ছোটোবেলায় বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আমার জন্মদিন সারা বছরে মাত্র একটিবার এলেও ‘বছর’-এর জন্মদিন আসে দু-বার| পয়লা জানুয়ারি আর পয়লা বৈশাখ| পয়লা জানুয়ারির জন্মদিনটা সাহেবি কেতায় মানতে হয়| সেদিন সকালের জলখাবারে আগের দিন বিকেলে কিনে রাখা প্লাম কেক খাওয়ার নিয়ম| নাহুমের প্লাম কেক যেবার বাবা বা দাদু গিয়ে কিনে আনতেন না, সেইবার বাপুজি কেক ভরসা, যার পেটে কচকচে চালকুমড়োর টুকরো আর কয়েক কুচি শুকনো টকমিষ্টি কিসমিস|
পাড়ার এক বুড়ি ঠাকুমা কিসমিসকে বলতেন ‘কিছুমিছু’| জন্ম-হ্যাংলা আমি ওই কিছুমিছু কিসমিস খুঁজে পাওয়ার আশায় চিনেমাটির পিরিচে রাখা কেকের টুকরোটা আঙুল দিয়ে ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো করে ফেলতাম| তবে পয়লা বৈশাখে বা বাংলা নববর্ষে কেক টেক আসার পাট ছিল না| নির্ভেজাল বাঙালি জন্মদিন| পায়েস নেই; তার বদলে মাংস-ভাত, চাটনি, দই আর মিষ্টি| মাংস মানে পাঁঠার মাংস| তখন অত স্বাস্থ্য-সচেতনতার বাতিক ছিল না লোকজনের| সব বাড়িতেই রোববারের দুপুরে মস্ত এক টুকরো আলু আর দু-তিন টুকরো মাংস দিয়ে বড়ো বড়ো কাঁসার বাটিতে হাতাভর্তি করে ঝোল ঢেলে থালার পাশে পাশে ঠক করে বসিয়ে দেওয়া হত| কপাল ভালো থাকলে সঙ্গে একটুকরো মেটে| তারপর ভাতঘুমের মিঠে আমেজ জোরদার করা হত রেডিওতে বাংলা আধুনিক গানের ‘অনুরোধের আসর’ চালিয়ে|

পয়লা বৈশাখেও ঠিক তেমনটাই হত| সেই তারিখটা সপ্তাহের মাঝখানে হলেও মেন্যুটা রোববারের| তবে সকাল থেকে গড়িমসি করে দুপুর হতেই ফট করে খেতে বসে গেলে হবে না! সকাল সকাল স্নান সেরে আগে গুরুজনদের প্রণাম করতে হবে; তারপর বাকি কাজ বা অকাজ| নতুন জামা হত না| জানতামই না, নতুন জামা পরতে হয় কি না| তবে লুকোনো জায়গা থেকে ম্যাজিক করে বাবা বার করে দিতেন নতুন বই| উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, হেমেন রায়, ধীরেন্দ্রলাল ধর বা সীতা দেবী-শান্তা দেবীর লেখা| সেই নতুন বইয়ের গন্ধের আকর্ষণ মাংসের ঝোলের সুবাসের থেকে একতিলও কম ছিল না; বরং নিক্তির মাপে কিছু বেশিই ছিল|
সন্ধেবেলায় আমরা উজিয়ে যেতাম সেই উত্তর কলকাতায়| মায়ের জ্যাঠামশাইয়ের বেঙ্গল কেমিক্যালসের কোয়ার্টারে| সেখানে তখন মস্ত বড়ো একটা খাল ছিল; নৌকোও| আর ছিল লাল লাল বড়ো বড়ো এক তলা কোয়ার্টার| আমার কল্পনায় বরাবরই ঘোড়ার গাড়ি টানে পক্ষীরাজ; হাড়-জিরজিরে ঘোড়া নয়| ঠিক সেই একই নিয়মে আমার অবোধ কৌতূহলী চোখে খাল প্রথমে বিশাল বড়ো নদী হয়ে যেত, তারপর বদলে যেত সমুদ্রে| বেঙ্গল কেমিক্যালসের বাড়িতে এই পয়লা বৈশাখের সন্ধে ছিল উৎসবের সন্ধে| খালের কালো জলে টিমটিমিয়ে ইতিউতি জ্বলতে দেখা যেত মাছধরা নৌকোর কুপির আলো আর বাড়িতে তখন বিজলিবাতির ঝিলমিল| শুধু খাওয়া দাওয়াই নয়; সঙ্গে থাকত জমাটি গানবাজনার আসর|
পয়লা বৈশাখে বা বাংলা নববর্ষে কেক টেক আসার পাট ছিল না| নির্ভেজাল বাঙালি জন্মদিন| পায়েস নেই; তার বদলে মাংস-ভাত, চাটনি, দই আর মিষ্টি| মাংস মানে পাঁঠার মাংস| তখন অত স্বাস্থ্য-সচেতনতার বাতিক ছিল না লোকজনের| সব বাড়িতেই রোববারের দুপুরে মস্ত এক টুকরো আলু আর দু-তিন টুকরো মাংস দিয়ে বড়ো বড়ো কাঁসার বাটিতে হাতাভর্তি করে ঝোল ঢেলে থালার পাশে পাশে ঠক করে বসিয়ে দেওয়া হত| কপাল ভালো থাকলে সঙ্গে একটুকরো মেটে| তারপর ভাতঘুমের মিঠে আমেজ জোরদার করা হত রেডিওতে বাংলা আধুনিক গানের ‘অনুরোধের আসর’ চালিয়ে|
কোয়ার্টারের সব জানলা-দরজা খুলে দেওয়া হত হাট করে| খালের জলে চাঁদের ছায়াও পড়ত নিশ্চিত| মিঠে মিঠে গন্ধবিধুর বাতাস বইত| একপাশের বারান্দায় বেতের জাফরিকাটা আড়াল| সেই জাফরিতে মুখ চেপে ধরলে কেমন সুন্দর চৌখুপি নকশা তৈরি হত আর বড্ড যেন মন কেমন করা অন্যরকম সুখে আমার চোখ দুটি বুজে আসত| বৈঠকখানায় ততক্ষণে তবলায় চাঁটি, হারমোনিয়ামের রিড জুড়ে সুরের ওঠাপড়া, তানপুরা ধরল কেউ, তেপায়া টেবিলে রাখা ফিনফিনে পোর্সেলিনের পিরিচে উপচে পড়েছে জলের ছিটে দেওয়া জুঁই আর বেলফুল, বড়ো মামুর হাতে ক্যামেরা আর গান| গান আর গান|
এইসবের মাঝেই হাতে হাতে জোগান দেওয়া হত চা-সরবত-মিঠে পান| থাকত টুকিটাকি মুখরোচক খাবার, মিষ্টির থালা| খোঁপায় বা বেণীতে জড়ানো ফুলের মালা| আমি তো যার পেছনেই বসতাম, তার চুলেই সন্তর্পণে আঙুল বুলিয়ে গন্ধ চুরির ফিকির খুঁজতাম| আমার তখন চাইনিজ কাট চুল| তাতে সাদা সিল্কের ফিতের ফুল| বাড়তি ফুলের জায়গাই নেই! সাদা আদ্দির ফ্রকে হালকা প্যাস্টেল রঙের সুতোয় এমব্রয়ডারি করা| লম্বা বারান্দার ওপাশ থেকে ভেসে আসে মিষ্টি পোলাও আর মাংসের গন্ধ| সে ভালো; কিন্তু ফুলের গন্ধ আরও বেশি ভালো!
ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বাড়িতে ফিরি চোদ্দ নম্বর বাসে করে| আমার রোগা কব্জিতে হলহল করে পেঁচিয়ে রাখা রজনীগন্ধার একছড়া মালা, মায়ের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নেওয়া সাদা রুমালে জড়িয়ে রাখি একমুঠো জুঁই|
যখনকার কথা লিখছি, তখনও আমরা ফ্ল্যাটবাড়িতে আসিনি; থাকতাম দক্ষিণ কলকাতার ভাড়াবাড়িতে| উত্তর কলকাতায় নিজেদের তিন কামরার ফ্ল্যাটবাড়িতে এসে বন্ধুবান্ধবের সুবাদে জানতে পারলাম, নববর্ষে নতুন জামাকাপড় হয় আর তার আগে হয় চৈত্র সেল| এর আগে কখনও মা আর ঠাকুমাকে হইচই করে জামাকাপড় কিনতে দেখিনি; একমাত্র দুর্গাপুজোর সময়টুকু ছাড়া| এই প্রথম আমার মা আর ঠাকুমার টনক নড়ল| হয়ত মনে হয়েছিল, পাড়ার সব ছেলেপুলেই নতুন জামা পরবে; তাহলে একজন আর বাদ যায় কেন!
সে-ই আমার প্রথম বাংলা নববর্ষের ফ্রক| তখন আমার বয়স ন-বছর| কুচকুচে কালো ঘটিহাতা ভালো সুতির কাপড়ের ফ্রক; হাত-মেশিন চালিয়ে ঘরে মা সেলাই করেছেন| তাতে গলায় আর ফ্রকের নীচের পুরো ঘের জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট রেশমি সুতোর এমব্রয়ডারি; সাদা-হলুদ-লাল ফুল| সে যে কী অদ্ভুর সুন্দর! দেখলেই মনে হয় কেউ ফুলের সাজি উপুড় করে দিয়েছে! বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি, পরনে ওই ফ্রক, চুলে কালো রেশমি ফিতের ফুল, ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি| সেই পড়ন্ত বিকেলের রং আজও স্পষ্ট মন পড়ে| অত সুন্দর আর মায়াময় সোনালি-গোলাপি আলোমাখা আশ্চর্য নরম গোধূলি আর কখনও দেখিনি!

ফ্ল্যাটবাড়িতে এসে শিখলাম নতুন বছরকে অন্যরকমভাবে বরণ করে নিতে| গান-নাচ-নাটক দিয়ে| ঋতুরঙ্গ| বৈশাখ মাসের ‘দারুণ অগ্নিবাণে’ অস্থির আমাদের গানবাজনার ডালি কী মোলায়েমভাবে একটু একটু করে ওই একটি বিশেষ সন্ধে ফুরোনোর আগেই গড়িয়ে যেত ছয় ঋতুর ঢাল বেয়ে… স্পর্শ করে ফেলত ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখা’টিকে| নিয়মিত এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত মহড়া| উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে; প্রাণ ভ’রে সাজগোজের এই তো সোনার সুযোগ! গালে আর ঠোঁটে নিষিদ্ধ রঞ্জনী, মায়ের রেশমি শাড়ি, রান সেলাই দিয়ে মাপে ছোটো করে নেওয়া ব্লাউজ আর ঝুল ছোটো করে নেওয়া সায়া, আর মাথায় মায়ের বিয়ের লাল টুকটুকে ওড়না…তাতে আবার সোনালি জরির ফুল তোলা! নকল গয়নার বাহার, কপালে চন্দন-কুমকুম| আমাদের সারা বছর জুড়ে অপেক্ষা এই উৎসবমদির, আলো-ঝলমল বাংলা নববর্ষের জন্য|
কলকাতার নববর্ষে সকাল থেকে হালখাতার হাওয়া বইতে দেখেছি দোকানে, বাজারে| বেজায় ভিড় কালীঘাটে, ঠনঠনেতে বা দক্ষিণেশ্বরে| পায়ে পায়ে থেঁতলে যাওয়া ফুল-বেলপাতা, সামান্য পিছল হয়ে রয়েছে মন্দিরের আশপাশ…জলে আর কাদায়| ডালায় সেই একই সিঁদুরমাখা প্রসাদী প্যাঁড়া; শুধু এই দিনটিতে বুঝি একটু অন্যরকম স্বাদ!

একটু বেলা হতে না হতেই সমস্ত দোকানপাট সাজগোজ সারা করে দেখনহাসি| থরে থরে সাজানো মিষ্টির বাক্স, বাংলা দেওয়ালপঞ্জি আর উৎসুক ‘একা কুম্ভ’ মার্কা স্টিলের ক্যাশবাক্স| খদ্দেররা তো ‘লক্ষ্মী’! তাই বাংলা নববর্ষে এত আপ্যায়নের ছড়াছড়ি| বছরের প্রথম দিনে ভালো ব্যাবসা হলে সারা বছর ধরে ‘লক্ষ্মীলাভ’ আটকায় কে!
