গ্লেনারিজের সামনে সেই মুখ, গোলাপি জ্যাকেট, খোলা চুল, হালকা লিপস্টিক, যদিও চোখে চোখ পড়লে আজ খুব অচেনা মনে হয় মানুষের ঢল নেমেছে ম্যালে, দাস স্টুডিয়ো বাঁ হাতে রেখে সোজা হেঁটে গিয়ে এক কাপ মকাইবাড়িতে ডুবে থাকা এক টুকরো দার্জিলিংরঙের গোধূলি পাওয়া যায়, কেভেন্টার্সের ছাদে বেকনের প্লেটে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ছুঁড়ে দেওয়া চিরকুট। এন.জে.পি. কিংবা বাগডোগরা থেকে চুলকাঁটা বাঁক পেরিয়ে পেরিয়ে ‘ ঘুম’ পৌঁছে গেছে যে ‘কাপল’, তারা জানে, গন্তব্য আর বেশি দূরে নেই ; মনে পড়ে, সেন্ট পল্স স্কুলের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, কোনওদিন কেউ জিজ্ঞেস করেছিল – ” গন্তব্যের চেয়ে, যাত্রা কি বেশি জরুরি নয় …. ইজন্ট জার্নি মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান দ্য ডেস্টিনেশন?”, এখন লাডেন-লা রোড বেয়ে একা একা নেমে যেতে যেতে মনে হয় – কিছু কিছু জার্নি ঠিকমতো শেষ হবার আগেই একটা অপ্রয়োজনীয়, আকস্মিক গন্তব্য এসে যায়। ম্যালের আশেপাশে তিব্বতি গয়নার দোকান, “এখানে চাম্বা-লামা-র চেয়ে অনেকভাল স্টক, আমার টাইম লাগবে …” – বলে ওঠে কেউ, কেউ ম্যাল থেকে একটু নীচে নেমে, সিসিডির উল্টো দিকের সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে, সিগারেট ধরায়। প্লান্টার্স ক্লাবের বারান্দায় চা-বাগান- বাবুদের হৃত গৌরব পড়ে থাকে, গ্লেনারিজের সামনে চেনা মুখ, হাল্কা লিপস্টিক, গোলাপি জ্যাকেট, “কেমন আছো “- বলতে গিয়ে মনে পড়ে, কিছু কিছু জার্নি ঠিকমতো শেষ হবার আগেই একটা গন্তব্য এসে যায়, যা আসলে এক গভীর খাদ। খাদ থেকে হাত নেড়ে ওঠে পুরোনো রুমাল, পাইনের বনে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, হাওয়ায় উড়ে যায় সেই নীলরঙা ছাতা, জোয়ী’স পাব থেকে ভেসে আসে পূরণ গংবা-র হারানো গিটার। দুনিয়ার টুরিস্ট এসে জড়ো হয় ম্যালে – শখের ঘোড়া চাপা, আইসক্রিম, কেনাকাটা…দার্জিলিং মানে এক হারিয়ে যাবার মরসুম, বেশি লোক সে কথা জানেনা… সময়ের টয় ট্রেনে জানলায় বসে থাকে অর্কিড ; এক দিন অর্কিডে বিশ্বাস হারিয়ে, পাহাড়ে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গিয়েছিল কলেজের ব্যাচমেট রোশন রাই, দার্জিলিংয়ের ছেলে…. গ্লেনারিজের সামনে চেনা মুখ, তুমি ‘প্রতিধ্বনি’-র মানে জান ? নিশ্চুপ জোনাকির মত জ্বলে ওঠে সন্ধের শৈলশহর …
দিল্লির “ইন্দিরা গান্ধী অন্তরাষ্ট্রীয় হাওয়াই আড্ডে” থেকে “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন ” – রঙের এক সকালে যাত্রা শুরু করে এক ভ্যাকেশন-প্রবণ হিউন্ডাই ক্রেটা ; মিরাট, মুজফ্ফরনগর, রুরকির ব্যস্ত রুক্ষতা পেরিয়ে যেতেই রাস্তা হাল্কা পাহাড়ি, পথে মেঘরোদের ক্ল্যারিওনেট, দু’ধারে ঘন সবুজ গাছের সারি হাওয়া সরিয়ে সরিয়ে গান গেয়ে ওঠে, গাড়িতে রাহাত ফতে আলি খান, এ সময় গলায় জড়িয়ে নিতে হয় দুঃখবিলাসিতার এক মৃদু মাফলার। এই পথ দেরাদুন যাবে, এই ক্রেটা কোথা থেকে শুরু করে কোথায় যাবে জানেনা, হয়ত বা দেরাদুন ছাড়িয়ে চলে যাবে নদী-পাহাড়ের ঋষিকেশে, অথবা পৌঁছে যাবে মুসৌরির কাঠের বাংলোয়। পথের “শেরাওয়ালী” ধাবায় থামা হলে, ধোঁয়াওঠা আলুর পরোটায় গোধূলিরঙের