যেদিন উনি চলে গেলেন, আমার সুযোগ হয়নি জীবনপুরের পথিককে শেষ দেখার। রাগ হয়েছিল, সঙ্গে অভিমান, কারণ এমন তো কথা ছিল না! কথা ছিল ‘সিনেমা পাড়া দিয়ে’ বইটির তৃতীয় খণ্ড লিখবেন। কথা ছিল ‘গণশক্তি’-র গ্রন্থাগারে বসে আরও অনেকরকম কাজ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করবেন আর কাপের পর কাপ চা খেতে খেতে আমাদের মতো গুটিকয়েকজনকে শোনাবেন অনেক অজানা কাহিনি, ভাগ করে নেবেন ওঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা।
ওঁর শেষের সেদিন আমি ওঁরই লালমাটির দেশে ছিলাম। খবরটা শোনামাত্র সাংবাদিকতার দায় সারতে রওনা হতে হল কলকাতার পথে। বোলপুর থেকে কলকাতা আসার দীর্ঘ পথকে মাঝে মাঝে ঝাপসা করে দেয় তরুণদার সম্পর্কে বিচিত্র সব স্মৃতি। তারই মাঝে মুহূর্তে ফিরে আসতে হয় ঘোর বাস্তবে। দূরাভাষে যোগাযোগ করতে হয় সহকর্মী-বন্ধুর সঙ্গে তরুণদার চলে যাওয়ার খবর—পরের দিন সংবাদপত্রের পাতায় ঠিকমতো পরিবেশন করার বিষয়ে। পথের দু’পাশে সরে যেতে থাকে বীরভূমের লালমাটির প্রান্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রামাঞ্চল। সেই দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছিল ওঁর একেকটি ছবির ফ্রেমকে।

আর পাঁচজন বাঙালির মতো শৈশব থেকেই ওঁর নামের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় ওঁর সৃষ্টির সঙ্গে। তরুণদার ‘আলো’ যখন মুক্তি পেল, তখন ভবানীপুরের বিজলী সিনেমা হলে ছবিটা দেখতে যে কতবার গিয়েছিলাম, মনে পড়ে না। ইভনিং শো-তে ছবি দেখতে গেলে প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা হত। আপাতদৃষ্টিতে বেশ গম্ভীর স্বল্পবাক মানুষ বলে মনে হয়েছিল। এর আরও অনেক বছর পরে সাংবাদিকতার সূত্রেই ওঁর কাছে যাতায়াতের শুরু। সেই আসা-যাওয়া যে কবে ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছিল, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। সেই গম্ভীর মানুষটি আমাকে তাঁর আপনজনেদের তালিকায় যোগ করতে বেশি সময় নেননি। ওঁর ব্যক্তিত্বে এমন কিছু একটা ছিল যা আকর্ষণ করত।
স্মৃতির আকাশ থেকে: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন হেমন্ত দাদু : অরিজিৎ মৈত্র
গণশক্তির লাইব্রেরির চার দেওয়ালের মধ্যে সামনে বসে নানান কথা শুনতে বেশ লাগত, প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনতাম। একেকদিন হয়তো গাড়ির যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে দেরি করে এসেছেন। গাড়ির থেকে নেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বারে বারে বলেছেন, ‘আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।’ এমন কথা ওঁর মতো ব্যক্তির মুখে শুনে আমি অপ্রস্তুত। আরও অপ্রস্তুত লাগত তরুণদার মুখে ‘আপনি’ ডাক শুনে। এই ছিল ওঁর এক দোষ। আট থেকে আশি, সব্বাইকেই আপনি বলে ডাকাটা ছিল অভ্যাস। এমন সুভদ্র মানুষটির পুরো নামটাই এতক্ষণ কোথাও উল্লেখ করিনি।

বাঙালির আর এক আপনজন তরুণ মজুমদার, যিনি বাংলার প্রান্তিক সমাজের দৈনন্দিন সংস্কৃতিকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছিলেন চলচ্চিত্র মাধ্যমে। অন্যদিকে শরৎচন্দ্রের পশ্চিমকে আর সেখানকার প্রবাসী বাঙালিদের হাজির করেছিলেন বড় পর্দায়। আপনজনেদের বেশিরভাগ তাঁকে ডাকতেন ‘তনুদা’ বলে। আমি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে বলি ‘তরুণদা’ আবার কখনও-সখনও ‘দাদা’। সপ্তাহে এক থেকে দু’দিন তরুণদার সঙ্গে দেখা হওয়া আর গল্প করাটা রীতিমতো নিয়মের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই গল্প করাটা আড্ডার রূপ নিল। দক্ষিণ কলকাতার এক কফির দোকানে আমাদের আড্ডা জমে উঠত। বিষয়ের অভাব ছিল না কোনও।
জন্মশতবর্ষে তপন সিংহের সংগীত: এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা : অরিজিৎ মৈত্র
কখনও সিনেমা, কখনও বাংলা সাহিত্য আবার কখনও রবীন্দ্রনাথ। আলোচনা করতেন গ্রন্থ সংরক্ষণের বিষয়ে। আড্ডা দিতে গিয়ে শোনাতেন আমার আর এক আপনজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। সেই অন্তরঙ্গ আড্ডাতেও আপনি! ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নানা কাহিনি শোনাতেন। রাজ্য-রাজনীতি থেকে দিল্লির রাজনীতি নিয়ে কথা হত কিন্তু কখনও কোনও অবস্থাতেই নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ধ্যান-ধারণাকে অন্যের ওপর আরোপ করতেন না। রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে প্রযোজকদের সঙ্গে ছবি করার কথা পাকা হওয়ার পরেও কোনও অজ্ঞাত কারণে পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যেত। হায় রে! অভাগা দেশ, শুধুমাত্র মতাদর্শ ভিন্ন হওয়ার কারণে তরুণ মজুমদারের মতো চিত্রনির্মাতাকে কাজ করতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিক জীবনে মঙ্গলবার ছিল আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তেমনই এক দিনে হঠাৎই দুপুরে এল ফোন। কী করছি? ব্যস্ত কী না? এসব জানার পরে ওঁর রাণীকুঠির রিজেন্ট এস্টেটের বাড়িতে যেতে বললেন। মনে কুণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার বাড়িতে তো সবাইকে যেতে বলেন না?’ উত্তর শুনে আমি অবাক, মনে মনে আনন্দিত। জানালেন, ‘খুব ঘনিষ্ঠ অল্প যে ক’জন আছে, তার মধ্যে আপনি একজন, তাই বাড়িতে ডাকছি।’ এমন উত্তরে আমি ধন্য।

বাড়িতে যাওয়ার পরে মুখোমুখি বসে শুরু হল গল্প। মাঝে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার হাতে তৈরি এক কাপ চা খেতে আপত্তি নেই তো?’ উল্টে আমি প্রশ্ন করি, ‘আমি পাখার তলায় সোফায় বসে থাকব আর আপনি গরমে চা তৈরি করবেন?’ আপত্তি টিকল না। চা করে নিয়ে আসার পরে আবার অবাক হওয়ার পালা। অপেক্ষা করতে বলে পাশের ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে কাচা, পাট করা রুমাল নিয়ে এসে হাতে দিয়ে বললেন, ‘এইটা দিয়ে কাপটা ধরুন, হ্যান্ডেলটা অতিরিক্ত গরম হয়ে গেছে।’ অনেক উঁচুতে উঠেও মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষজন বোধহয় এমনই সুভদ্র হন। সেই দিনগুলোতেও বুঝতে পারিনি যে জীবনপুরের পথিক সংসার সীমান্ত অতিক্রান্ত করে চলে যাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছেন। আজও সেই কফির দোকানের পাশ দিয়ে যখন যাই, দেখতে পাই সেদিনের সে চেয়ার-টেবিলগুলো তেমনই সাজানো রয়েছে একই জায়গায় কিন্তু সেখানে এখন অন্য লোক, অন্য আড্ডা।
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।