পুজো তো এবারের মতো শেষ। তবে জগদ্ধাত্রী পুজো (Jagaddhatri Puja) এখনও বাকি। আমার বালিকাবেলায় এই পুজো নিয়ে একটা সুন্দর স্মৃতি আছে।
মেদিনীপুরে আমার মামার বাড়ি। টাউনে দাদামশায়ের তৈরি তিনতলা প্রাসাদ; সঙ্গে বাগান। গোয়ালঘরে ছোটবড় মিলিয়ে চারটে গরু। তারা বাড়ির সামনের বিরাট মাঠে চারণ করত। রাখাল বালক ছিল না। কিন্তু সাঁওতাল মেয়েরা আসত তাদের নিয়ে যেতে। দুধ দুইয়ে দিত। সেই দুধের সুস্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। জ্বাল দেওয়া দুধের ওপর পিঙ্গল রঙের সরের আস্তরণ, আমার চিরকালের পছন্দ। সেই সর দিয়ে মুড়ি মেখে খাওয়া। আহা! আর ওই দুধ যখন তখন গেলাস গেলাস খেয়ে ফেলতে যে কী আনন্দ! আমাদের সেভেন মাস্কেটিয়ার্সের সঙ্গে এ নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। কারণ তারা খুব করুণার চোখে আমায় দেখত এবং এ ব্যাপারে সবাই একমত হয়ে তাদের দুধের ভাগও গোপনে আমার বাটিতে চালান করে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত। আমিও সেই অমৃত নিঃশব্দে পান করে তাদের দুগ্ধপানের চরম কষ্ট থেকে রেহাই দিতাম।

মামাবাড়িতে আমাদের উৎপাতে বেচারা দাদু, মামা সবসময়ই অতিষ্ঠ থাকত। কিন্তু সুপুরি চিবোতে চিবোতে দাদু প্রচুর বকাবকি করলেও আমাদের কোনওরকম হেলদোল ছিল না। সক্কাল সক্কাল উঠে দাদুর কোলে বসে দাদুর প্রাতরাশের নারকোল, মুড়ি-মুড়কি, সর্ষের তেল দিয়ে মাখা চটপট কে গলাধঃকরণ করব সেই কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত। বেচারা দাদু উপায়ান্তর না দেখে দুই হাঁটুতে দু’জন নাতি-নাতনিকে বসিয়ে প্রবল বেগে হাঁটু নাচাতে নাচাতে সবাইকে সামাল দেবার বিফল চেষ্টা করতে করতেই নাড়ু, মুড়ি সব সাফ। এইবার মঞ্চে মা-মাসিদের আবির্ভাব। সবকটার কান ধরে সোজা পড়ার টেবিলে। তার আগে লাইন দিয়ে দুধ খাওয়ার পর্ব।
দিদিমা অনেক আগেই গত হয়েছেন। মা, মাসির বিয়ে তারও আগে হয়ে গেছে। মামা অবশ্য তখন খুবই ছোট। এখন দাদু, দিদা, মামা, মাসি, মা, বাবা, মেসো সব্বাই ওপরে জমিয়ে সংসার করছে। তোমরা ভাল থেকো সবাই। শান্তিতে থেকো।

তা যা বলছিলাম— জগদ্ধাত্রী পুজোর মধুর স্মৃতি। আমাদের মামার বাড়ির পাশেই ছিল মা-মাসি-মামার মাতুলালয়। ভালোদাদু, লালদাদি, লালমাসি, দীপুমামা, মিঠুমামা। উফ্, নামগুলো মনে পড়লেই আনন্দে ফানুস হয়ে উড়ে যাই। আমাদের সেভেন মাস্কেটিয়ার্সের স্বর্গ ছিল ওই উকিল বাড়ি। দাদু—আমাদের ভালোদাদু, মা’র মামা, মেদিনীপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। ভীষণ মজার মানুষ। আমাদের দেখলেই হাউ মাউ খাঁউ বলে হাতের আঙুল দুলিয়ে এগিয়ে এসে খপ করে একজনকে ধরে চেম্বারের একপাশে চেয়ারে বসিয়ে বলতেন, একটা ছড়া বল। অথবা গান কর। কিংবা নাচ দেখা। আমরা মহানন্দে সবাই মিলে আমাদের কনসার্ট শুরু করে দিতাম। কারণ দলের একজনকে ছেড়ে কোনওমতেই আমরা ভেতর বাড়ি যাব না। পেল্লায় বড় সেই চেম্বারে আমাদের ভূতনেত্য ভালোদাদু আর তার ক্লায়েন্টদের কিছুক্ষণ আনন্দ বা বিড়ম্বনা দান করার পর ছুট্টে ভেতরে গিয়ে সোজা লালদাদির ঘরে। বিশাল ঘরে বিরাট সোফায় বসে লালদাদি তখন সংসারের সব ঝক্কি সামলাচ্ছে। হাফডজন কাজের লোকজন চারদিকে শশব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। লালদাদি আমাদের দেখে হাঁকডাক থামিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দিতেই আমরা সবকটা ঝাঁপিয়ে পড়তাম লালদাদির সুগন্ধমাখা কোলে, কাঁখে, কাঁধে।

