কথায় বলে, ‘অরুচির অম্বল, শীতের কম্বল’, অর্থাৎ যা অপরিহার্য। এতদিন মানুষের মূল চাহিদা ছিল রোটি, কপড়া ঔর মকান। কিন্তু ‘জেন জ়েড’-এর যুগে সেই দৃষ্টিভঙ্গির ঘটেছে আমূল পরিবর্তন।
গত কয়েকমাস ধরে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন থেকে শুরু করে গৃহিনীদের রান্নাঘরে পর্যন্ত যে বিষয়টি অবলীলায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে সেই ‘চ্যাট-জিপিটি’ (chatGPT) হল আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু।
‘ওপেনআই (OpenAI) নামক ইউএসএ-র একটি কোম্পানি মাইক্রোসফটের সহযোগিতায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এআই অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছে চ্যাট-জিপিটি নামক অ্যাপটি।
গতবছর নভেম্বরে সদ্য তৈরি হওয়া অ্যাপটির বয়স হাতেগোণা কয়েকমাস। কিন্তু এরই মধ্যে এটি বিশ্বের প্রায় বারো কোটি মানুষ ব্যবহার করেছে।

চ্যাট-জিপিটির পুরো নাম হল চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল টুলস্’। অর্থাৎ, এটি আলাপচারিতা বা চ্যাট করার একটি অ্যাপ বা চ্যাটবট সিস্টেম। এখানে ‘জেনারেটিভ’ শব্দের অর্থ তৈরি করা, ‘প্রি ট্রেন্ড’ অর্থাৎ প্রশিক্ষিত ট্রান্সফর্মার। চ্যাট জিপিটিতে ট্রান্সফরমার এমন একটি মেশিন লার্নিং মডেল, যা কোনও কিছুর বিষয়ে সহজেই বুঝতে পারে। চ্যাট-জিবিটি হল একটি চ্যাটবট।
চ্যাট-জিপিটির একটি নির্দিষ্ট তথ্যভাণ্ডার আছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত তথ্য ব্যবহার করে এটি কাজ করে। এটি এখনও গুগলের মতো সরাসরি ইন্টারনেটে কাজ করতে অক্ষম।
এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে স্মার্ট অ্যাপলিকেশন এই চ্যাট-জিপিটি। যেমন গুগলে আপনি কিছু সার্চ করলে সেটি বিভিন্ন লিংক, ছবি বা তথ্য দেয়। এই সার্চ ইঞ্জিন এত বেশি তথ্য সম্বলিত হয় যে, অনেক সময় আমরা যে তথ্য চাইছি সেটা না এসে সম্পূর্ণ আলাদা কোনও তথ্য আসে। এগুলোকে বলা হয় ইনফরমেশন পলিউশন। চ্যাট-জিপিটিতে এই সমস্যাগুলো নেই, সেকেন্ডের মধ্যে টেক্সট ফরম্যাটে যথাযথ উত্তর, এবং প্রয়োজনে ব্যবহারকারীর কথা মেনে সেই উত্তরকে আরও বেশি উন্নত করার ক্ষমতা রাখে এই অ্যাপটি। পোষ্যের বিরল রোগ সনাক্তকরণ থেকে শুরু করে, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, অ্যালগোরিদিম, আইনের জটিল প্রশ্নের উত্তর, এমনকি উদ্ভাবনমূলক কাজ — যেমন কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখার কাজও বিজ্ঞানের এই নবতম আবিষ্কার কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অবলীলায় করে দিচ্ছে।

গুগল ছাড়া অন্যান্য যে সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে যেমন বিঞ্জ, বইদু ইত্যাদিদের এখন শিয়রে শমন। বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির জগতে চ্যাট-জিপিটি সুনামি নিয়ে এসেছে।
এই চ্যাটবটটিতে রয়েছে তিনশ বিলিয়ন শব্দের ভাণ্ডার। ব্যবহারকারী চ্যাট-জিপিটিতে গিয়ে যখন কোনও প্রশ্ন করছে তখন এটি সবসময় নির্ভুল উত্তর দেবে। উত্তরটির কোনও অংশ সঠিক বা পরিমার্জিত করার প্রয়োজন হলে এটি সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিষয়টি সিস্টেমে রেকর্ড করে নেয়, ফলে এটির জ্ঞানের ভাণ্ডার ক্রমশ নির্ভুলভাবে বাড়তে থাকে।
এবার একটি মজার তথ্য দিই। এই বছর প্রায় ৪০% মার্কিন পুরুষ তাঁদের প্রেমাস্পদের জন্য ভ্যালেনটাইন নোট এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। এর ফলাফল কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো! সেই সমস্ত পুরুষের প্রেমিকারা এইরকম প্রেমপত্র পেয়ে রীতিমতো খুশি! প্রাপকদের সিংহভাগ বুঝতেই পারেননি এই নোট কোনও যন্ত্র লিখেছে…অর্থাৎ ঝোল রান্না থেকে ঝিনচ্যাক ড্যান্স, সবেরই ত্রাণকর্তা চ্যাট-জিপিটি।