আচার ছড়িয়ে পড়ে, দূর থেকে ভেসে আসে আধচেনা মুখ। ড্রাইভার অমৃত সিং হুডা বলে ওঠে – “তাড়াতাড়ি করুন স্যার, রাত্রি হবার আগে দেরাদুন পৌঁছতে হবে …” ; আমি ভাবি, এই সব জাতিস্মর জুন মাস আমাদের এলোমেলো করে দিতে আসে, সামনের টেবিলে দেখি উত্তর ভারতীয় তরুণী – আগুনের মত উজ্জ্বল, চোখাচোখি হলে বুঝি, অবিকল তুমি। সমস্ত দুন ভ্যালি জুড়ে সন্ধে নেমে আসে, দূরে দূরে জ্বলে ওঠে জোনাকি-জীবনের আলো, হাওয়ার মধ্যে ওলোট-পালট হয় কথা, কথা ভাঙতে ভাঙতে ধুলোকণা, এক-একটা ধুলোবিন্দুর জন্যে এক-একটা সফর কেটে যায় …
মহারাষ্ট্রের এই জঙ্গলে লতা-গুল্ম-মায়ায় জড়িয়ে আছে এক অনন্ত ভ্রমণের ডায়েরি। মাথানি চেক-পোস্ট পেরিয়ে ছুটে চলে আমাদের হুডখোলা জিপসি, পেছনে পড়ে থাকে শহরের ডিজিটাল স্বাক্ষর। মাইলের পর মাইল সারি সারি নাম-না জানা গাছ, মাঝখানে বয়ে গেছে উঁচু-নিচু পাথুরে রাস্তা, তপ্ত বিকেলের জঙ্গল-সাফারি সানগ্লাস-টুপির আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখে চারপাশে, রাস্তা পেরিয়ে ত্রস্ত ছুটে যায় হরিণের দল, ধুলো ওড়ে, টিলাপাহাড়ের মাথা থেকে নড়ে ওঠে সোনালি ঈগলের ছায়া। জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী বনদেবী টিপাই-মাতার মন্দির, বিশেষ পরবের দিন ছাড়া কারওর প্রবেশ-অধিকার নেই। ‘টুরিস্ট-জোন’-এর প্রচলিত রুট পেরিয়ে, পারমিশনের তোয়াক্কা না করে, এঁকেবেঁকে ছুটে চলে আমাদের জিপ, এখানে রাস্তা আরও দুর্গম, এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি করছে উদ্বিগ্ন হনুমান-ক্লাব, গাছের ফাঁক থেকে ভেসে আছে বন্য শুয়োরের ভয়ার্ত চোখ, পাখি ডাকছে সমানে, ড্রাইভার গুরমিত সিং গম্ভীর গলায় বলে ওঠে – “স্যার, কলিং হচ্ছে, সে আছে আশেপাশে ….” ; আরও এগিয়ে চলে গাড়ি, একটা খোলা প্রান্তর পেরিয়ে আচমকা সামনে আসে এক খাড়াই রাস্তা, সেই খাড়াই পেরিয়ে এক পাথরে ঢাকা নিচু পথ, কাঁটাঝোপ ঝুঁকে পড়েছে গাড়ির মাথায়, হঠাৎ গাইড বলে – ” ওই দেখুন, স্যার, বুনো শুয়োর মেরে কিছুটা খেয়ে রেখে চলে গেছে …”….নিকন ডি ৭২০০-র লম্বা লেন্সে চোখ রেখে শিলাদিত্যদা বলে ওঠে – ” গায়ের গন্ধ পাচ্ছি …”, কিছু দূরে বন্য জলাশয়, সে কি আসবে ? গুরমিত বলে – “এটা নন-টুরিস্ট জোন স্যার, এখানে বেশি ক্ষণ থাকা যাবে না, কেউ দেখলে আমার লাইসেন্স ক্যানসেল হয়ে যাবে …” হঠাৎ জলের ধারে ঘনিয়ে আসে ডোরাকাটা ছায়া, মুখ তুলে দ্যাখে আমাদের, হার্ট-বিট স্তব্ধ হয়ে যায়, বারো-পনেরো ফুট দূরে আদিম সম্রাট, অনিশ্চিত টাইগার-ট্রেইলের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু-রঙের দেবদূত, ম্যাজেস্টিক মৌনমুখরতা। জল খেয়ে, ধীরে ধীরে, অলস মিলিয়ে যায় অরণ্যের ঐন্দ্রজালিক, বনজ পথে। জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে আমরা ফিরে যাই, তড়িঘড়ি ঢুকে পড়ি টুরিস্ট-জোনে, লম্বা, হলুদ ঘাসের আড়াল থেকে তার চোখ জ্বলে থাকে আজন্মকাল, তাকে কেন বিপন্ন, দুঃখী মনে হয় …মনে পড়ে, কবিতার বইয়ের নাম রেখেছিলাম “দুঃখী বাঘের থাবা আঁকা “, শার্দুল-দর্শনে চোখে জল এসে যায়, ফেরার পথে দেখি একটু দূর থেকে আমাদের দিকে অবাক তাকিয়ে আছে ভীত নীলগাই …
এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।