ইবার থালায় থালায় কতরকম যে খাবার আসত… নানারকম পুজোর প্রসাদী ফল, সঙ্গে লুচি বা কচুরি, তার সঙ্গে আরও কত কী! সবচেয়ে লোভনীয় ছিল বাড়ির গরুর দুধের ছানা কেটে তাই দিয়ে লালদাদির নিজের হাতের তৈরি রাজভোগ।
আমার আর আমার মাসতুতো বোনের আর একটা বিরাট আকর্ষণ ছিল লালদাদির সঙ্গে তাস খেলা। কী নেশা, কী নেশা! নানারকম খেলা। পরের দিকে যখন পাকাপোক্ত তাসুরে হয়ে গেছি, তখন ব্রিজও খেলতাম। লালমাসি, দীপুমামা, মিঠুমামা— এরা ছিল আমাদের ক্যারমের সঙ্গী। টাংকি মারাতে খুব ওস্তাদ ছিলাম আমি।

ওহো, যা বলছিলাম। খালি খেই হারিয়ে ফেলছি।
এই ভালোদাদু, লালদাদির বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো হত খুব ধুমধাম করে। এই পুজো করা খুব কঠিন। কারণ এও একরকম দুর্গাপুজো, কিন্তু একই দিনে ষষ্ঠী থেকে বিসর্জনের পুজো হয়। দুর্গাপুজোর সব আচার মেনেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। দুর্গাপুজোর মতো এখানেও কুমারী পুজো হয়। যেসব মেয়েদের কুমারী করা হয়, তাদের সাধারণত নয় বছরের মধ্যেই বয়স থাকা দরকার। কারণ, ঋতুমতী মেয়েদের এই পুজোয় সামিল করা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। সুতরাং, আমি আর আমার মাসতুতো বোন রীতা একসঙ্গে কুমারী হতাম। কারণ আমরা তিনমাসের ছোট-বড়। একজনকে করলে আর একজন কষ্ট পাবে। তাই লালদাদির নিদান ছিল দু’জনেই একসঙ্গে কুমারী হবে।
খুব আনন্দ! ওই একদিন নতুন লালশাড়ি পরে, মাথায়, হাতে, কবজিতে ফুলের গয়না পরে, পায়ে সোনার জল করা রুপোর নূপুর, মাথায় মুকুট, নাকে টানা নথ, ঠাকুরের মূর্তির পাশে ছোট্ট সিংহাসনে আমরা দুই বোন জ্যান্ত ঠাকুর হয়ে বসে আছি। বাড়ির বড়রা এসে আমাদের প্রণাম করছে। আমরা হাত তুলে সবাইকে আশীর্বাদ করছি। আর একটা বিরাট টান ছিল আমাদের। দু’জনকে প্রণামী হিসেবে একটা করে রুপোর টাকা দেওয়া হত। আমাদের তখন পায় কে!

তবে একটা কষ্ট ছিল। সেটা অবশ্য আমার। আমার বোন রীতার তাই নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না। সেটা হল যতক্ষণ পুজো চলবে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপোস থাকতে হবে। আমি খাই খুবই সামান্য। কিন্তু সময়মতো না খেয়ে থাকতে পারতাম না। এখনও পারি না।
আমার কষ্ট দেখে লালদাদি নিয়ম করে দিল, গৌরী একটা রাজভোগ সকালবেলা খেয়ে নেবে। রীতা উপোস থাকতে পারবে, ও খাবে না। আমাদের ন’বছর বয়স পর্যন্ত এই নিয়মই বলবৎ ছিল।
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, লেখক ,
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব