হলুদ হয়ে আসা একটি বই। সাকুল্যে চল্লিশ পৃষ্ঠার। মলাটে গা-ছমছমে হরফে লেখা নাম— ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’। সম্পাদনায়, ‘জাগৃহি’। প্রকাশসাল ১৩৭২ বঙ্গাব্দ (১৯৬৫ খ্রি.)। পেপারব্যাক, দাম ৪০ পয়সা। (Netaji Mystery)
হারিয়ে-যাওয়া গির্জা, ভাঙা স্কুলবাড়ি তথা আগরপাড়ার মিশন-কাহিনি
বইটিকে আপাতভাবে বোঝার জন্য এটুকু পরিচিতি প্রয়োজন। প্রকাশের ৬০ বছরে দাঁড়িয়ে, সে-বই আরেকবার পড়তে-পড়তে একটি তত্ত্বের কাছে ফিরে যাওয়া গেল। তত্ত্বটি অসার, ফলে বাতিল হয়েছে সময়ের সঙ্গে; কিন্তু এমন তত্ত্ব বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নিতান্ত বিরল ছিল না। কিন্তু তার থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ এ-বইয়ের পরিচয়। বিষয়— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান ও পুনরাবির্ভাব। আলোচ্য বইটি প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয়টি নাগালে আসেনি। তবে পঞ্চাশের দশক থেকেই নেতাজির অন্তর্ধান-সংক্রান্ত লেখাপত্র ও বইয়ের যে জোয়ার এসেছিল, তারই ফসল এটি— সে-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। একই সঙ্গে এ-ও বলে রাখা প্রয়োজন, নেতাজির অন্তর্ধান-বিষয়ক বাংলা-ইংরাজি তাবড়-তাবড় বইয়ের সাপেক্ষে, ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’ নিতান্তই অনালোচিত।
ষাটের দশকে সুভাষ-অন্তর্ধান নিয়ে জাগৃহি পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হত। ঘরে-ঘরে লোকজন সংগ্রহ করতেন পত্রিকাটির মাসিক সংখ্যা। সাহিত্যিক কিন্নর রায় জানান, প্রত্যেক বছর ২৩ জানুয়ারি কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় জাগৃহি পত্রিকার তরফে জনসমাবেশ করে দাবি করা হত, সুভাষ স্ব-পরিচয়ে প্রকাশ্যে আসবেন একদিন। সন্তানদলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই এদের। বরং, শৌলমারীর সাধুই যে নেতাজি— তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল তারা। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক থেকে পত্রিকাটির রমরমা শুরু। সত্তরের গোড়ায় এসে, নকশাল আন্দোলনের সময়, বন্ধ হয়ে যায় এর প্রকাশ।

আলোচ্য ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’-তে সম্পাদক হিসেবে নির্দিষ্ট কারোর নাম নেই; ‘জাগৃহি’ অর্থাৎ পত্রিকা-কর্তৃপক্ষই সম্পাদনার দায়িত্বে। প্রকাশক গৌরপদ বসু। ঠিকানা— কলকাতার ৭৪, সার্পেনটাইন লেন। ‘প্রকাশকের বক্তব্য’ অংশে লেখা— “‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’ নামক এই পুস্তকে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত বিষয়গুলি পূর্ব্বে ‘জাগৃহি’ হতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও বর্ত্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ঐ বিষয়গুলি সুবিন্যস্ত ভাবে পুস্তকাকারে প্রকাশের জন্য— অগণিত নেতাজী অনুরাগীদের সনির্বন্ধ অনুরোধে পুস্তিকাকারে প্রকাশ করিলাম।”
মূল বইয়ে প্রবেশের আগে, ভূমিকাটির অংশবিশেষ পড়ে নেওয়া যাক—
“কালের অধীশ্বর বিধাতার আশীর্বাদে যিনি মৃত্যুঞ্জয়ী— শাহনওয়াজ কমিশনরূপী বান কি তাকে মারতে পারে? ডঃ সত্যনারায়ণ সিংহের সামর্থ কি তাঁকে রাশিয়ার ইয়াখুটস্ক বন্দীশালায় বন্ধ করে রাখতে পারেন! কালপূর্ণ হলেই— মহাকালের বাঞ্ছিত কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য মহাশক্তির ক্রোড়াশৃত মহাসাধক নেতাজী শৌলমারী আশ্রম হতে ‘বিশ্বপিতা’ রূপে আবির্ভূত হবেন।” এবং, ভূমিকার শেষ বাক্য— ‘এ নহে কাহিনী, এ নহে স্বপন, আসিবে— সেদিন ১৯৬৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের পূর্বেই আসবেই।’ (Netaji Mystery)
