শরৎকালের অকালবোধন বা দুর্গাপুজো বাঙালির প্রধান উৎসব হলেও মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা দেবী কালিকা কিন্তু বিরাজ করেন বাঙালির মনে এবং প্রাণে। শ্যামা অথবা কালী দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী। গুপ্ত, পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের সময় বাংলায় শাক্তধর্মের অস্তিত্ব থাকলেও তার প্রচার ও প্রসার খুব একটা ছিল না। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত দেবী কালিকার মাহাত্ম্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়নি।
ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবশ্য বহুযুগ ধরেই মাতৃতান্ত্রিক পুজো করা হত। বিশেষ করে গ্রিস এবং মিশরেও মাতৃপুজোর কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে। ভারতেও শক্তিসাধনা শুরু হয়েছিল বহুযুগ আগে। পার্বতী, সতী, দুর্গা, চণ্ডীর উপাসনার সঙ্গে যুক্ত দেবী কালিকাও পূজিত হয়ে এসেছেন। বেদের রাত্রিসূত্র থেকে সম্ভবত মা কালীর ভাবনা এসেছে। বৈদিক সাহিত্যেও ‘কালী’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুণ্ডক উপনিষদে কালী যজ্ঞাগ্নির সপ্তজিহ্বার একটি জিহ্বা বলেই মনে করা হয়। ‘কালী করালী চ মনোজবা চ সুলোহিত যা চ সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী, লেলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বা’।

শাক্ত উপাসকেরা কালীকে আদ্যাশক্তিতে ভগবতীর স্তবের দ্বারা দেবী কৌশিকীর আবির্ভাব বলে মনে করেন। কৌশিকী বা কালী যুদ্ধ করেছিলেন শুম্ভ ও নিশুম্ভের সঙ্গে। সেখানে যোগ দেন দেবতারাও। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ হয় অসুরনিধন। বর্তমানে বঙ্গদেশের ঘরে ঘরে মা কালী পূজিত হন। বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজোর পরেই কালীপুজোর স্থান। মহাসমারোহে দেবী কালিকার পুজো আয়োজিত হয়। শাক্ত সাহিত্য এবং সংগীতে একাধিক পদকর্তা কালীর গুণকীর্তণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়, সাধক কমলাকান্ত, অ্যান্টনি কবিয়াল, নিধুবাবু, দাশরথি রায়, সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথও রয়েছেন এই তালিকায়। তিনিও কালীর প্রসঙ্গ এনেছেন তাঁর বিভিন্ন রচনায়। নৃত্যনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-তে, ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে এবং ‘বিসর্জন’ নাটকে কালীর প্রাসঙ্গিক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাল্মীকি প্রতিভায় রামপ্রসাদী সুরে তিনি মাকে ত্যাগ করার সময় বলছেন, ‘শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা, পাষাণের মেয়ে পাষাণী তুই না বুঝে মা বলেছি মা’।
রবীন্দ্রনাথের মতো কাজি নজরুল ইসলামও তাঁর অগণিত সংগীতে কালীর গুণগান গেয়েছেন। সাধক-কবি রামপ্রসাদের পরেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী কাজি সাহেব সংখ্যার নিরিখে শ্যামাসংগীত রচনায় রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে। নজরুল রচিত শ্যামাসংগীতের সংখ্যা দুশোরও বেশি। মুক্তমনা বিদ্রোহী কবি এক সময় হয়ে উঠেছিলেন ভক্তকবি। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে নানা মত এবং তর্কের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ, নজরুল শুধু শ্যামাসংগীত রচনাই করেননি, একইসঙ্গে করেছিলেন কালীসাধনা।
