দিনকয়েক আগের কথা। বিশ্বকাপের ভরা মরশুমে একটি অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়লেন পর্তুগিজ ফুটবল তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ঘানার বিপক্ষে পেনাল্টিতে গোল করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এই বিশ্বের প্রথম পুরুষ ফুটবলার হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল করার অনন্য নজির গড়লেন। আন্তর্জাতিক বহু মিডিয়াই এই জমকালো হেডলাইনে একটি ছোট্ট শব্দ বাদ দিয়ে দিল অবলীলায়। শব্দটি হল, ‘পুরুষ’- হ্যাঁ; রোনাল্ডো প্রথম পুরুষ ফুটবলার হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করলেন। আর্বানিটির আরোপিত শর্তে গড় জনতা হয়ত ভুলেই গেল, রোনাল্ডোর আগে আরও দু’জন ফুটবলারের এই অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে। তাঁদের একজনের নাম মার্তা; মার্তা ভিয়েরা দ্যা সিলভা। মার্তাকে চেনে না এমন ফুটবলপ্রেমী বিরল, কিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক রেকর্ডের ক্ষেত্রে ফুটবলের মতো খেলাতেও আমরা ফসকে যাই মার্তা- র্যাপিনোদের নাম। এদেশের জলহাওয়ায় যে এই বিস্মৃতি দস্তুর, তা পরিস্কার হয়ে যায় একটি ছোট্ট উদাহরণে। শান্তি মল্লিক। নামটা শুনে একঝলকে মনে করতে পারবেন কেউ? হয়ত পারবেন না। একশো বছরের ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস বললে আমাদের মনে কী আসে? মাইলফলক ধরলে চারের দশকে শৈলেন মান্নার লণ্ডন অলিম্পিক, পাঁচের দশকের হেলসিঙ্কি-মেলবোর্ন অলিম্পিক, পিকে-চুনী-বলরামের ষাটের রোম অলিম্পিক, বাষট্টির এশিয়াড জয় আর তারপর সাত, আট ও নয়ের দশকের উত্তাল বাংলা ফুটবল ময়দান, ক্রমশ এশিয় ফুটবলের মানচিত্র থেকে ভারতের দূরে সরে আসা। কিন্তু, এই ইতিহাসের একটি সমান্তরাল ইতিহাস আছে, বা বলা ভাল সমান্তরাল করে রাখা এক ইতিহাসকে আমরাই মূলস্রোতে বা চর্চিত স্রোতে আসতে দিইনি। মার্তা ব্রাজিলে যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, যে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেকে ‘পেলে দি সিয়্যাস’ বা ‘স্কার্ট পরা পেলে’
হিসেবে তুলে এনেছেন সেই উচ্চতায় কোনও ভারতীয় মহিলা ফুটবলার খেলেছেন এমন দাবি হয়তো করা যায় না। কিন্তু সাত-আটের দশকের সমাজে ভারতের মহিলা ফুটবলের ধূমকেতুর মতো উত্থানপর্বটিকে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজন শান্তি মল্লিক-ওইনেম বেমবেম দেবীর মতো তারকাদের কথা বারে বারে মনে করা, যেমনটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্তা বা আলেক্সিয়া পুতিয়াসের ক্ষেত্রে ঘটে, পুরুষতন্ত্রের নির্মাণকে ভেঙে।

মার্তার ফুটবলার হিসেবে উঠে আসার ইতিহাসও রোমাঞ্চকর। ব্রাজিলের পথে পথে ফুটবলের ঘ্রাণ, সেই অলিগলি ফুটবলের দেশে প্রায় সমস্ত মহাতারকারই উত্থান হয় গলি ফুটবল থেকে, দারিদ্রের মোকাবিলা করেই উঠে আসেন তাঁরা। মার্তার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্রাজিলে খেলার সময়ই বিখ্যাত মহিলা ফুটবল কোচ হেলেনা পাচেকোর নজরে পড়ে যান মার্তা। মূলত তার তত্ত্বাবধানে ফুটবলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভাস্কো দা গামা মহিলা ক্লাবের সঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য রিও ডি জেনেইরোতে চলে আসেন মার্তা। রিও-র বিখ্যাত ক্লাব ভাস্কো দা গামায় খেলার সময় থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন তারকা। স্কিল দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতে সিদ্ধহস্ত তিনি। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে পা দিতে তাই বেশি সময় লাগল না। বছর দুয়েকের মধ্যেই মার্তা সই করলেন সুইডেনের উমেয়া আইকে ক্লাবে এবং বছর পাঁচেকের মধ্যে ১০৩ ম্যাচে ১১১ টি গোল করে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা ফুটবলারের খেতাব পেলেন। মার্তা যে সময়ে এই রেকর্ড গড়ছেন সেই একই সময়ে উত্থান হচ্ছে বিশ্বফুটবলের দুই মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ও লিওনেল মেসির। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তার পাহাড় ডিঙিয়ে মার্তার হয়ে কথা বলেন তাঁর রেকর্ড, অবশ্য ইউরোপের মিডিয়ার একাংশ বরাবরই মহিলা ফুটবলের হয়ে জোরদার প্রচার চালিয়েছে নয়ের দশক থেকেই। এরপর জাতীয় দলের হয়ে মার্তাকে দেখা গেল এক অন্য রূপে, পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল, পেলেকে ডিঙিয়ে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার হওয়া, এক বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোলের রেকর্ড সহ অগণিত রেকর্ড ভেঙে মার্তা হয়ে উঠলেন সর্বকালের সেরা মহিলা ফুটবলার। কিন্তু মার্তার এই রাজকীয় রেকর্ডবুকের বাইরেও মার্তার ফুটবল দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটি সম্ভবত সামগ্রিকভাবে মহিলা ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়া। মূলস্রোতের মিডিয়া থেকে গড়জনতা অবধি সকলে মহিলা ফুটবলের ওপর মার্তার বদান্যতায় এক বিরাট আলো ফেলল।
আরও পড়ুন: বৈষম্যের খেলায় আর কতদিন?
১৯৭৫ সালে এদেশে মহিলা ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা উইমেন্স ফুটবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া বা ডব্লু এফ এফ আই-এর হাত ধরে প্রথম প্রশাসনিক আওতায় স্থায়ীভাবে জাতীয় দল ও আভ্যন্তরীণ মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টগুলি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যদিও সাতের দশকের একদম শুরু থেকেই এ দেশে মহিলা ফুটবল ডানা মেলতে শুরু করেছে। এই সময়ে বাংলার প্রাক্তন ফুটবলার সুশীল ভট্টাচার্যের উদ্যোগ, এবং তাঁর অবিস্মরণীয় লড়াই আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন। ১৯৭০-৭১ সাল থেকেই সুশীল একটি শক্তিশালী মহিলা ফুটবল দল গড়ার জন্য বাংলার ময়দান থেকে তুলে আনেন বহু প্রতিভা। সুশীল ভট্টাচার্যের নাম আজ অনেকাংশে বিস্মৃত অথচ কী অসম লড়াইটাই না লড়েছিলেন তিনি ঐ সাতের দশকে। ১৯৭৫ সালে বোর্ড গঠনের পর প্রথম যে ভারতের মহিলা দলটি তৈরি হল, তার দায়িত্বে থাকলেন সুশীল। সেই সময়ে ভারতের মহিলা দলের রাজ্যভিত্তিক খেলোয়াড় সংখ্যা দেখলে অবাক হতে হয় কারণ সিংহভাগ খেলোয়াড়ই ছিলেন বাঙালি। এর পিছনে বাংলার ফুটবলের সম্বৃদ্ধ ইতিহাসটি অস্বীকার করার জায়গা নেই। সেদিনের বাংলা পত্রপত্রিকায় ইস্ট-মোহন-মহামেডানের ম্যাচের পাশে কতটুকু জায়গা পেয়েছিল এইসব বাঙালি মেয়েরা? এই ভারতীয় মহিলা দলটি পাঁচ বছরের মধ্যেই যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছয় তার প্রমাণ আটের দশকের শুরুতেই ১৯৮০ সালে হওয়া এশিয়ান কাপ ফুটবল, যেখানে কালিকুটে ফাইনাল খেলেছিল এই দলটি, যার অধিনায়ক ছিলেন শান্তি মল্লিক। এর কয়েক বছরের মধ্যেই এশিয়ান অলস্টার-এ জায়গা করে নেবেন শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদারেরা। সেই বাংলা ময়দানের উত্তাল সাতের দশকে আদৌ কি লাইমলাইটের সিকিভাগও পেয়েছিল এই বিরাট কৃতিত্বটি?

যদিও এই ভারতীয় মহিলা ফুটবুলের জন্ম ও প্রারম্ভিক ধূমকেতুসম উত্থানপর্বটি রোমাঞ্চকর হলেও ডব্লু এফ এফ আই-এর অভ্যন্তরেই নিহিত ছিল এক গভীর সমস্যার বীজ। এই নিয়ামক সংস্থা ফিফা কিংবা এ এফ সি-র অনুমোদিত সংস্থা ছিল না; এশিয়ান লেডিস ফুটবল কনফেডারেশন নামক একটি সংস্থার অনুমোদনে কাজ করত ভারতের মহিলা ফুটবলের তৎকালীন সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা। এর ফলে এই সোনালি সময়ের বহু বহু ম্যাচ থেকে গেল আনঅফিশয়াল ম্যাচ হিসেবে, ফিফা কিংবা এ এফ সি-র রেকর্ডবুকে পাকাপাকি স্থান পেল না ভারতের মহিলা ফুটবলের শ্রেষ্ঠ দলের বহু ম্যাচ।
যেকোনও খেলার বিকাশের প্রারম্ভিক উপাদানের মধ্যে থাকে ইতিহাস সংরক্ষণ, ভারতের মহিলা ফুটবলের ক্ষেত্রে যে জায়গাটি গোড়া থেকেই ছিল নড়বড়ে। আটের দশকের শুরুতে ১৯৮৩ সালে এশিয়ান উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স হল দলটি। এরপরই যেন ক্রমে ক্রমে এশীয় ফুটবলের মানচিত্র থেকে দূরে সরতে থাকল ভারত। এর একটি কারণ যদি হয় ইতিহাস সংরক্ষণের ব্যর্থতার কারণে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা সাবলীলভাবে সঞ্চার হতে না পারা, অন্য কারণটি অবশ্যই আর্থিক বিনিয়োগের অভাব। উইমেন্স ফেডারেশনের তরফে জাতীয় কিংবা এশীয় স্তরের টুর্নামেন্টের আগে প্রস্তুতি শিবিরের ব্যবস্থা করতে না পারা, প্লেয়ারদের পুষ্টিকর খাদ্য- আধুনিক ট্রেনিং সরঞ্জামের অভাব ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছিল দেশের মহিলা ফুটবলকে। পরবর্তীকালে আর্থিকভাবে কার্যত দেউলিয়া হয়ে গিয়ে বছর পনেরোর মধ্যেই ভেঙে পড়বে ডব্লু এফ এফ আই, মিশে যাবে এ আই এফ এফ-এর সঙ্গে।
১৯৭৫ সালে এদেশে মহিলা ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা উইমেন্স ফুটবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া বা ডব্লু এফ এফ আই-এর হাত ধরে প্রথম প্রশাসনিক আওতায় স্থায়ীভাবে জাতীয় দল ও আভ্যন্তরীণ মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টগুলি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যদিও সাতের দশকের একদম শুরু থেকেই এ দেশে মহিলা ফুটবল ডানা মেলতে শুরু করেছে। এই সময়ে বাংলার প্রাক্তন ফুটবলার সুশীল ভট্টাচার্যের উদ্যোগ, এবং তাঁর অবিস্মরণীয় লড়াই আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন। ১৯৭০-৭১ সাল থেকেই সুশীল একটি শক্তিশালী মহিলা ফুটবল দল গড়ার জন্য বাংলার ময়দান থেকে তুলে আনেন বহু প্রতিভা। সুশীল ভট্টাচার্যের নাম আজ অনেকাংশে বিস্মৃত অথচ কী অসম লড়াইটাই না লড়েছিলেন তিনি ঐ সাতের দশকে।
ভারতীয় মহিলা ফুটবলের ইতিহাস খুঁড়লে শান্তি মল্লিকের মতোই উঠে আসে ওইনাম বেমবেম দেবীর নাম। এ দেশের মহিলা ফুটবলের দুর্গা বেমবেম দেবীর অধিনায়কত্বে ২০১০, ২০১২ ও ২০১৪ সালে সাফ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল। মাত্র পনেরো বছর বয়সে নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে অভিষেক হয় বেমবেম দেবীর, তারপর একুশ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে তিনি যে শুধু গোল করেছেন, ম্যাচ জিতিয়েছেন তা-ই নয়, কার্যত স্থবির হতে থাকা নয়ের দশকের ভারতীয় মহিলা ফুটবলের ভার কাঁধে করে বয়েছেন দু’দশকেরও বেশি সময়। অথচ ঠিক ছ’মাস আগে ভারতের জাতীয় দলে খেলা ফুটবলারের তালিকা সুপ্রিম কোর্ট চেয়ে পাঠালে, ফেডারেশন যে তালিকা পাঠায় তাতে আশ্চর্যজনকভাবে বাদ পড়ে যায় ওইনাম বেমবেম দেবীর নাম!
মার্তার ফুটবল কেবলই গোল-অ্যাসিস্ট কিংবা চোখ ধাঁধানো স্কিলের ফুটবল নয়। মার্তার ফুটবলের গায়ে লেপটে থাকে ফুটবলের মতো খেলায় পুরুষতন্ত্রের চেনা নির্মাণকে ভেঙে মহিলা ফুটবলের মূলস্রোতে জায়গা করে নেওয়ার গল্প। হ্যাঁ, ক্রিশ্চিয়ানোর পাঁচ বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ডের মতো উজ্জ্বল ভাবে না দেখানো হলেও মার্তা বাধ্য করেছেন আমাদের, প্রথম ‘পুরুষ ফুটবলার’ শব্দবন্ধটি উল্লেখ করতে। ভারতের মহিলা ফুটবলের সামগ্রিক উত্থানেও রয়েছে মার্তার মতো অদম্য লড়াইয়ের গল্প। সেই লড়াইকে স্বীকৃতির দেওয়ার দায় কিন্তু আমাদের সকলের। শান্তি মল্লিক- কুন্তলা ঘোষ দস্তিদারদের কথা সুনীল-বাইচুংদের ভিড় ঠেলে তুলে আনলে মার্তা পরবর্তী ব্রাজিলীয় মহিলা ফুটবলে যে জোয়ার এসেছে, তার ঢেউ-এর কিছুটা এদেশেও লাগবে, ধুঁকতে থাকা দেশের মহিলা ফুটবলকে জোগাবে অক্সিজেন…
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
লেখক অর্পণ গুপ্তের বাড়ি হাওড়ায়। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। শখ লেখা, বই পড়া, খেলা ও সিনেমা দেখা। একাধিক প্রথম সারির বাংলা দৈনিক ও ওয়েব পোর্টালে নিয়মিত লেখালেখি করেন।