এখানে উক্ত দুই ব্যক্তির সামান্য পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। শাহনওয়াজ খান ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজির সহকর্মী, পরবর্তীকালে কংগ্রেস আমলে জওহরলাল নেহরুর বদান্যতায় রাজ্যসভার মন্ত্রী হন। ১৯৫৬ সালে শাহনওয়াজ খানকে চেয়ারম্যান করে তৈরি হয় ‘শাহনওয়াজ কমিটি’, যার উদ্দেশ্য ছিল নেতাজির মৃত্যুরহস্যের সমাধান করা। সেই কমিটি রিপোর্ট দেয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকুতে বিমান-দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। বাঙালির এক বৃহৎ অংশ সেই রিপোর্ট মেনে নেয়নি। কংগ্রেস তথা জওহরলাল-ঘনিষ্ঠ হয়ে শাহনওয়াজ নৈতিকতা হারিয়েছেন— উঠেছিল এই অভিযোগও। অন্যদিকে, সত্যনারায়ণ সিংহ ছিলেন সাংবাদিক। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘রহস্যের অন্তরালে’ শীর্ষক ধারাবাহিক কলাম লিখতেন তিনি, যার মূল উপপাদ্য, তিনি খবর পেয়েছেন— অন্তর্ধানের পর, রাশিয়ার হাতে বন্দি হয়েছিলেন নেতাজি এবং পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়েও বন্দি ছিলেন সে-দেশের ইয়াখুটস্ক কারাগারের ৪৫ নং সেলে।
বেশ-কয়েকটি আকর্ষণীয় সূত্র তুলে ধরেছে আলোচ্য বইটি। ১৯৪৫-সালে অন্তর্ধান-পরবর্তী সময়েও ভারতের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন ঠিকানায় নাকি দেখা গিয়েছে নেতাজিকে। অবশ্য এই দাবি নতুন না। অন্যান্য বইয়েও— কখনও তাসখন্দে, কখনও জামুরিয়ায়, কখনও আবার চীনে নেতাজিকে দেখা গেছে— এমন দাবি-সম্বলিত ছবি ছাপা হয়েছে। কিন্তু সেসবের তুলনায় জাগৃহির দাবি খানিক আলাদা। ক্রমান্বয়ে দেখে নেওয়া যাক সেসব—
১। ১৯৪৮ সালে নেতাজি ভারতে ফিরে আসেন। হৃষীকেশের কাছে, কুশী নদীর ধারে টনকপুর ও কাটগুদাম নামের দুটি গ্রামে কিছুকাল বসবাস করেন তিনি। এছাড়াও, হৃষীকেশে জনৈক বুধিবহ্লব পেনুলীর বাড়িতেও ছিলেন স্বল্প সময়।
২। ১৯৪৯-এ, ভারত-তিব্বত সীমান্তে নাদনস্টেটের মহারাজার বাড়িতে ১০ দিন ছিলেন তিনি।
৩। ১৯৪৯ সালে, ভারত-তিব্বত সীমান্তের কাটরাই, কুলু ভ্যালি, কুটকাপুর, ঘোরদোর প্রভৃতি স্থানে বেশ কিছুদিন বসবাস করেন। কুটকাপুরে তাঁর ঠিকানা ছিল— ‘শ্রী সন্তরণ শর্মা, এস ডি ও ক্যানেল, ধাঁইপাঁই সাবডিভিশন, কুটকাপুর, জেলা ফিরোজপুর, পাঞ্জাব।
৪। ১৯৫১-৫২ সালে, জ্বালামুখী বাজারে রামলাল বেপারীর বাড়িতে, কাটরাই-এ ভগবত রামজীর বাড়িতে, আলমোড়ায় ডাঃ বিন্দুভূষণ যোশীর বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেন নেতাজি।
৫। ১৯৫০ সালে বিহারের গোরক্ষপুর থেকে পায়ে হেঁটে নেপালে যান নেতাজি। পরবর্তীতেও, ১৯৫৩-৫৪ সালে নেপালের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন।
৬। শেষাবধি, ১৯৫৯ সালের ৯ মে সারদানন্দ রূপে কোচবিহারের শৌলমারী আশ্রমে ‘আবির্ভূত’ হন।

ওপরের দাবিগুলির মাধ্যমে ডঃ সত্যনারায়ণ সিংহকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল জাগৃহি। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে নেতাজির রাশিয়ায় বন্দি থাকার দাবি যে মিথ্যা— তা প্রমাণ করতেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বসবাসের ‘প্রমাণ’ দাখিল করা। বলা বাহুল্য, গোটা বই জুড়েই সত্যনারায়ণ সিংহকে তীব্র ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করা হয়েছে।
‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’ বইটির প্রথম খণ্ড পড়লে তিনটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায়। এই বই প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল—
১। বিমান দুর্ঘটনার কাহিনি ভুয়ো, স্বাধীনতার পরে ছদ্মবেশে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নেতাজি অবস্থান করেন, তা প্রচার করা
২। ডঃ সত্যনারায়ণ সিংহ একজন ঠগ ও প্রতারক, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া
৩। শৌলমারীর সাধু সারদানন্দই যে নেতাজি, তা প্রতিষ্ঠা করা
মূলত শৌলমারী-প্রসঙ্গে জনসাধারণের মনে বিশ্বাস জাগাতেই প্রথম দুটি প্রচারের প্রয়োজন ছিল। সে-কাজ সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছিল জাগৃহি। নামকরণে ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’-তেও তেমনই ইঙ্গিত। শৌলমারী-তত্ত্বের প্রচ্ছন্ন মুখপত্র বলা যেতে পারে এই পত্রিকা-প্রকাশনাটিকে। তবে সেই সন্ন্যাসী— সারদানন্দ যে নেতাজি নন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ষাটের দশকেই। ফলে, তাঁকে নিয়ে সাময়িক যে হুজুগ দেখা দেয়, তা স্তিমিতও হয়ে আসে ওই দশকের মধ্যেই। তত্ত্বের ব্যর্থতার কারণেই, বর্তমানে নেতাজি-গবেষণায় জাগৃহি পত্রিকাটি বিশেষ গুরুত্ব পায় না। তবে সেকালে জনমানসে রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। (Netaji Mystery)

শেষ করার আগে, জাগৃহিরই আরেকটি ‘অলৌকিক’ দাবির উল্লেখ করা যাক। ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’ বইয়ের তৃতীয় পৃষ্ঠায় এক ব্যক্তির ছবি ছাপা হয় এবং দাবি করা হয়, ইনিই নেতাজি। ছবি-পরিচিতিতে লেখা— ‘১৯৪৮ সালের পরে ফয়জাবাদের সিমুয়ীকারিরাতে তোলা ছদ্মবেশী নেতাজী সুভাষের ফটো’। ছবির ব্যক্তিটির মুখের আদল ও চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি সুভাষচন্দ্র নন। ওই ছবির ঠিক নিচেই, সারদানন্দের সই এবং নেতাজির সই একইসঙ্গে মুদ্রিত। হাতের লেখা দেখে খালি চোখেই বোঝা যায়, সম্পূর্ণ আলাদা দুই ব্যক্তির। ফলে, একটি নির্দিষ্ট মতবাদ প্রচারের স্বার্থেই যে জাগৃহির এইসব কার্যকলাপ, সেই সন্দেহ স্পষ্ট হয় ক্রমশই।
নেতাজির বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তত্ত্ব সরিয়ে রাখলে অন্যান্য যে-সমস্ত সম্ভাবনা উঠে আসে— রাশিয়ায় বন্দি অবস্থায় মৃত্যু কিংবা ফৈজাবাদের গুমনামী বাবা ওরফে ভগওয়ানজির নেতাজি হওয়ার সম্ভাবনা— সেসব বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। শৌলমারীর সাধুর তত্ত্বের অসারতাও প্রমাণিত। এই প্রেক্ষিত থেকে ষাট বছর আগে প্রকাশিত ‘রহস্য নয় ষড়যন্ত্র’ নামক বইটি পড়লে বোঝা যায়, এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে একটি ষড়যন্ত্র তথা দাবি প্রচারেরই চেষ্টা চলছিল। কালক্রমে বইটি তার গুরুত্ব হারায় ও তলিয়ে যায় কালের গর্ভে। বর্তমানে নেতাজি-অন্তর্ধান সংক্রান্ত আলোচনায় বইটি নতুন কোনও তথ্য সরবরাহ করে না। তবে অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতা বোঝার ক্ষেত্রে এই জাতীয় অর্বাচীন নথির গুরুত্ব নেহাত কম নয়। অন্তত প্রবণতাগুলি, বিভ্রান্তিকর হলেও, চিহ্নিত করা যায় সহজেই।
(জাগৃহি-তে মুদ্রিত বানানের রূপ অপরিবর্তিত রাখা হল)
ছবি: লেখক
জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।