যখন কবি কলকাতার শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন, তখন প্রায়শই শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর ঠাকুরঘরের কোণে বসে দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন। কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পরে দাহকার্য সেরে এসে একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানতে পারেন যে সেদিনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে নজরুল এবং দাদাঠাকুরের সাগরেদ নলিনীকান্ত সরকার আসছেন তাঁর বাড়িতে। সেইদিন রাত নটার পরে দু’জনেই এসে পৌঁছন লাভপুরে। পরের দিন দেবী ফুল্লরার পীঠে নাটমন্দিরে বসে নজরুল প্রাণায়াম শুরু করেন এবং তাঁর সারা শরীর ঘেমে ওঠে। চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল। সেই অবস্থায় বসে চেতনা সম্পূর্ণ ফিরে আসার আগেই তিনি গান লিখে তাতে সুর দেন। এরপর শুরু করেন সংগীত পরিবেশন। মধ্যরাত্রে গেয়ে ওঠেন তাঁরই রচিত শ্যামাসংগীত। সদ্য পুত্রশোকে জর্জরিত তারাশঙ্করের মনে প্রশান্তি ফিরে আসে সেই মাতৃ আরাধনা শুনে। এই প্রসঙ্গে পাঠকদের অবগত করা উচিত যে তারাশঙ্করও এক সময় তাঁর লাভপুর এবং টালা পার্কের বাড়িতে তন্ত্রসাধনা করতেন।
অনেক নজরুল বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন যে ১৯৩০ সালে তাঁর প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পরে মানসিক দুর্বলতার কারণে তিনি মুর্শিদাবাদের লালগোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদারের কাছে যেতেন একটু শান্তির খোঁজে। একদিকে পুত্রের মৃত্যু আর অন্যদিকে স্ত্রী প্রমীলার অসুস্থতা কবির মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। অন্য সূত্রে জানা যায়, নজরুল চেয়েছিলেন বরদাচরণের যোগশক্তিবলে নিজের মৃত পুত্রকে একবার স্থূলদেহে দেখতে। তাঁর সেই আকাঙ্খা পূরণ হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। তাই সেটা সঠিক জানা যায় না।
প্রখ্যাত নজরুল গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্তের সঙ্গে এক ব্যক্তিগত কথোপকথনে জানতে পারি যে গৃহতান্ত্রিক বরদাচরণ আগমবাগীশের সঙ্গে বিদ্রোহী কবির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯২৪ সালে বহরমপুরে, যখন নজরুল ডা. নলীনাক্ষ সান্যালের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেখানে যান। ডা. সান্যালের বিয়ের ঠিক সাতদিন পরে নজরুলের নিজেরও বিয়ে হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়ের হিসেবে তাঁর পুত্রের মৃত্যুর কারণে মানসিক ব্যথা-বেদনার প্রসঙ্গ অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু তখন থেকেই নজরুলের সঙ্গে বরদাচরণের এক গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় যোগী এবং চিত্রশিল্পী বামাক্ষ্যাপার। কবি কী প্রথায় কালীসাধানায় মগ্ন ছিলেন, তা জানা না গেলেও তাঁর শ্যামাসংগীতে শাক্তদর্শন এবং সনাতন ভারতীয় দর্শনের প্রভাব ও গভীর কালীভক্তির প্রকাশ ঘটেছে। সেই দর্শনের কথা বিদ্রোহী কবি বলেছেন ভীষণ সরল ভাষায়, যা সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য। তাঁর লেখনীতে মাতৃরূপিনী এবং কন্যারূপিনী শ্যামার ছবিই ফুটে উঠেছে বারে বারে।
উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ। ‘আদরিণী মোর কালো মেয়েরে কেমনে কোথায় রাখি’ বা ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন’। বিশেষ করে কালো মেয়ের পায়ের তলায় গানটির শেষ কটি লাইনে শ্যামা মায়ের কন্যারূপটিই প্রকট হয়ে ওঠে। এছাড়া আত্মনিবেদনের উদাহরণ পাওয়া যায় ‘শ্যামা নামের লাগলো আগুন, আমার দেহ ধূপকাঠিতে’ গানটিতে। গানের একদম শেষাংশে আমরা শুনতে পাই, ‘সব কিছু মোর পুড়ে কবে চিরতরে ভস্ম হবে, মার ললাটে আঁকব তিলক, সেই ভস্ম বিভূতিতে’।

