সিদের কাছে এই মাপকাঠি হল কষ্টসহিষ্ণুতা।
আদিবাসীদের মধ্যে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে একটা তীব্র গর্ব আছে। যাঁর যত বড় ঠোঁটের চাকতি, যাঁর গায়ে যত বেশি ক্ষত, অর্থাৎ কিনা যাঁর শরীরে কষ্টসহিষ্ণুতার চিহ্ন যত বেশি, ওদের চোখে তিনি তত বেশি সুন্দর। বিপদসঙ্কুল বন্য পরিবেশে যাঁদের বাস, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাঁদের চলতে হয়, তাঁদের যাপনের সঙ্গে সাহস আর সহ্যশক্তির অভ্যাসটা জড়িয়ে থাকে। জড়িয়ে রাখতে হয়। অভ্যাসটাকে করে ফেলতে হয় অঙ্গের ভূষণ। তবেই না ভয়ের সঙ্গে একহাত লড়ে নেওয়া যাবে!
আমাদের বাইরে থেকে মনে হতে পারে এসব বর্বর লোকাচার। কিন্তু বাস্তবে এই লোকাচার বা ফ্যাশন, যাই বলা হোক না কেন, তার সঙ্গে মুর্সিদের প্রবল আত্মগৌরব জড়িয়ে থাকে। এখানে কাউকে জোর করা হয় না এভাবে সাজতে– বললেন মামারু। কাউকে বলা হয় না, তোমাকে গা ভরে কাটা ঘায়ের নকশা বানাতেই হবে। কোনও মেয়ে চাইলে ঠোঁট কাটতে নাও পারেন। একজন-দু’জনকে তেমনও দেখলাম। তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ আদিবাসীই এসব স্বেচ্ছায় করেন। যখন কাটা ঘায়ে ইনফেকশন হয়ে তীব্র জ্বালা করে, যখন কাঠের টুকরো দিয়ে টানটান করে রাখা কাটা ঠোঁটে অসম্ভব চাপ লাগে, তখন শারীরিক কষ্টের সেই প্রতিটি মুহূর্ত ওঁদের অহংকে তৃপ্ত করে। নিজের চোখে নিজেকে জয়যুক্ত করে। জয়ী হতে কে না চায়, বলুন? আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, স্বেচ্ছাক্লেশ আর বর্বরতা কিন্তু এক নয়।

মুর্সিদের সাজগোজের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল, ওদের মাথার গয়না বা মুকুট। নাহ, এর মধ্যে স্বেচ্ছাক্লেশ নেই। যা আছে, তাকে আমি বলব অসাধারণ সৃষ্টিশীলতা। দড়ি, চামড়া বা গাছের ছাল দিয়ে তৈরি হেয়ারব্যান্ড লাগানো মাথায়। কানের লতির দুপাশে নেমে এসেছে ব্যান্ডের যে দুইপ্রান্ত, তা থেকে ঝুলছে বড় বড় লোহার কড়া। প্রতিটা কড়া থেকে চাবির রিঙের মতো ঝুলছে আরও পাঁচ-ছটা লোহার কড়া। সেগুলো থেকে যে কত কী ঝুলছে– পাখির পালক, বড় বড় মোষের শিং, নানারকম পশুর দাঁত। নেমে এসেছে কাঁধ ছাপিয়ে বুক অবধি। কারও হেয়ারব্যান্ডের দু’প্রান্তে দুটো বিশাল বিশাল পশুর শিং লাগানো। কারও হেয়ারব্যান্ড থেকে ঝালরের মতো কপাল পর্যন্ত ঝুলে আছে অসংখ্য পুঁতির গয়না। কেউ আবার বোতলের ছিপি গেঁথে গেঁথে মালা তৈরি করে মাথা থেকে ঝুলিয়েছে। কারও মাথা থেকে ঝুলছে রাশি রাশি ভুট্টা। অনেকের মুকুট ভরা গোছা গোছা পাতিলেবুর মতো দেখতে হলুদ ফল। কারও মাথাভরা ফুল। কারও অজস্র শুকনো ফল। কতরকমের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপাদানকে কাঠকুটো, লতাপাতা দিয়ে জুড়ে যে মাথা সাজানো যায়, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হল কারও মুকুটের সঙ্গে কারও মিল নেই। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়!
