(Mossad)
১৯২৪ সালের শেষ লগ্নে যখন উত্তর মিশরীয় বন্দরনগরী আলেকজান্দ্রিয়াতে জন্মগ্রহন করছেন এলি কোহেন, তখন বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের প্রোমিজড ল্যান্ড অর্জনের আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ১৯১৭ সালের ব্যালফুর ঘোষণাকে সম্বল করে ইউরোপের নিপীড়িত শোষিত ইহুদিরা দলে দলে তাদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে প্যালেস্তাইনে চলে আসছেন। সেখানে চারিপাশে বিরূপ বৈরি আরব পড়শিদের মাঝে শুরু হচ্ছে এইসব সর্বস্ব খুইয়ে আসা মানুষদের টিকে থাকার লড়াই। (Mossad)
আর সে লড়াই লড়তে গিয়ে তাঁরা উপলব্ধি করছেন শুধু রাজনৈতিক আর সামরিকভাবে নয়, এই যুদ্ধ করতে হবে অন্যভাবেও। ফলে ১৯২৫-এর পর প্রায় সিকি দশক ধরে চলে স্বাধীন ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার নানান অবকাঠামো তৈরির কাজ। আর সেই সিকি দশকের উত্তাল ইহুদি জাতীয়তাবাদের ঊর্মিমালায় ভাসতে ভাসতে বড় হন কোহেন।
শুরু হল এলি কোহেন চতুর্থ পর্ব।
আরও পড়ুন: গণহত্যার অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আশার আলো
রাতের সেই বৈঠক
মূহুর্মূহু পাথর বৃষ্টি হচ্ছে। শুধু কি পাথর? ভাঙা বোতল, ময়লা ভর্তি জার, সবই এদিক ওদিক থেকে ধেয়ে আসছে।
১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক শুক্রবার। জেরুজালেমে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজা হেরডের তৈরি দ্বিতীয় মন্দিরের পশ্চিম প্রাচীরের সামনে সবে দূর দূরান্ত থেকে আসা ইহুদিরা প্রার্থনা করতে শুরু করেছেন। তাঁদের প্রার্থনা প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছে। সেই সময়ই শুরু হল এই পাথরবৃষ্টি। (Mossad)
আশপাশের জায়গায় লুকিয়ে রয়েছে দুস্কৃতির দল। পাথর বৃষ্টি হচ্ছে সেখান থেকেই। গুলিও চালাল দুস্কৃতিরা। ভয় পেয়ে ভিড়ের মধ্যে শুরু হল চূড়ান্ত হুড়োহুড়ি। পালাতে গিয়ে আহতও হলেন অনেকে। পুরো ঘটনায় নড়েচড়ে বসলেন প্যালেস্তাইনে ব্রিটিশ ছত্রছায়ায় থাকা ইহুদি বসবাসকারীরা।
আদতে এই শঙ্কা সিকি দশেক পুরোনো। (Mossad)

ঠিক এই ধরণের একটা গণ্ডগোলের শঙ্কা তির তির করে বইছিল তখন থেকেই। ১৯০৩ সালের কিশিনেভ গণহত্যা ও ইহুদি বিরোধী দাঙ্গার পরে ইউরোপ জুড়ে অতি দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে এবং নিত্য ইহুদিদের উপর অত্যাচারে বিপদ যে ঘণিয়ে আসছে তা বুঝতে পেরেছিলেন তৎকালীন ইহুদি নেতৃত্ব। আগামীর কথা ভেবে ইউরোপ যে ছাড়তে হবে, সেই দেওয়াল লিখনও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ ভাগে ১৯১৭ সালে প্যালেস্তাইনকে ইহুদি বাসভূমি করায় ব্রিটেন যখন ব্যালফুর ঘোষণার মাধ্যমে মদত দেওয়ার আশ্বাস দিল, তখন সেই আশ্বাসকেই খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো ধরলেন ইহুদি নেতৃত্ব। বস্তুত এই ব্রিটিশ আশ্বাসকেই পুঁজি করেই, ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার ইহুদি প্যালেস্তাইনে ‘প্রোমিজড ল্যান্ডে’ পাড়ি জমানো শুরু করেছিলেন। (Mossad)
“জায়গায় জায়গায় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইহুদিদের সংঘর্ষ শুরু হল। ইহুদিরা প্রবল বাধার মুখেও তাদের সিনাগগ ও প্রার্থনাস্থল তৈরি করতে লাগল।”
কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল বিপদ এখানেও অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য। তাঁদের ভূখণ্ডে ইহুদিদের আসা ও সেখানে বাস করতে শুরু করা প্রথম থেকেই আরব পড়শিদের চক্ষুশূল ছিল। তাঁদের শঙ্কা হল (ইতিহাস বলে সেই শঙ্কা পুরোপুরি অমূলকও ছিল না) শত শত বছর ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা যে ভূমিতে বাস করছেন, যে জমিতে চাষ করেছেন, সেখান থেকে তাঁদের উৎখাত করে এই ভিনদেশি ইহুদিরা হয়তো তাদের বাসভূমি বানাবে। তাই প্রথমে নীরব যে প্রতিবাদ ছিল তা ক্রমেই সরব হতে লাগল। (Mossad)
জায়গায় জায়গায় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইহুদিদের সংঘর্ষ শুরু হল। ইহুদিরা প্রবল বাধার মুখেও তাদের সিনাগগ ও প্রার্থনাস্থল তৈরি করতে লাগল। দু’পক্ষের বৈরিতা পুরোপুরি সহিংসতার দিকে মোড় নিতে শুরু করল। ১৯২৯ এর সেপ্টেম্বরের এই শুক্রবারের হামলার পরে যা নিয়ে আর কোনও সংশয়ের অবকাশ রইল না। (Mossad)
সেই রাতেই ইসুভের নেতাদের বৈঠক বসল। (হিব্রু শব্দ ইসুভের অর্থ, বসতি। হা-ইসুভ হা-ইভরি শব্দবন্ধ থেকে এটি নেওয়া। এই শব্দবন্ধের অর্থ হিব্রু বসতি। তবে সাধারণভাবে উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ইজরায়েলের আত্মপ্রকাশের আগে পর্যন্ত প্যালেস্তাইনে ইহুদি বসতিকে ইসুভ হিসাবে উল্লেখিত হত।) পেস্ট্রি সহযোগে তুর্কি কফি খেতে খেতে আলোচনা যত এগোল, তত একটা জিনিস ক্রমশ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। (Mossad)
বৈঠকে সবাই যখন অকূলপাথাড়ে, এক নেতা অবশেষে মুখ খুললেন, “প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ কি বলছে? রাজা ডেভিড থেকে শুরু করে সব ইহুদি রাজাই তো গুপ্তচর রাখতেন।”
ইসুভ নেতারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে সারা প্যালেস্তাইন থেকে শুক্রবারের প্রার্থনার জন্য ইহুদি বসবাসকারীদের ডেকে এনেছিলেন। শত হুমকিতেও যে তাঁদের একতা ভাঙা যাবে না, প্রাচীরে তাঁদের প্রার্থনা করার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না, এটাই বৈরি আরব পড়শিদের সমঝে দেওয়ার জন্যই এক ডাকে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো করা হয়েছিল। কিন্তু এই অতর্কিতে যে হামলা হতে পারে তা তাঁরা আন্দাজ করতে পারেননি। কেন পারেননি? কারণ আরবরা যে অতর্কিতে হামলার ছক কষছে সেই খবরটাই ছিল না তাঁদের কাছে। তাহলে উপায়? এই সমস্যার সমাধান না হলে তো যখনই ইহুদিদের কোনও সমাবেশ হবে, সেখানেই হামলার শঙ্কা রয়ে যাবে। (Mossad)
ডেভিডের কাহিনি ও হাগানাহের উন্মেষ পর্ব
বৈঠকে সবাই যখন অকূলপাথাড়ে, এক নেতা অবশেষে মুখ খুললেন, “প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ কি বলছে? রাজা ডেভিড থেকে শুরু করে সব ইহুদি রাজাই তো গুপ্তচর রাখতেন।” (Mossad)

এখানে ইসুভের এই বৈঠকে উল্লেখিত প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও রাজা ডেভিডের গুপ্তচর নিয়ে একটু বলা দরকার। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বলতে এখানে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের মধ্যে লিখিত ২৪ গ্রন্থের সমাহারে হিব্রু বাইবেল বা তানাখের কথা বলা হচ্ছে। হিব্রু বাইবেল অনুসারে খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকের শেষ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতকে প্রাচীন ইজরায়েল ও জুডা অঞ্চলের রাজা ছিলেন ডেভিড। এই হিব্রু বাইবেল আরও জানাচ্ছে, ডেভিডের রণনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে এই গুপ্তচর বাহিনীর প্রয়োগ হয়েছে বারংবার। ডেভিড শত্রু রাজা সলের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন তাঁর কাছে গোপন খবর থাকায়। কারণ সলের গতিবিধির খবর সলেরই ছেলে যোনাথানের কাছ থেকে পেয়ে যেতেন ডেভিড। অর্থাৎ একে আধুনিক কাউন্টার ইনটেলিজেন্সের আদি সংস্করণ বলাই যায়। (Mossad)
“ইহুদি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ গর্ডন থমাসের মতে, সিকি শতাব্দী পরে স্বাধীন ইজরায়েলের গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ গঠনের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরের ওই রাতের বৈঠকেই।”
এখানেই শেষ নয়। কাউন্টার ইনটেলিজেন্সের উদাহরণ আরও আছে। ডেভিডের তৃতীয় পুত্র আবসালোম যখন বিদ্রোহী হয়ে নিজেকে রাজা ঘোষণা করল তখন ডেভিডকে জেরুজালেম ছেড়ে পালাতে হল। আবসালোমের উপদেষ্টা আহিথফেল তখন তরুণ রাজাকে তাঁর পিতা ডেভিডকে আক্রমণের পরামর্শ দিল। এখানেই ডেভিড তাঁর অত্যাশ্চর্য গুপ্তচর নেটওয়ার্কের খেল দেখালেন। পুত্র আবসালোমের রাজ দরবারে কি হচ্ছে তা জানার জন্য ডেভিড তাঁরই বিশ্বাসী উপদেষ্টা হুশাইকে পাঠিয়েছিলেন। হুশাই আবসালোমকে পরামর্শ দিলেন আক্রমণ না করার। (Mossad)
ফলে ডেভিড তাঁর সেনাবাহিনীকে সুসংহত করার সময় পেয়ে গেলেন। এরপর এফ্রাইনের বনের রণাঙ্গণে যখন দুই পক্ষ মুখোমুখি হল, তখন ডেভিডের সেনাবাহিনী সেনাপতি জোয়াবের নেতৃত্বে প্রস্তুত। সেই যুদ্ধে জোয়াবের বর্শার আঘাতে আবসালোম নিহত হয়। (Mossad)
এ তো গেল ডেভিড কীভাবে তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গুপ্তচর ব্যবহার করেছিলেন। ডেভিডের প্রসঙ্গ তুলে সেই রাস্তার কথাই মনে করাল ইসুভের সেই বৈঠক। ইহুদি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ গর্ডন থমাসের মতে, সিকি শতাব্দী পরে স্বাধীন ইজরায়েলের গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ গঠনের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরের ওই রাতের বৈঠকেই। (Mossad)
“ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্য জায়গার মতো প্যালেস্তাইনেও আরব আর ইহুদি দু’পক্ষকেই খুশি করার চেষ্টা করত ইংল্যান্ড। ফলে ইসুভে ঠিক হল ইহুদিদের রক্ষার দায়িত্ব তাদের আধাসামরিক বাহিনী, হাগানাহকে দেওয়া হবে।”
সমস্যা হল গুপ্তচর বাহিনী থাকার প্রয়োজনীয়তা ইসুভের বৈঠকে সবাই বুঝতে পারলেও সেটা চাইলেই আশু করা সম্ভব নয়। অথচ আরবদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচার রাস্তাও চটজলদি বার করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক হল আপাতত ইহুদিদের প্রতি বন্ধু মনোভাবাপন্ন আরবদের খুঁজে বার করে অর্থের বিনিময়ে তাদের কাজে লাগাতে। এরাই আরবদের আগাম হামলার খবর জানিয়ে দেবে। এই কাজের জন্য অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ জোগাড় করা শুরুও হল। (Mossad)