একবার সুরকার কমল দাশগুপ্ত কবিকে বলেন আজকেই দুটো শ্যামাসংগীত লিখে দিতে হবে। উত্তরে কবি বলেছিলেন কিছু খাবার আনতে, কারণ তাঁর খিদে পেয়েছিল। খাবার এল কিন্তু তখন নজরুল বিচরণ করছেন এক অন্য জগতে। সাদা খাতার ওপরে খস খস করে লিখেই চলেছেন। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেল, কিছু্রণ পরে কমল দাশগুপ্তকে ডেকে তাঁর হাতে কবি তুলে দিলেন দুটো শ্যামাসংগীত। কবির লেখা কিন্তু যেমন চলছিল, তেমনই চলছে তখনও। এরপর চা এল, সেই কথা তাঁকে বলাতে তিনি কোনওরকমে চা খেয়ে নিয়ে আবার মন দিলেন লেখায়। দিনের শেষে দেখা গেল যে সেদিন কাজী সাহেব মোট বারোখানি শ্যামাসংগীত লিখেছেন। পরবর্তীকালে কমলবাবু তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে দু’খানি গানে সুরারোপ করে সংগীতশিল্পী মৃণালকান্তি ঘোষকে দিয়ে রেকর্ড করান।
যখন ওপার বাংলায় দুর্গামূর্তি ভাঙা হয় আর এপারে আক্রমণ করা হয় মসজিদ, তখন শ্রবণশক্তি আরও প্রখর এবং সজাগ হয়ে ওঠে। শুনতে ইচ্ছা করে ইসলামী কবির লেখা ‘জ্বলিয়া মরিলি কে সংসারও জ্বালায়, তাহারে ডাকিছে মা কোলে আয় কোলে আয়’, ‘জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে, কোলে তুলে নেয় মা মরণের ছলে। এ যে সাংসারিক জীবনদর্শনের কথা! মৃত্যুর ভয়ংকর রূপ সেখানে উধাও! আরও অবাক হতে হয়, যখন দেখি ইসলামী সংগীতের রচয়িতা দেশভক্ত বিদ্রোহী কবি লিখছেন, ‘মহাকালের কোলে এসে গৌরী হল মহাকালী, শ্মশানচিতার ভস্ম মেখে ম্লান হল মার রূপের ডালি’।
প্রখ্যাত নজরুল গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্তের সঙ্গে এক ব্যক্তিগত কথোপকথনে জানতে পারি যে গৃহতান্ত্রিক বরদাচরণ আগমবাগীশের সঙ্গে বিদ্রোহী কবির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯২৪ সালে বহরমপুরে, যখন নজরুল ডা. নলীনাক্ষ সান্যালের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেখানে যান। ডা. সান্যালের বিয়ের ঠিক সাতদিন পরে নজরুলের নিজেরও বিয়ে হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়ের হিসেবে তাঁর পুত্রের মৃত্যুর কারণে মানসিক ব্যথা-বেদনার প্রসঙ্গ অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু তখন থেকেই নজরুলের সঙ্গে বরদাচরণের এক গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখা মোট ২৪৭টি শ্যামাসংগীতের আলোচনা এবং বিশ্লেষণ সম্ভব নয় স্বল্প পরিসরে। বেশিরভাগ গানেই তিনি নিজে সুর দিয়েছিলেন। আবার এমন অনেক গান রয়েছে যেগুলিতে সুরারোপ করেছেন অন্য সুরকাররা। এর ভেতরে অনেক গানই তো অল্পশ্রুত কিন্তু তাঁর মাতৃআরাধনা শুনে কালীসাধক নজরুলের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় বলেই মনে করি। তিনি বৈষ্ণবপদাবলীর অন্তর্গত কীর্তনও লিখেছেন। দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষায় ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে তিনি যেমন বিদ্রোহ করেছেন, তেমনই বিরুদ্ধাচারণ করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। একদিকে লিখেছেন, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ইদ’ আবার অন্যদিকে লিখছেন, ‘জগতজননী শ্যামা, আমি কি মা জগতছাড়া’, ‘কোন দোষে মা তুই থাকিতে আমি চির মাতৃহারা’, ‘ও মা তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো, আমি কেন অন্ধ হয়ে দেখি শুধুই কালো’।
তথ্যসূত্র – বাঁধন সেনগুপ্ত
ছবি ঋণ স্বীকার
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।