খুব মাঝেমাঝে যে বছরে পাড়ার অনুষ্ঠান থাকত না, সন্ধেবেলায় হয়ত বেরোতাম| মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত| আমারও ছিল তাই| হয় ভবানীপুরের পাড়া, আর নয়ত হাতিবাগানে| পথেঘাটে গিজগিজে লোক| সাদার ওপরে মিহি সুতোর কাজ করা আদ্দির পাঞ্জাবী আর পাটভাঙা ধুতি বা পায়জামা পরা কাকু আর মেসোরা ঘাড়ে গলায় ট্যালকম পাউডার মেখে কড়কড়ে মাড় দেওয়া নতুন ছাপা বা তাঁতের শাড়ি আর রংমিলান্তি ব্লাউজে সেজে ওঠা কাকি আর মাসিদের বগলদাবা করে হাঁটছেন হাসিহাসি মুখে| আজ একটা অন্যরকম দিন; আজ যে নববর্ষ! দুপুরের মাংসের ঝোল-ভাত হজম হয়ে গেছে অনেকক্ষণ| এখন চাই ফুচকা, তেলেভাজা আর লেমনেড| কোয়ালিটির আইসক্রিমের দাম একটু বেশি; ম্যাগনোলিয়া বা জলি চ্যাপই বা মন্দ কী! পকেটের হাল খানিক ভালো থাকলে চপ-কাটলেট-মোগলাই পরোটা-ক্যারামেল পুডিং খেতে ভবানীপুরের পাড়ায় ‘বনফুল’ বা ‘ক্যামেলিয়া’, শ্যামবাজারে ‘সিলভার ভ্যালি’ বা ‘মালঞ্চ’| কাকি, মাসিদের কপালে ঘামের সঙ্গে লেপটে থাকা চুলের ঘূর্ণি আর ঈষৎ ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুরের টিপ…ঠিক তখনই জাদুমন্ত্রবলে ফুটপাথের মাটি ফুঁড়ে উদয় হত ‘চাই বেলফুল’|

এইসবই আসলে গতজন্মের কথা| বিস্মৃতির অন্ধকার জলের গর্ভে ডুবে থাকে| কখনও সখনও আচমকা ঘাই দিয়ে যায়|
আমার দীর্ঘ প্রবাস-জীবনে এখন পয়লা বৈশাখ ঠিক কেমন? একটু একাচোরা স্বভাবের, লাজুকও| আসে, থাকে, চলে যায়| হইচই করে না| আমার পরবাসের বিজন ঘরে, শূন্য বাতায়ন জুড়ে শুধুই দু-কূলপ্লাবী নির্জনতা| রোদ্দুরে ভেসে যায় দেওয়াল-মেঝে-দরজা-জানলা; তবুও কেমন ফিকে ফিকে অন্ধকারের অনুভব| আলসেমি ঘাড়ে চেপে বসে থাকে সিন্দবাদের বুড়োর মতো আর এদিকে বন্ধ দরজার বাইরে চুপটি করে অপেক্ষা করে পয়লা বৈশাখ| ঠারেঠোরে শুধু মনে করিয়ে দিতে চায়, নতুন বছরের আজ জন্মদিন| আমি কিন্তু চোখ, কান সব বন্ধ করে উটপাখির মতো দৈনন্দিনতার বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকি| আমার কাছে পয়লা বৈশাখ নতুন করে আলো নিয়ে আসে না আর| ফারাক বুঝি না পয়লার সঙ্গে দোসরা, তেসরা বা চৌঠার| রোজই আমার অস্তিত্ব জুড়ে বসত করে নববর্ষের পরের দিনগুলো| সব-ই কেমন যেন একইরকম ঠেকে| আমার এখন রোজের রান্না, রোজের নিয়ম, রোজের জীবন|
দিন ফুরোলে সাবধানী হাতে সদর দরজা খুলি| কেউ অপেক্ষা করে নেই| অভিমানে, অনাদরে আর অবহেলায় ফিরে গেছে পয়লা বৈশাখ| একা একাই| চলে যাওয়া ‘একলা’ বৈশাখের মলিন মোছামোছা অন্ধকারের আলোটুকু সারা শরীরে আর মনে জড়িয়ে নিয়ে প্রতিবারই দিনের শেষে সেই একই কথা ফিসফিস করে উচ্চারণ করি, ‘সাবধানে যেও| আবার এসো|’
ছবি: Bharat Kraft, Wikipedia, Facebook, Wikimedia
ইলেকট্রনিক্সের ছাত্রী ঈশানী রায়চৌধুরী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত। নিজস্ব লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে পছন্দ রম্য গদ্য আর ছোট গল্প | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ফ্রিডা কাহলো, খলিল জিব্রান, আর কে নারায়ণ প্রমুখ লেখকদের কাজ ভাষান্তর করেছেন। 'কৃষ্ণচূড়া আর পুটুস ফুল', 'আবছা অ্য়ালবাম', 'বাবু-টাবুর মা', ওঁর কয়েকটি প্রকাশিত বই।