তখন প্যালেস্তাইন ব্রিটিশ শাসনাধীন। ব্যালফুর ঘোষণার পর প্যালেস্তাইনে ইহুদি বসতি রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ইংরেজরা দিলেও ইহুদিরা তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করত না। এই অবিশ্বাসের মূলে ছিল অবশ্য ব্রিটেনেরই কাজকর্ম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্য জায়গার মতো প্যালেস্তাইনেও আরব আর ইহুদি দু’পক্ষকেই খুশি করার চেষ্টা করত ইংল্যান্ড। ফলে ইসুভে ঠিক হল ইহুদিদের রক্ষার দায়িত্ব তাদের আধাসামরিক বাহিনী, হাগানাহকে দেওয়া হবে। (Mossad)
আরও পড়ুন: ম্যান ইটার্স অফ সাভো থেকে প্যালেস্তাইন ক্যাম্পেন
ইসুভের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা হাগানাহকে নিয়ে দু’চার কথা বলা আবশ্যক। প্যালেস্তাইনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে বসতি স্থাপন করা ইহুদিদের রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হাগনাহকে। হাগানাহ শব্দের অর্থ প্রতিরক্ষা। ১৯৪৮ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হাগানাহ ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্সে মিশে যায়। কিন্তু বিংশ শতকে ইহুদি জাতির এই নিজস্ব সেনাবাহিনীর গড়ে ওঠার ইতিহাস দীর্ঘ। (Mossad)
১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে প্রতি বছর হাজার পয়ঁত্রিশ ইহুদি অটোমান শাসিত প্যালেস্তাইনে এসে আশ্রয় নেয়। এর বেশিরভাগই আসে জার শাসিত রাশিয়া থেকে। ১৯০৩ ও ১৯০৫ সালে কিশিনেভে পর পর দুটো ইহুদি বিরোধী দাঙ্গা হয় যাতে শতাধিক ইহুদি নিহত হন। ক্রমে রাশিয়াময় এই ধরণের উগ্র ইহুদি বিরোধী জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে নিরাপত্তার কারণে সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্যালেস্তাইনে চলে আসেন তারা। কিন্ত সেখানেও নিরাপত্তার প্রশ্ন ক্রমশ বড় হয়ে দাঁড়ায়। (Mossad)
ইহুদি ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে সামনে এসে দাঁড়ান ইয়াৎজাক বেন জোভি ও তাঁর স্ত্রী রাচেল ইয়ানত সহ সাত সঙ্গী। ইজরায়েলের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট বেন জোভি আদতে ইউক্রেনের পোলতাভাতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম থেকেই ইউক্রেনে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে সামিল হন বেন জোভি। (তাঁর আসল নাম ইজাক শিমশেলেভিচ। তুর্কি শাসিত প্যালেস্তাইনে পালিয়ে যাওয়ার সময় নাম বদল করেন।) ইহুদিদের গোপন সংগঠন বিনে মোজে (যার অর্থ মোজেসের সন্তান) পায়োলে জিয়ন ও হোভেভেই জিয়ন (জিয়ন প্রেমী) এর মতো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। (Mossad)
“রাশিয়ায় ইহুদিদের সংগঠনগুলোর কোমর ভাঙতে জার সরকার তুমুল ধরপাকড় শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে ১৯০৭ সালে নাম বদলে বেন জোভি করে তুর্কি শাসনাধীন প্যালেস্তাইনে ঢোকেন তিনি। সেখানেই বেন জোভি সরাসরি ইহুদি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।”
১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বেসেলে আয়োজিত প্রথম ইহুদি কংগ্রেসের অন্যতম উদ্যক্তাও তিনি। পরে ইহুদিদের অধিকার রক্ষায় গড়ে তোলা বামপন্থী ইহুদি শ্রমিক সংগঠন পায়োলে জিয়ন (যার অর্থ জিয়নের কর্মী এ যোগ দেন। কিন্তু রাশিয়ায় ইহুদিদের সংগঠনগুলোর কোমর ভাঙতে জার সরকার তুমুল ধরপাকড় শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে ১৯০৭ সালে নাম বদলে বেন জোভি করে তুর্কি শাসনাধীন প্যালেস্তাইনে ঢোকেন তিনি। সেখানেই বেন জোভি সরাসরি ইহুদি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। (Mossad)
