Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায়-পর্ব ৯

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

নভেম্বর ১০, ২০২৩

Memories with S D Burman
Memories with S D Burman
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আগের পর্ব পড়তে: [] , [], [৩], [], [], [], [], []

শচীনকর্তাকে (S D Burman) প্রথম দর্শনের স্মৃতিটা ভোলার নয়। স্ত্রী মীরা দেবীকে নিয়ে দিব্যি চা সাজিয়ে বসেছিলেন বসার ঘরের বড় সোফায়। আমরা ঢুকতেই পাশের অন্য আরামকেদারা দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন, বসুন। চা বলছি।’

আমি বললাম, ‘চা বলুন। কিন্তু আমি সোফা নয়, আপনার সামনে এই কার্পেটে বসছি।’ বলে বসেও পড়লাম।’
অমনি সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে কর্তা বললেন, ‘তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে মাটিতেই বসছি। গাঁ-গঞ্জের গান করি, মাটিই তো আসল জায়গা।’ বলে বসেও পড়লেন। ওঁর এই কার্পেটে এসে বসা আর নিমেষে আপনি থেকে তুমিতে আসায় বেজায় সুখ হয়েছিল সেদিন। বললাম, ‘সব কথা রেকর্ড করতে চাই, আপত্তি নেই তো?’

কাজের লোক দামি পোর্সিলিনের কাপের চা-টা ট্রে থেকে এনে ওঁর সামনে ধরতে বললেন, ‘ওদেরটাও এইখানে এনে দে।’

S D Burman

সেই অপূর্ব স্বাদের চায়ে ঠোঁট ছোঁয়াতেই ওই অনুভূতিটা শরীর-মনে উঁকি দিয়েছিল। পল্লিগানের এক সেরা শিল্পী এবং বম্বের এক সেরা সুরকারের মধ্যে প্রাচীন আর আধুনিকের কী সুন্দর মেলামেশা! এই আপনি থেকে তুমি, এই আরামকেদারা থেকে কার্পেট আর তারপর কথা রেকর্ড করব শুনে জমাটি উস্কানি, ‘হ্যাঁ, করো করো। রেকর্ড করে করেই তো বেঁচে আছি। নিজের গান, অন্যের গান। রেকর্ড না হলে আর কী থাকে?’

বলতেই হল আমাকে, ‘তবে পল্লিগান যা শিখেছেন, তুলেছেন, গেয়েছেন সে তো রেকর্ড থেকে আসেনি।’

কর্তা (S D Burman) চোখ বড় করে প্রশ্ন করলেন, ‘সে কী কথা! সব চেয়ে বড় রেকর্ড মেশিন তো মন। মনের মধ্যেই তো জমা কতকালের গান। মন গায়, মন রেকর্ড করে, আর এই যে তুমি আমার কথা রেকর্ড করছ তাই দিয়ে পরে আমায় প্যাঁচেও ফেলবে।’

জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, ‘প্যাঁচে ফেলব কী করে?’

কর্তা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি রিপোর্টার, তুমি তো আরও ভালো জানবে কী করে এর কথা তাকে লাগিয়ে, তার কথা আরেককে, সব সিনেমার কাগজ চলে। সিনেমার লাইন তো এই নিয়েই আছে। ওসব বাদ দাও। তবে ভালো কথারও রেকর্ড থাকা দরকার। ভালো কথা মানে গানের কথা। গান তো কথা, শুধু সুরে বলা। সুরে বলা মানে মনের সুরে বলা। তেরে মেরে সপনে অভি এক হি রঙ্গ হ্যায়।’

Sachin Deb

শেষের দিকে গানের কলিটা গলা নামিয়ে গুনগুন করে গাইলেন। আমি বললাম, ‘গানটা একটু জোরে হলে হত না?’

কর্তা হাসতে হাসতে ফের ওঁর সাবেকি কেতায় চলে গেলেন। ‘হবে, হবে, খুব হবে। একবার বম্বে চলে এসো, কত শুনবে শোনাব। শুধু গানই হবে। এখন কথায় এসে পড়ো।’

টেপ চালিয়ে দিয়ে বললাম, ‘গানের গল্প দিয়েই শুরু করি?’

কর্তা ভুরু তুলে বললেন, ‘গল্প? কী গল্প?’

বললাম, ‘যে গল্পটা খুব চলে আপনাকে নিয়ে। যে, বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে যাচ্ছেন, কারও টিকিট নেই। চেকার ধরে নামিয়ে দেবার উপক্রম করতে বন্ধুরা শচীনের গানের কথা পাড়ল। চেকারকে একটু শুনে দেখার অনুরোধও করল। সে গান শুরু হতে চেকার তো হতভম্ব! কী অপূর্ব গান আর গাইয়ে। গানও চলে, তিনিও নড়ার নাম করেন না। গান শুনিয়েই আপনি আর বন্ধুরা পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে, বিনা টিকিটে।’

কর্তা ওর বিখ্যাত হাসিটা হাসতে শুরু করলেন, ‘দ্যাখো পল্লিগান তো সবই গল্প। জীবনের সব গল্প থেকেই তো গান ফোটে। জীবনের দুঃখ, কান্না, হাসি, মজা, প্রেম, ভালবাসা। রেলগাড়ির গল্পটাও ওরকমই।’

মীরা দেবী ওঁর সোফায় বসেই হাসিতে যোগ দিলেন। বললেন, ‘এরকম কত গল্পই যে ওঁকে নিয়ে আছে। ওঁদের তো রাজবাড়ি, আমি বলি গানবাড়ি আর গল্পবাড়ি। ওঁর বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ ছিলেন খুব উঁচু দরের সেতারি এবং ধ্রুপদশিল্পী। তিনি আবার একটা আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তার টাইটেল কী জানো?’

জানতাম না, তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী?’

মীরা দেবী হাসতে হাসতে মুখ চাপা দিয়ে বললেন, “‘আবর্জনার ঝুড়ি!’ ভাবো একটা স্মৃতিকথার শিরোনাম!”

S D Burman & Meera Devi
মীরা দেবীর সঙ্গে শচীন কর্তা

ওঁর কথা থেকেই তুলে নিলেন কর্তা, ‘আসলে অনেক ঝড়ঝাপটা তো আমাদের রাজপরিবারের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। বাবা সেই ঝড় সামলেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। ত্রিপুরার সিংহাসন নিয়ে টানাটানি, কিন্তু ধরে রেখেছিলেন সংগীত।’

আমি বললাম, ‘আর সেই সংগীতই বুকে ধরে রাখলেন আপনিও।’

কর্তা হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওস্তাদি গানই তো শিখলাম। কিন্তু সারাক্ষণ ভেতরে ঝড় রইল পল্লিগানের। সব গানের মা’ই তো পল্লিগান। ওই থেকেই তো শুরু।’

আমি বললাম, ‘সে জন্যই কি পল্লিগানে মায়ের কান্না ভর করে?’

কর্তা হাসতে লাগলেন, ”শুধুই কি মায়ের কান্না? কত কান্নাই তো শোনায় পল্লির গান— ‘ও মেরে মাঝি মেরে সাজন হ্যায় উসপার, লে চল পার’।”

বলতে বলতে গানটা একটু গুনগুন করলেন। তারপর বললেন, ‘তাহলে বোঝো, প্রেমিকার কান্না কী জিনিস। ছাড়াছাড়ি তো সারাক্ষণ লেগেই আছে জীবনে। এ ঘর থেকে ও ঘর হওয়া, এ দেশ থেকে ও দেশ। —ওয়াহা কোন হ্যায় তেরা মুসাফির যায়েগা কঁহা।’ বলে খুব নিচু করে সুরটা ভাঁজতে লাগলেন।

আমাকে বলতেই হল, ‘আর এই সব সুর, এই সব ভাবনাই আপনি বম্বের ফিল্ম ওয়ার্ল্ডে বইয়ে দিলেন?’

কর্তা বললেন, ‘চালিয়ে দিলাম মানে? বম্বের ছবির করুণ, চোখের জলের গানের একটা স্টাইল করে দিলাম। এই সব অনেক গানই তো আমায় নিজের গলায় গাইতে হয়েছে।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কত ভালো ভালো মেল বা ফিমেল ভয়েসে তুলেও দিয়েছেন।’

—‘হ্যাঁ, তাই তো। বম্বের সব আর্টিস্টকেই তো গান দিয়েছি। আমার খোঁজ আছে, কার গলার কী কাজ দিয়ে কোন গান উতরোবে। হেমন্তর মতো ভদ্র, সুন্দর, রোমান্টিক গলাতেও তো বসিয়েছি ‘হ্যায় অপনা দিল তো আওয়ারা’। স্পিড, রিদম, মজা মিলিয়ে কী হিট, কী হিট! রফির গভীর গলাতে দিয়েছি ‘তেরে মেরে সপনে অভি এক হি রঙ্গ হ্যায়’। আর যে-ছবিতে এই গান সেই ‘গাইড’-এই কিশোর গাইল ‘গাতা রহে মেরা দিল’। আর ওখান থেকেই যেন এক নতুন কিশোরের জন্ম হল সিনেমায়।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেজন্যই কি বলা হয় আপনার আর কিশোর কুমারের প্রায় বাপ-ছেলের সম্পর্ক?’

আপন মনে, শব্দ না করেই খুব হাসলেন বম্বের ফিল্ম মিউজিকের মস্ত আইকন শচীনদেব বর্মন। বললেন, ‘হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে ছেলেটাকে আমার। ওরও খুব টান আমার প্রতি। তবে আসল রিলেশনটা গানের। ওকে দিয়ে সব রকম গানই তো গাইয়ে নিতে পারি।’

বললাম, ‘সে তা লতার বেলাতেও সত্যি।’

সোফায় বসা মীরা বললেন, ‘সে আর বলতে!’

SD Burman with Lata
লতার সঙ্গে শচীনকর্তা

বললাম, ‘আপনি নাকি বলেন যে আপনাকে লতা আর একটা হার্মোনিয়াম দিলেই গান হয়ে যায়।’

এবার খুব শব্দ করে হাসলেন শচীনকর্তা। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললেন, ‘তাহলে একটা কথা শোনো। এই যে লতা, ওর গলায় আসে না এমন কোনও সুর আছে?’

মাথা নেড়ে বললাম, ‘না।’

কর্তা ফের শুরু করলেন, ‘যে-গানই দাও জাস্ট একবারে তুলে নিচ্ছে, গেয়ে নিচ্ছে। এই লতারই তিন-তিনবার লাগল একবার একটা গান তুলতে।’

জানতে চাইলাম, ‘কোন গান দাদা?’

বললেন, “‘মেঘা ছায়ে আধি রাত, বৈরগ বন গয়ি নিদিয়া…’” তারপর লাইনটা গুনগুন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘শোনা আছে গানটা?’

বললাম, ‘‘খুউব। ‘শর্মিলি’ ছবির গান।’’

কর্তা বললেন, ‘তো এই গানে কয়েকটা শার্প টার্ন নিয়ে চড়ায় যেতে হয়। সেই কাজটা তুলতে ওকে তিনবার গাইতে হল। তবে ছাড়ার পাত্রী নয়। তিনবারের বার একদম পারফেক্ট করে বলল— কী সুন্দর কাজ দাদা! তখন ওকে বললাম, এই সুর, এই কাজ আমার রবীন্দ্রসংগীত থেকে পাওয়া। তখন কপালে হাত ছুঁয়ে লতা বলল, কত যে কী করেছেন রবি ঠাকুরজি!’

সত্যি বলতে কি, সেই রাতে টেপ বাজিয়ে কর্তার ইন্টারভিউ লিখতে লিখতে বারবার নিজেকে বুঝিয়েছি এই মানুষটাকে ছাড়া নেই, বম্বে গিয়ে বেশ ক’দিন পড়ে থাকব ওঁর বাড়িতে। ওঁর গান আর কথা রেকর্ড করব। উনিই তো ওঠার মুখে আমাদের বললেন, ‘চলে আয় বম্বেতে…তোর নামটা কী যেন? হ্যাঁ, শঙ্কর, চলে আয় আমাদের নতুন বাড়ি ‘রকেট’-এ। পঞ্চমই থাকে কখনও কখনও, আমরাও উঠি। চলে আয়, কত গান শুনবি? সব বলব। তোর কাজে লাগবে।’

এক বিকেলে আপনি থেকে তুমি হয়ে তুইয়ে নামলেন কর্তা। ওঁর এই বম্বে আসার ডাকে যেন ‘ওরে মাঝি’ ডাকের মতোই প্রাণ। লেখা বেরবার পর দু’কপি হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ওঁকে লিখেছিলাম সামনের শীতে ওঁর ওখানে যাব। কিন্তু যাই-যাই করে একটা লম্বা দেরি করে ফেললাম। এক শীত পেরিয়ে আরেক শীতে যাওয়ার চিন্তা করলাম। কিন্তু তার আগেই পুজোর মাস অক্টোবরে মা দুর্গা কোলে তুলে নিলেন তাঁর এই দেবদত্ত সন্তানটিকে।

*ছবি সৌজন্য: Facebook

*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ২৮ নভেম্বর, ২০২৩

Author Sankarlal Bhattacharya

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Picture of শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
Picture of শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস