(Merry Chirstmas) আমার কলিগ ও বন্ধু এভালিনা প্রায়ই ওর ছোটবেলার গল্প করে। ক্রিসমাসে ওরা সপরিবারে ঠাকুমার বাড়ি যেত। গাড়ি থেকে নেমে, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, এক দৌড়ে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ত। সারাদিন ধরে ঠাকুমা ওভেনে টার্কি আর পাই বেক করছেন। রান্না ঘরের মৃদু গরম আভায় সে এক অদ্ভুত আরাম। কেক-কুকি আগেই বেকড হয়ে নামে নামে কাচের জারে ভরা হয়ে গেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে ক্রিসমাস ট্রির নীচে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে গিফট খোলা। ঠাকুমা ওদের জন্য গিফট র্যাপ করে রেখেছেন, হাতে হাতে তুলে দিচ্ছেন। ভিতরে কী আছে কেউ জানে না। এর মজাই আলাদা। গল্পটা কি খুব চেনা চেনা লাগছে? দুর্গোপুজোর কথা মনে পড়ছে? আমারও খুব ভাল লাগে বন্ধুদের হাতে উপহার তুলে দিতে। তখন ওদের মুখে যে হাসিটি দেখতে পাই, তার কোনও তুলনা নেই। গিফট পেলে কে না খুশি হয়! (Merry Chirstmas)
আরও পড়ুন: খ্রিস্ট খ্রিস্ট হরে হরে
কানাডায় ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ক্রিসমাসের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ক’দিন আগে আমাদের বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি লাগানো হল। এখন বাড়িতে বাড়িতে আলোর সাজ, পাড়ায় আলোক-সজ্জার প্রতিযোগিতা চলছে। অনেকটা আমাদের দুর্গোৎসবের মতন। সব দেশেই উৎসব মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। ক্রিসমাস এখানে একটা পারিবারিক মিলন উৎসব। ক্রিসমাসে দাদু-ঠাকুমা, ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি, নাতির গার্লফ্রেন্ড, অথবা নাতনির বয়ফ্রেন্ড সবাই একত্র হয়। কেউ ইউনিভার্সিটি আবার কেউ বা কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে ফিরে আসে। স্কুল-ইউনিভার্সিটি-কলেজ সব বন্ধ। অফিসও বেশ কিছুদিন ছুটি থাকে। (Merry Chirstmas)

এখন মলে মারকাট্টা ভিড়, দোকানে নানা রকমের গিফট। সুগন্ধি ক্যান্ডেল, বাহারি সোয়েটার, মুখে-দিলে-গলে-যায়-চকোলেট, ডায়মন্ড-সিল্ভারের হালকা গয়না, ইলেকট্রনিকস গেজেট! রেস্টুরেন্টগুলো পার্টি সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। কানাডার মারাত্মক ঠান্ডা আমরা ক্রিসমাস ঘিরে উদ্যাপন করে নিই। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, প্রার্থনা, বই পড়া, চুটিয়ে শপিং, আর ছুটির আলসেমি– সব মিলিয়ে মিশিয়ে সময়টা বেশ ভালই কাটে। (Merry Chirstmas)
কানাডায় আমাদের ধারে কাছে কোনও আত্মীয় স্বজন নেই। স্বামী-স্ত্রী-ছেলে নিয়ে ছোট্ট নিউক্লিয়াস পরিবার। ক্রিসমাসের ছুটিতে পুত্র ওর কর্মক্ষেত্র থেকে এসে কিছুদিন থেকে যায়। গত বছর থেকে আমাদের পরিবার বেড়েছে। ক্যালগেরি ইউনিভার্সিটিতে দুটি বাঙালি মেয়ে undergradute করতে এসেছে। ১৮-১৯ বছরের এই দুই কন্যা ছুটিতে আমাদের কাছে চলে আসে। বাড়িতে একটা বহু পুরানো ক্রিসমাস ট্রি আছে, ওর সাথেই আমাদের পুত্রের বড় হয়ে ওঠা। প্রতি বছরই জানলার ধার ঘেঁষে এই গাছটিকে দাঁড় করিয়ে লাল, নীল, সোনালি-রূপালি বল রিবন দিয়ে সাজিয়ে ফেলি।

আজকাল ক্রিসমাস ট্রি সব দেশেই জনপ্রিয়। কীভাবে ক্রিসমাস ট্রি এ’রকম সার্বজনীন হয়ে উঠল? একটু ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পাড়লাম যে আদিম যুগে, উত্তর গোলার্ধের মানুষ, শীতে চিরহরিত গাছের ডাল দিয়ে বাড়ি সাজাত। ডিসেম্বরের ঠান্ডায় অন্যান্য গাছের পাতা ঝরে গেলেও, পাইন, ফার, স্প্রুসের গায়ে এক ঝুপ্সি পাতা। ক্রমাগত দিন ছোট হয়ে আসছে। সূর্যের তেজ কম, পৃথিবী আপাদমস্তক শীতের সাদা চাদরে ঢাকা। এই আলোকহীনতাকে মানুষ সূর্যদেবের অসুস্থতা বলে কল্পনা করতেন। তখন শুধুমাত্র চিরহরিত গাছের ডালেই জীবনের ছিটেফোঁটা সবুজ হয়ে বেঁচে। তাই তাঁরা সব অশুভ দূর করতে পাইন গাছের সবুজ ডালপালা দিয়ে ঘর সাজাতেন। এইভবেই পাইন গাছ আমদের ক্রিসমাসের সাথে জুড়ে গিয়েছিল।
আরও অনেক পরে, ১৬শ শতাব্দীতে জার্মানিতে ক্রিসমাস ট্রির বাণিজ্যিকরণ শুরু হয়। মার্টিন লুথার জার্মানির এক প্রাচীন ধর্মসংস্কারক, তাঁর হাত ধরেই প্রোটেস্টান রিফর্ম (Protestant Reformation) হয়েছিল। মার্টিন এক গভীর রাতে প্রার্থনার সুর গুনগুন করে গাইতে গাইতে চার্চ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই রাতে ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। রাস্তা-ঘাট একেবারে জনমানবহীন। মার্টিন গভীর রাতে ঘন পাইন বনের মাথায়, স্বচ্ছ কালো আকাশে হাজার তারার নক্সা দেখতে পেলেন। তিনি খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে “গাছ-তারাদের নিয়ে একটা ঐশ্বরিক দৃশ্য দেখলেন।”

সেই অপার্থীব দৃশ্য থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে পরের দিন জঙ্গল থেকে পাইন গাছ কেটে এনে মোমবাতি দিয়ে সাজালেন। সেই দিনটা ক্রিসমাস ছিল। ঘরে ঘরে পাইন গাছের ডালে-ডালে ক্রিসমাস ম্যাজিক শুরু হল।
“The magical dust of Christmas glitters on the cheeks of humanity ever so briefly,
Reminding us of what is worth of having and what we were intended to be”
~ Max Lucado
ক্রিসমাসের গল্পে স্যান্টাক্লসকে যে আসতেই হবে! তিনি না এলে তো জমবে না। আমি ছেলেবেলায় প্রথম স্যান্টা দাদুকে দেখি কলকাতায় New Market-এর এক দোকানে। লাল জামা, সাদা টুপি-দাড়ি-চুল সদা হাস্যমুখ এই মানুষটি, আমাদের সবার প্রিয়। বিশেষ করে ছোটদের। আমাদের ছেলেবেলায় ক্রিসমাস মানে স্কুল ছুটি, পিকনিক, আর ফ্রুট কেক। প্রত্যেক বছর একই ব্রিটেনিয়ার কেক খাওয়া হলেও, একঘেয়ে লাগত না। কারণ ক্রিসমাস মানেই কেক, সে যেমনই হোক না কেন। আমাদের পুত্র যখন ছোট ছিল, তখন আমরাই স্যান্টা হয়ে ওর জন্য ক্রিসমাস ট্রির নীচে গিফট রেখে দিতাম। স্যান্টা কি একটা কাল্পনিক চরিত্র? না কী আদিকালে এমন কেউ ছিল?
প্রশ্নটা মাথায় ছিল, কিন্তু উত্তরটা কখনও খোঁজা হয়নি। কী জানি কেন?

কিছুদিন আগে টিভিতে একটা documentary দেখছিলাম। সিন্যামাটোগ্রাফি এত সুন্দর যে রান্নাবান্না ফেলে বসে গিয়েছি। তিন ব্রিটিশ ভদ্রলোক স্যান্টাক্লসের খোঁজে ফিনল্যান্ডে(Finland) জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছেন। চারিদিক নিস্তব্ধ, গাছের পাতা ঝরে গেছে। রাস্তার দুপাশে পাহাড় প্রমাণ বরফ জমে আছে। জন মানব নেই, শুধু রেইনডিয়ার চড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা সবাই জানি যে ২৪শে ডিসেম্বরের রাত্তিরে স্যান্টা স্লেজ(Sleigh) গাড়িতে চড়ে উত্তর মেরুর উপর দিয়ে উড়ে যান। ৯টা রেইনডিয়ার সেই গাড়ি টানে। শান্তশিষ্ট বাচ্চারাই গিফট পায়। মায়েরা বাচ্চাদের বলেন “চটপট খেয়ে নাও। দুষ্টুমি করলে স্যান্টা আসবে না।”

Santa Claus is comin’ to town। You better watch out, you better not cry, better not pout।
He’s making a list, checking it twice।
Gonna find out। Who’s naughty and nice.
টিভিতে মন দিলাম। ক’দিন ঘুরে তিন বন্ধু স্যান্টাক্লজের গ্রাম Rovaniemi, Lapland এসে পৌঁছেছেন। গ্রামটি ভারি সুন্দর। স্যান্টার দোকান, বাড়ি, পোস্ট অফিস, খেলনা তৈরির কারখানা সবই আছে। স্যান্টা ক্লজ সব সময় বাড়িতেই থাকেন। তাঁর অবারিত দ্বার, ঢুকে পড়ে দিব্বি আড্ডা মারা যায়। “আপনার বয়েস কত?” এই প্রশ্নটা স্যান্টা এড়িয়ে যান। সারা বছর ধরে পোস্ট অফিসে অজস্র চিঠি আসে। স্যান্টা সোনালি-রুপালি খামে, রং-বেরঙের ডাকটিকিট লাগিয়ে উত্তর দেন। মিসেস ক্লজ নিখুঁত দক্ষতায় কারখানার কাজ সামলান। একবার ছোটদের লেখা চিঠি পাঠিয়ে দেখুন তো কী হয়।
ঠিকানাঃ Santa Claus, Santa Claus’s Main Post Office, 96930, Napapiiri, Finland।

স্যান্টা বরফের দেশে থাকেন। Lapland, arctic circleএর মধ্য দিয়ে গেছে বলে, এখানে টানা পাঁচ মাস শীতকাল থাকে। তখন সূর্যের মুখ দেখা যায় না । ২৪ ঘণ্টাই রাত্তির। আবার গ্রীষ্মে ২৪ ঘণ্টা টানা সূর্য থাকে। কাজেই স্যান্টা এক মজার দেশে থাকেন। এখানে মানুষের চেয়ে রেইনডিয়ারের সংখ্যা বেশি। গেলে নিশ্চয়ই দেখতে পবেন। ১৯৬৪ এর সেই বিখ্যাত সিনেমা Rudolph the Red-Nosed Reindeer-এর গল্প মনে আছে? রুডলফের টুকটুকে লাল উজ্জ্বল নাক। সে সবার থেকে আলাদা দেখতে বলে, বন্ধুরা ওকে খেলতে নিত না।
এক শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্তিরে স্যান্টা রুডলফকে স্লেজ গাড়ি চালাতে ডেকে আনলেন। রুডলফের নাক থেকে টর্চের মতন আলো বেরোল। সেই আলো দেখে রাতের অন্ধকারে স্যান্টার গাড়ি আকাশ-পথে ঝরের বেগে চলল। এই রাত্তিরেই সব বাচ্চাদের গিফট দিতে হবে। রুডলফ নায়ক হয়ে গেল।
Rudolph the Red-Nosed Reindeer had a very shiny nose।
And if you ever saw it – You would even say it glows
All of the other reindeer – Used to laugh and never let poor Rudolph – Join in any reindeer games….

স্যান্টাকে ঘিরে কত যে গল্প আছে! স্যান্টার সাথে আমাদের ছেলেবেলা আর বড়বেলার ক্রিসমাস ম্যাজিকও জড়িয়ে গেছে। আর একটা তথ্য, ৪র্থ খৃষ্টাব্দে টার্কির পাটারা শহরে এই চরিত্রের জন্ম। সেখানকার এক দয়ালু Christian Saint, Nicolas ছোটদের গোপনে গিফট বিতরণ করতেন। এই চরিত্রের অনুপ্রেরণায় স্যান্টার সৃষ্টি। পরে ডাচদের হাত ধরে স্যান্টা-পরম্পরা আমেরিকায় আসে। ইউরোপের বিভিন্ন শহরেও ভিন্ন নামে স্যান্টা কিংবদন্তি ক্রিসমাসের সাথে জুড়ে গেছে। এঁরা একই রকম দেখতে – মোটাসোটা, ভারি হাসিখুশি, শান্তির প্রতীক। ক্রিসমাসে গিফট আর সেই সঙ্গে এক রাশ আনন্দ বয়ে আনেন। স্যান্টা তাহলে কোন দেশের? এই নিয়ে নানা বিতর্ক। আমার মনে হয় ফিনল্যান্ডের ম্যজিকাল ল্যান্ডস্কেপ স্যান্টার একান্ত আপনার দেশ। ওঁর আবেদন বিশ্বব্যাপী, একেবারে সার্বজনীন। ওঁকে ছাড়া ক্রিসমাস পূর্ণ হবে না। স্যান্টা আসলে আমাদের সবার, সব দেশের।

Have a holly jolly Christmas. It’s the best time of the year.
Now I don’t know if there’ll be snow। But have a cup of cheer.
And when you walk down the street, say hello to friends you know.
And everyone you meet. Have a holly jolly Christmas.
আমরা ক্রিসমাসের রাতে পাইনের ডালে আলো জ্বালিয়ে রাখি। বাইরে নীরবে বরফ পড়তে থাকে। জানালায় আইস ক্রিস্টাল লেগে জ্বলজ্বল করে। রাস্তাঘাটে একটাও লোক নেই। রেডিওতে গান ভেসে আসে “It is the most wonderful time of the year.” রাতটা সত্যিই ম্যাজিকাল হয়ে যায়।
ছবি: লেখক
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।