বেন জোভিরা বুঝলেন কাকুতি মিনতি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। ১৯০৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জাফা শহরে বেন জোভি তাঁর এক কামরার ফ্ল্যাটে রাতভোর সঙ্গীদের নিয়ে আলোচনা করলেন। পরিণামে ভূমিষ্ঠ হল প্যালেস্তাইনে প্রথম ইহুদি সুরক্ষা বাহিনী। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ইহুদি বাহিনীর জেনারেল বার-গিওরার নামে নামাঙ্কিত হল এই বাহিনী। (Mossad)
এই প্রতিরোধে কাজও হল কিছুটা। ইহুদিরা যে কেবল পড়ে পড়ে মার খাবে না, প্রয়োজন হলে পাল্টা মারও দিতে পারে এই সত্যটা স্পষ্ট হতে লাগল বৈরি আরব পড়শিদের কাছে। এদিকে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত প্রতিবছরে ৩৫ হাজার ইহুদি প্যালেস্তাইনে এলেন। বার-গিওরা বাহিনীর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলল। শেষমেষ ইসুভ ২০০৯ সালে এই বাহিনীকে আরও সম্প্রসারিত করে নাম দিলেন হাশোমার বা রক্ষী। আরেক ইহুদি বিশেষজ্ঞ রনেন বার্গম্যানের মতে, ১৯১২ সাল নাগাদ হাশোমার বাহিনী এক ডজন ইহুদি বসতিকে রক্ষা করছিল। আর এর মধ্য দিয়েই পরবর্তী কালে সেনাবাহিনী আর মোসাদের কাজের বীজ রোপিত হয়েছিল। (Mossad)
“পরিস্থিতি ফের ঘোরাল হয়ে উঠল ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে অ্যাডল্ফ হিটলারের নাৎসী পার্টি ক্ষমতায় আসার পর। মাত্রাছাড়া নির্যাতন, নিপীড়নের মুখে পড়ে, পরের তিন বছরে ইউরোপ থেকে সর্বস্ব খুইয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে কোনওরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে লাখ তিনেক ইহুদি শরণার্থী প্যালেস্তাইনে এলেন।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে চিত্রটা পাল্টালো। যুদ্ধে হেরে প্যালেস্তাইন থেকে তুর্কিরা হঠে গেল। ভূখণ্ডে ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলিত হল। ১৯২০ নাগাদ হাশোমার রূপান্তরিত হল হাগানাহ এ। ততদিনে ইহুদি রাজনীতির ভাগ্যাকাশে ডেভিড বেন গুরিয়ন নামক কিংবদন্তী উদিত হয়েছেন। সিকি দশক পরে যিনি হবেন স্বাধীন ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী সেই বেন গুরিয়ন ইসুভের গভর্নিং কাউন্সিল জিউস এজেন্সির নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি হাগানাহের রাশও নিজের হাতে নিলেন। ১৯৪৮-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ঠিক যেভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একাধারে সরকার আর মোসাদ নিজের এক্তিয়ারে রেখেছিলেন বেন গুরিয়ন। (Mossad)
মোসাদ হওয়ার সলতে পাকানো
আমরা ফের সেই ১৯২৯ এর সেপ্টেম্বর রাতের ইসুভের বৈঠকে ফিরে যাই। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে কিছু আরব চর খুঁজে বার করা হল যারা অর্থের বিনিময়ে আরবদের খবর দিতে রাজি হল। (Mossad)

ধীরে ধীরে শুরু হল সেই ব্যবস্থা। আরব চরেরা সম্ভাব্য হামলার আগাম খবর দেওয়া শুরু করল আর সেই খবর পেয়ে হাগানাহ যথাসম্ভব সুরক্ষার বন্দোবস্ত করত। এইভাবেই আপাত শান্তিতে বছর পাঁচেক কাটল। (Mossad)
ইসুভ অবশ্য এতেই হাত পা গুটিয়ে বসে রইল না। তারা উঠে পড়ে লাগল চর নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। যে আরব গোপনে খবর দিতে রাজি হল তাকেই এই গুপ্তচর নেটওয়ার্কে সামিল করা হল। ব্রিটিশ সেনাদের বুট পালিশ করা ছেলে, আরব ব্যবসায়ী, শিক্ষক, স্থানীয় আরব রাউডা কলেজের পড়ুয়া-কেউ বাদ গেল না। ফলে ক্রমে ক্রমে ইসুভের কাছে শুধু আরব না, ব্রিটিশদেরও মতিগতি সম্বন্ধে খবরাখবর আসতে শুরু করল। (Mossad)
“মসজিদ থেকে ইহুদিদের সমুদ্রে ফেলার আহ্বান জানানো হতে লাগল। ইহুদিদের জমি দেওয়া ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিরুদ্ধে আরবরা প্রতিবাদে সোচ্চার হল। ইহুদিরা পাল্টা বলল যে জমি মোটেই দানছত্র করে দেওয়া হয়নি। রীতিমতো জমি কিনতে হয়েছে তাদের।”
পরিস্থিতি ফের ঘোরাল হয়ে উঠল ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে অ্যাডল্ফ হিটলারের নাৎসী পার্টি ক্ষমতায় আসার পর। মাত্রাছাড়া নির্যাতন, নিপীড়নের মুখে পড়ে, পরের তিন বছরে ইউরোপ থেকে সর্বস্ব খুইয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে কোনওরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে লাখ তিনেক ইহুদি শরণার্থী প্যালেস্তাইনে এলেন। ইসুভের পক্ষ থেকে তাদের যথাসম্ভব পুণর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। ক্রমে প্যালেস্তাইনের জনগণের এক তৃতীয়াংশ হয়ে দাঁড়াল ইহুদিরা। (Mossad)
আর এতেই আগুন জ্বলে গেল আরব মহল্লাগুলিতে। এবার তারা খোলাখুলি ইহুদি বিরোধিতায় নামল। মসজিদ থেকে ইহুদিদের সমুদ্রে ফেলার আহ্বান জানানো হতে লাগল। ইহুদিদের জমি দেওয়া ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিরুদ্ধে আরবরা প্রতিবাদে সোচ্চার হল। ইহুদিরা পাল্টা বলল যে জমি মোটেই দানছত্র করে দেওয়া হয়নি। রীতিমতো জমি কিনতে হয়েছে তাদের। আর ব্রিটিশরা মোটেও তাঁদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না। বরং তাঁদের কেনা জমি আরবরা চুরি করছে ব্রিটিশদের পরোক্ষ মদতে। (Mossad)
আরও পড়ুন: পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এলি কোহেন- ঊনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপট
এই বৈরিতার জন্য ব্রিটেনকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন গর্ডন থমাস। তাঁর ‘গিডনস স্পাইস-দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অফ মোসাদ’ এ লিখছেন, “ব্রিটেন এই দু’তরফকেই তোয়াজ করার খেলাটা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।” ১৯৩৬ সালের আরব বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটেন সেই বিদ্রোহ দমন করলেও ইহুদিরা পরিষ্কার বুঝতে পারে, শক্তি সঞ্চয় করে আরবরা ফের হামলা করবে। ফলে হাগানাহকে শক্তিশালী করার দিকে ইসুভ মন দিল। দলে দলে ইহুদি তরুণ হাগানাহতে যোগ দিল। (Mossad)
হাগনাহের রাজনৈতিক শাখা খোলা হল। এই শাখা শুধু যে আরবদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর বড় হাতিয়ার হয়ে উঠল তাই নয়, পরবর্তীকালে মোসাদের হয়ে কাজ করা অনেকেরই হাতেখড়ি হল এখানে।
মোসাদ হওয়ার পথে আরেক ধাপ এগোলো হাগানাহ। (Mossad)
তথ্যসূত্র-
(১) গিডনস স্পাইস-দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অফ মোসাদ- গর্ডন থমাস,
(২) রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট- রনেন বার্গম্যান
(৩) জেরুজালেম-দ্য বায়োগ্রাফি-সাইমন সেবাগ মন্টিফিঁয়োরে
ছবি সৌজন্য- লেখক
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে