দীর্ঘ তিন দশকের সম্পর্কে হঠাৎ বিচ্ছেদ ঘটল কোজাগরীর সন্ধ্যাবেলায়, নাহ, কোনও মনোমালিন্য বা মতবিরোধ নয়, কালের অমোঘ নিয়মে অন্য এক জগতের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন বর্ষিয়ান সংগ্রাহক এবং গবেষক পরিমল রায়(Collector Parimal Roy)। সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন ছবিতে দেখা দুর্লভ সব সামগ্রী ব্যবহার করা হত পরিমল রায়ের হীরক ভাণ্ডার থেকে। কী ছিল না সেই ভাণ্ডারে! ছায়াছবির পোস্টার, বুকলেট, লবিকার্ড, দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা, গ্রামোফোন রেকর্ড, পাল যুগের মূর্তি, সিগারেট কার্ড, বিখ্যাত ব্যক্তিদের হাতে লেখা চিঠি, অটোগ্রাফ, আতরদানি, দুষ্প্রাপ্য সব গ্রন্থের প্রথম সংষ্করণ, এনামেল বোর্ড, অতীতকালের বিজ্ঞাপন, ধূমপানের জন্য ব্যবহৃত পাইপ, দেশলাইয়ের লেবেল, সুচের কাজ, চিত্রকলা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তালিকার বোধহয় কোনও শেষ নেই।

কালের অমোঘ নিয়মে অন্য এক জগতের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন বর্ষিয়ান সংগ্রাহক এবং গবেষক পরিমল রায়।
সংগ্রাহকরা আগেও ছিলেন, এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন কিন্তু পরিমল রায় হয়ে ওঠা বোধহয় সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় আর কেন ব্যতিক্রম, সেটা না বললে এই স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যাঁরাই তাঁর সান্ন্যিধ্যে এসেছেন, তাঁরা সবাই পরিমলদার উদার মনের পরিচয় পেয়েছেন। কলকাতা শহরের সমস্ত সংগ্রাহকদের অভিভাবক ছিলেন পরিমলদা। প্রথম পরিচয়েই তিনি নিজের মূল্যবান সংগ্রহ থেকে প্রত্যেককে কিছু না কিছু উপহার দিয়ে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ওঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে কোথায় এবং কীভাবে সময় কেটে যেত, ভাবলে অবাক লাগে! বলেছিলেন শৈশবে রাস্তায় সিনেমার পোস্টার লাগানোর কাজ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম তাঁকে সাহেব বিবি গোলাম ছবির পোস্টার আকৃষ্ট করেছিল। একদিন কয়েকটি পোস্টার হাতে নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন এবং বাবার কাছে ধরাও পড়ে গিয়েছিলেন। পরে অভিভাবকদের নির্দেশে সেই সব পোস্টার রাস্তায় ফেলেও দিয়ে আসতে হয় কিন্তু সেইদিন থেকে সংগ্রহের নেশা পেয়ে বসে আর আজীবন সেই নেশাকে সযত্নে লালন করে এসেছেন।

বিভিন্ন বস্তু সংগ্রহের পাশাপাশি সেই সব নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে পড়াশোনা করতেন। একটা সময় মুদ্রা সংগ্রহর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। একটা সময়ের পর তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয় অন্যান্য জিনিসের প্রতি। যাতে হাত দিতেন, তারই শেষ দেখে ছাড়তেন। নতুন নতুন উদ্ভাবনের দিকেও নজর ছিল। সংগৃহীত জিনিস নিয়ে যেমন প্রদর্শনী করেছেন, তেমনই বেশ কয়েকটি তথ্যপূর্ণ এবং মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্র এবং কলকাতার অন্যতম সংগ্রাহক সদ্যপ্রয়াত কাজী অনির্বাণের সহযোগিতায়।

বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বেঙ্গলি ফিলম ডায়রেক্টারি, রাজশেখর বসুর গড্ডলিকা, গীতা ইত্যাদি। গড্ডলিকা প্রকাশ করতে গিয়ে দিনের পর দিন ভবানীপুরের বকুলবাগানে রাজশেখর বসুর বাড়ির একতলায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা একটি ঘর খুলিয়ে ধুলো ঘেঁটে উদ্ধার করেছিলেন দুষ্প্রাপ্য সব পাণ্ডুলিপি এবং চিঠিপত্র। এই করতে গিয়ে পরিমলদার স্নান-খাওয়ার ঠিক থাকত না। এমনকি নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন নার্সিংহোমেও থাকতে হয়েছিল। কিন্তু দমে যাননি।

আরও পড়ুন: শতবর্ষের আলোকে সুচিত্রা মিত্র
নিজের আগ্রহ এবং জেদকে সম্বল করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন কাজটিকে। তাঁর স্ত্রী যখন দীর্ঘ কয়েক বছর অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছিলেন, তখনও একই মনোবল নিয়ে কাজ করে গেছেন। বৌদির মৃত্যুর পরে নিজেকে আরও বেশি ব্যস্ত করে রাখতেন নিজেকে বিভিন্ন কাজে। যেমন ভাবতেন, তেমনই কাজ করতেন। নিখুঁত পরিকল্পনা আস্তে আস্তে রূপ নিত। প্রায় প্রতি বছরই একেকটি নতুন বিষয় নিয়ে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতেন। পরের বছরের পরিকল্পনা সেরে রাখতেন বর্তমান বছরে। পরিমলদা পরিকল্পিত সর্বশেষ ক্যালেন্ডারটি ছিল সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলের শতবর্ষকে মনে রেখে এবং আরেকটি ক্যালেন্ডার করেছিলেন রাজশেখর বসু রচিত একটি বিশেষ চরিত্রকে নিয়ে। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে তাঁর বিশেষ আগ্রহ জেগেছিল সুচিশিল্পের বিষয়ে। আগের যুগের ঠাকুরমা-দিদিমাদের হাতে তৈরি ঘরোয়া কাজ পরিমলদাকে তন্ময় করে রাখত।

পরিমলদা পরিকল্পিত সর্বশেষ ক্যালেন্ডারটি ছিল সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলের শতবর্ষকে মনে রেখে এবং আরেকটি ক্যালেন্ডার করেছিলেন রাজশেখর বসু রচিত একটি বিশেষ চরিত্রকে নিয়ে।
সুচিশিল্পের নানা কাজ একত্র করে দুটি প্রদর্শনীও করেছিলেন অশক্ত শরীর নিয়ে। সেই উপলক্ষে একটি ফোল্ডার তৈরি করার জন্য গত বছরের মাঝখানে আমাকে নিয়ে পরিচিত এক স্থিরচিত্রগ্রাহকের বাড়িতে সপ্তাহে দুদিন করে যেতেন। শেষের দিনগুলোতে তাঁর বৈচিত্রময় সব কাজের সহযোগী ছিলেন পরিমলদার কনিষ্ঠ পুত্র অংশুমান রায়। আজ পরিমলদা অনন্তের পথে কিন্তু তাঁকে শেষবারের জন্য দেখতে গিয়ে শুনলাম যে ইতিমধ্যেই আগামী বছরের ক্যালেন্ডারের কাজ সেরে রেখে গিয়েছেন। খুব কাছ থেকে দীর্ঘ কিছু বছর তাঁকে দেখার সুবাদে একটা মজার ঘটনা দেখতাম, সেটা হল তাঁর কাছে এসে কেউ যদি কোনও বিশেষ জিনিসের গুণগান করতেন, পরিমলদা তখনই সেই জিনিসটি অতিথিকে উপহার দিয়ে দিতেন।

কেউ আপত্তি করলে বলতেন, ‘আমি কি এগুলো নিয়ে স্বর্গে যাব?’ মানুষ একদিন কালের নিয়মে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন কিন্তু বিশেষ কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নেন সবার মনে তাঁর কাজের দ্বারা। পরিমল রায় তাঁর সংগ্রহ নিয়ে যে সব কাজ করে গেলেন আজীবন, সেগুলো আগামীতেও নবীন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে বলেই বিশ্বাস করি। কর্মক্ষেত্রে তিনি জাপানি সংস্থায় কাজ করার পাশাপাশি কী করে এমন সংগ্রাহক হয়ে উঠেছিলেন, তা একমাত্র তিনিই বলতে পারতেন কিন্তু সেই কথা শোনার সুযোগ আর নেই। ভবানীপুরের শ্যামানন্দ রোডের ‘তামাম শোধ’ বাড়ির কর্তা আজ অজানা জগতে গিয়ে কী সংগ্রহ করছেন কে জানে!

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।