এতদূর পর্যন্ত পড়ে আপনারা ভাবছেন, দারুণ মজা! এখন থেকে যন্ত্র সমস্ত যন্ত্রণার অবসান করবে। এবার কিন্তু এই প্রবন্ধের লেখক এই অ্যাপের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে আপনাকে ওয়াকিবহাল করবে।
চ্যাট-জিপিটিতে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য সংরক্ষিত আছে, অর্থাৎ এটি ওই সময়ের পরের কোনও তথ্য দিতে বা সেই তথ্য কাজে লাগাতে অপারগ।
গুগল বা তার সমসাময়িক সার্চ ইঞ্জিনে কোনও তথ্য চাওয়া হলে সেটি বেশ কিছু বিভাগে উত্তর দেয়। অর্থাৎ, গুগলে ‘সুকুমার রায়’ নাম লিখে সার্চ বাটনে ক্লিক করলে ছবি, ভিডিও, ম্যাপ, খবর, বই ইত্যাদি বেশ কিছু বিভাগে উত্তর থাকে। কিন্তু চ্যাট-জিপিটিতে প্রশ্ন যেমন নির্দিষ্ট থাকে, তেমনই উত্তর আসে চ্যাটের মতোই টেক্সট ফর্মে। সেখানে আলাদা করে কোনও বিভাগের অবকাশ থাকে না।
এই অত্যাধুনিক অ্যাপটি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু বিষয় লিখে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে,। কিন্তু সাহিত্যে ‘নগ্ন’ কোথায় বসবে আর ‘নিরাবরণ’ শব্দটি কোন লেখায় লিখলে যথাযথ হয়, সেই ধারণা চ্যাট-জিপিটির নেই। এটি শুধুমাত্র নির্ভুল বাক্যগঠন করতে পারে, যা ব্যাকরণগত দিক থেকে সঠিক, কিন্তু সেই লেখায় আবেগ, সৃজনশীলতা বা সাহিত্যগুণাবলীর পরিমাণ খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হতে হবে। চ্যাট-জিপিটি দিয়ে কাব্য বা গদ্য লেখালে সেটি এমন একটি হৃদয়ের জন্ম দেবে যেখানে স্পন্দন আছে, কিন্তু প্রেম নেই। রবিঠাকুরের ভাষায় “যদি প্রেম দিলে না প্রাণে…”
গুগল বা তার সমসাময়িক সার্চ ইঞ্জিনে কোনও তথ্য চাওয়া হলে সেটি বেশ কিছু বিভাগে উত্তর দেয়। অর্থাৎ, গুগলে ‘সুকুমার রায়’ নাম লিখে সার্চ বাটনে ক্লিক করলে ছবি, ভিডিও, ম্যাপ, খবর, বই ইত্যাদি বেশ কিছু বিভাগে উত্তর থাকে। কিন্তু চ্যাট-জিপিটিতে প্রশ্ন যেমন নির্দিষ্ট থাকে, তেমনই উত্তর আসে চ্যাটের মতোই টেক্সট ফর্মে।
চ্যাট-জিপিটির আরও উন্নত ভার্সান ভবিষ্যতে আসবে এবং তা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে, তা কখনোই মানবিক হয়ে উঠতে পারবে না। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নাম দেওয়া হয়েছে এটিকে। এই যন্ত্র হৃদয়ের ভাষা বোঝে না। কোনও একটি সাহিত্যকর্মে ঠিক কতটা হাসির উপাদান দিলে তা প্রহসন হবে আর সেটিতে কী কী লিখলে সেটি রম্যরচনা হয়ে উঠবে সেই বোধ শুধুমাত্র মানুষের আছে, যন্ত্রের নয়। এটি রবিঠাকুরের মতো আর একটি প্যারালাল ‘গীতাঞ্জলি’ কখনোই লিখতে পারবে না। এটি ফার্স্ট পারসনে বর্ণিত ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো স্বতন্ত্র ভাবতে অক্ষম। এটি রে ব্রাডবেরি, স্টিফেন কিং, রিচার্ড ম্যাথেসনদের সৃষ্টির মতো সায়েন্স ফিকশন, হরর ঘরানার জন্য গা শিরশিরে আনক্যানি হরর স্টোরি সৃষ্টি করতে পারবে না। গুলজ়ার, গ়ালিবের কালজয়ী শায়েরি বা গানের কলি লেখার জন্য মানবিক হৃদয়ের উন্মেষ প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক্ষেত্রে ব্রাত্য।
চ্যাটজিপিটি সবসময় দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারবে, কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে যে দুধও হয় — তা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুদ্ধির বাইরে। চ্যাট-জিপিটির চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তি কতদিনে মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠবে সে হিসাব ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। ততদিন বরং ভরসা থাকুক মানুষের আবেগের ওপর, মননশীলতার ওপর এবং মানুষের মানসিকতার ওপর।
অনুভা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকরি করেন। লেখালেখি প্যাশন। সানন্দা ব্লগ, শুকতারা, এখন ডুয়ার্স, অপার বাংলা, প্রসাদ-সহ প্রচুর পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজ়িন, ওয়েবজিন ও সংবাদপত্রে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছেন ছোটদের জন্য লিখে। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০-তে, অমিয়া ভৌমিক স্বর্ণকলম পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১-এর বিচারক ও সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
One Response
পড়লাম, খুব সুন্দর লিখেছ তুমি অনুভা!!!