আরও পড়ুন: যূথিকা আচার্যের কলমে: কে কার অলংকার
মাথার মুকুটগুলো যে যথেষ্ট ভারী, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ওঁদের সহ্যশক্তির কাছে কিছুই নয়। মনে হল, আমরা টুরিস্টরা এসেছি বলে, ছবি তুলতে দিয়ে রোজগার করবেন বলে এগুলো পরে ঘুরছেন কি ওঁরা? তারপর খেয়াল করলাম, কিছুটা দূরে এক মহিলা গেরস্থালির কাজকর্মে ব্যস্ত, মাথাভরা ফলমূলের মুকুট পরে। আর এক জায়গায় এক বৃদ্ধা বসে বসে আগুন পোয়াচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় একটা বড় বাটি বসানো। বাটিটা মাথায় নিয়ে এমনিই বসে আছেন। ওটাই ওঁর সাজ। ছবি তোলানোর জন্য বসেছেন, তা মোটেই নয়। বাটিটা কিসের তৈরি বোঝা যাচ্ছে না, কারণ তার গায়ে খড় দিয়ে তৈরি দড়ি পেঁচানো আছে।
মুর্সি মেয়েদের কেউ কেউ সারা মুখ ও শরীরে খড়িমাটি দিয়ে নকশা এঁকেছে দেখলাম। এইভাবে বডিপেন্টিং করা কারো জনগোষ্ঠীরও বিশেষত্ব। কারোদের নকশাগুলি আরো সুন্দর ও সূক্ষ্ম হয়। মুর্সিদের আঁকিবুকি সে তুলনায় কিছুটা সাদামাটা।
দেখলাম, ওঁরা সকলেই প্রায় পাতলা কম্বলের মতো কাপড় গায়ে পেঁচিয়ে রয়েছেন। রাতে হয়তো এগুলোই গায়ে দিয়ে ঘুমোন। এখন ভোরবেলা বেশ ঠান্ডা আছে। তাই এগুলোই গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। কম্বলগুলির উপরে ইংরেজি হরফে এটা সেটা লেখা প্রিন্ট। বোঝাই যাচ্ছে, একেবারেই বাইরে থেকে আমদানি করা জিনিস। দক্ষিণ ওমো-তে মধ্যে মধ্যে যে সব গঞ্জ এলাকা আছে, সেখানে সাপ্তাহিক হাট বসে। সেসব হাটে শহরের লোকেরা মাঝেমধ্যে কাপড় বেচতে আসে। সেখান থেকেই কেনা।
মোটামুটি দু’রকম ডিজাইনের কম্বলই সবাই পরছেন। সবার কম্বলই দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা পুরনো নয় এবং একই সময়ে কেনা। সম্ভবত এঁরা কিছুদিন আগে অবধিও শীত থেকে বাঁচতে পশুর চামড়া গায়ে দিতেন। হয়তো সাম্প্রতিক অতীতে নিকটবর্তী হাটে একইরকম কম্বলের দুটো লট এসেছিল, গ্রামের সবাই কিনে নিয়েছেন। পরার মতো আর কোনও পোশাক বা শীতপোশাক ওঁদের নেই। তবে কম্বল দিয়ে গা ঢাকলেও মহিলাদের অধিকাংশেরই বুক পুরোপুরি ঢাকা নয়।

আমাদের তথাকথিত ‘সভ্য’ দুনিয়ার সামাজিক অভ্যাসে শরীরের অমুক অমুক অংশ ঢেকে রাখার অলিখিত ফরমান জারি থাকে; তার অন্যথা করাকে ভারি নির্লজ্জ, অশোভন গণ্য করা হয়। মুর্সি-সহ দক্ষিণ ওমো উপত্যকার আদিবাসীদের এমন কোনও লজ্জাবোধ নেই। শীত থেকে বাঁচতে ওঁরা গায়ে পশুর চামড়া জড়ান বা জড়াতেন বটে; কিন্তু লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরার ধারণা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ওঁদের ছিল না। সত্যি বলতে, এখনও নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঁরা ‘সভ্য’ দুনিয়ার সংসর্গে এসেছেন এবং ওঁদের মাথায় ঢুকেছে যে বাইরের লোকের সামনে গায়ে কিছু একটা জড়িয়ে রাখতে হয়। তবে ঠিক কোন কোন অঙ্গ ঢেকে রাখা অত্যাবশ্যক, সেই তথাকথিত ‘সভ্য’ দুনিয়াসুলভ সচেতনতা অবশ্য ওঁদের এখনও আসেনি।
তবে কোনও কোনও মুর্সি মহিলার হাবভাব দেখে মনে হল, স্তন উন্মুক্ত রাখাটা লজ্জাবোধ বিষয়ে অসচেতনতা নয়, বরং নিজেকে বেশি ফটোজেনিক করে তলার অতিসচেতনতাও হতে পারে। এর মধ্যে কোনও যৌন সুড়সুড়ি নেই কিন্তু। ঊর্ধ্বাঙ্গ আঢাকা থাকলে অবশ্যই ওদের ‘আদিম’ স্বাতন্ত্র্য বেশি করে ফুটে ওঠে, টুরিস্ট-ফোটোগ্রাফারের লেন্স সেইসব মেয়েদেরকেই বেশি করে ‘সাবজেক্ট’ নির্বাচন করে। এবং ছবিপিছু মেয়েদের পাঁচ বির উপার্জন। কাজেই কাউকে কাউকে দেখলাম আমাদের কাছেপিঠে এসে ইচ্ছে করেই যেন কম্বল একটু নামিয়ে নিলেন।
তবে পোশাক কীভাবে পরতে হবে, বা আদৌ পরতে হবে কিনা সে নিয়ে ওঁদের অসচেতনতা বা অতিসচেতনতা যাই থাক, যা নিয়ে ওঁরা মোটেই মাথা ঘামান না, তা হল পোশাকের ফ্যাশান। পোশাক জিনিসটা একেবারেই ওঁদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা বিষয়, তাই যা হোক একটা কিছু পরলেই হল। আমরা দোকানে গিয়ে দশটা আলাদা আলাদা পোশাক দেখার পর একটা নির্বাচন করি। ওঁরা হাটে গিয়ে যা পান, সেটাই কেনেন। পোশাকের প্রতি কোনও ভালোবাসা নেই, তাই পোশাকের চয়েসও নেই। এটা শহর থেকে হাটে আসা ব্যাপারিরাও বোঝেন, তাই তাঁরাও বান্ডিল বান্ডিল একই পোশাক নিয়ে চলে আসেন। সেসব দিব্যি বিক্রিও হয়ে যায়।
কিন্তু তা বলে কি ওঁরা ফ্যাশন-সচেতন নন? তা একেবারেই বলা যাবে না। ওই যে বললাম, প্রত্যেকের মুকুট আলাদা। যে ফ্যাশান স্বাভাবিকভাবেই যুগ যুগ ধরে ওঁদের যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তার ব্যাপারে ওঁরা অত্যন্ত যত্নশীল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ওঁদের নিজস্ব ফ্যাশানের উপাদানগুলো প্রকৃতি থেকেই ওঁরা পেয়ে যান। বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয় না। বাজারের তো তাতে ভারী লোকসান! তাই বাজারকেই কৌশলে ‘পোশাক পরে সভ্য সাজো’ মার্কা ধারণা ওঁদের মাথায় ঢোকাতে হয়েছে।
এদিকে ওঁরাও এটা বুঝেছেন, যে পুরোপুরি ‘সভ্য’ সেজে ফেললে চলবে না। তাতে ওঁদের লোকসান বেশি। ওঁদের স্বতন্ত্র ফ্যাশন ওঁরা যত বেশি আঁকড়ে রাখতে পারবেন, ওঁদের গ্রামগুলিতে তত বেশি পর্যটক আসবে। আর বেশি পর্যটক মানেই বেশি উপার্জন। তাই বাজার অর্থনীতি ওঁদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুরোটাও গিলে নিতে পারেনি। কিছুটা ওঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদেই।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
রেশমী বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করতে শিক্ষকতা করেন, বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে ভ্রমণ করেন। এককালে সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে আলপিন টু এলিফ্যান্ট যা ভালো লাগে, তাই নিয়েই চর্চা করেন। আদ্যন্ত পল্লবগ্রাহী; সে জন্য বিশেষ লজ্জিতও নন। মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় ভ্রমণকাহিনী লেখেন। এছাড়া লেখেন নিজস্ব ওয়েবসাইটে - www.comecrosstheline.com