নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের বাল্যবিধবা নৃত্যকালীর দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরে তাঁকে ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন এক শুভার্থী আত্মীয়। শিবনাথ দম্পতি তাঁকে কন্যাসম যত্নেই মানুষ করেছিলেন এবং শ্রীহট্টের হাবিবগঞ্জ থেকে কলকাতায় আসা সুশিক্ষিত উজ্জ্বল তরুণ বিপিন চন্দ্র পালের (Bipin Chandra Pal) (১৮৫৮-১৯৩২) সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। বিপিন পাল ততদিনে কলেজ শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আর্থিক সাহায্যে স্থাপিত এই লাইব্রেরিই পরে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি এবং স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল লাইব্রেরি (National Library of India) হয়ে উঠবে। এখানেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রীর (Shivanath Shastri) মতো বিশিষ্ট গুণীজনের সঙ্গে বিপিনবাবুর পরিচয়। বোম্বাইতে নিয়ে গিয়ে নৃত্যকালীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগেই শিবনাথ শাস্ত্রী অবশ্য তাঁর প্রিয়পাত্রটিকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন এবং সেই ‘অপরাধে’ ছেলে বিপিনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তাঁর বাবা সিলেটবাসী ফারসি-পণ্ডিত রামচন্দ্র পাল।
কিন্তু পরপর তিন মেয়ে, তারপর ছেলে নিরঞ্জনের জন্ম দেওয়ার পর থেকেই প্রবল উদ্যমী এবং ব্রাহ্ম সমাজে অতি জনপ্রিয় নৃত্যকালী পড়লেন অসুস্থ হয়ে। বছর দেড়েক রোগভোগের পর মারা গেলেন তিনি। সেই থেকে বিপিন চন্দ্র পালের আর সংসারে মন নেই। কিছুদিন পর চার শিশু সন্তানের ভার স্বজন এবং প্রতিবেশীদের ওপর ছেড়ে তিনি বিবাগী হলেন। ফিরলেন মাস ছয়েক পর, বিয়ে করলেন বিরাজমোহিনীকে; তাঁকেও চারটি সন্তান উপহার দিয়েছিলেন বিপিন পাল। ইতিমধ্যে তিনি ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি ছেড়ে পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা এবং সম্পাদনায় মনোযোগী হয়েছেন এবং অবিভক্ত বাংলার নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে কুসংস্কার-বিরোধী ব্রাহ্ম সমাজের ধ্যান-ধারণা প্রচার করে চলেছেন।

নিরঞ্জন (Niranjan Pal) তখন মানুষ হচ্ছেন তিন দিদির তত্ত্বাবধানে। পাছে লোকে দুর্নাম করে, তাই বিরাজমোহিনী তাঁর সতীনের ছেলেকে শাসন করতে কুণ্ঠা বোধ করেন। দিদিরাও হিমশিম ছোট ভাইকে সামলাতে। দুরন্ত এবং অবাধ্য নিরঞ্জনকে দিদিরা নিয়মিতই ভয় দেখায়, দুদিন পরে তো ইশকুলে যেতে হবে নানু, সেখানে কথা না শুনলেই মাস্টার বেত দিয়ে পেটাবে। শুনতে শুনতে নিরঞ্জনের মাথায় ঢুকে যায়, ইশকুল, মাস্টার আর বেত– তিনটেই বেশ ভয়াবহ জিনিস। এসবের থেকে দূরে থাকাই ভালো!
বছর আষ্টেক বয়স হতে নানু অর্থাৎ নিরঞ্জনকে ভর্তি করা হল মির্জাপুর স্ট্রিটের ক্যালকাটা সিটি স্কুলে। নানুর অবশ্য সেটা মোটেই পছন্দ হল না। সত্যিই মাস্টারমশাই ক্লাসে ঢুকে আগে তাঁর হাতের বেতটি টেবিলে রাখেন! তারপর তিনি যা বলেন সেটাই সকলকে বলতে হয়। যদিও সে সব কথার কোনও মানেই বুঝতে পারে না বালক নিরঞ্জন, কারণ বেশিরভাগ কথাই তার কানে পৌঁছয় না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে টেবিলে রাখা ওই বেতের দিকে। মনে মনে চায় ছুটে পালাতে, কিন্তু সে চেষ্টা করতে গিয়ে দারোয়ানের কাছে ধরা পড়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। বাড়ির যে কাজের লোকটি তাকে পৌঁছে দিয়ে যায়, একদিন স্কুলে ঢোকার একটু আগে তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা পরিচিত একজনের। কাজের লোককে নানু নিশ্চিত করল, এখান থেকে সে একাই স্কুলে চলে যেতে পারবে। বলেই নানু তার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে দাঁড়াল রাস্তার উল্টো দিকে। সেদিকে কাজের লোকের নজর নেই দেখে নানু হাঁটতে শুরু করল শেয়ালদা স্টেশনের দিকে। অল্প দূরত্বের পথ, স্টেশনে পৌঁছেই নানু দেখে ট্রেন আসছে, লোক নামছে। অন্য কোনও ট্রেনে লোক উঠছে, স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেই ট্রেন।

মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতেই থাকে নানু, যতক্ষণ না তার চোখে পড়ে স্টেশনের ঘড়িতে চারটে বাজতে চলল। সে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে আসে, বাড়ির লোক নিশ্চিত হয় এখন থেকে নানু একাই স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে। পরের দিন ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা নানু সোজা চলল শেয়ালদা। কয়েক দিন দেখার পর নানুর ইচ্ছে হয়, ট্রেনে চড়ে একটু ঘুরে আসার। কিন্তু ট্রেনের কাছাকাছি হতেই এক টিকিট পরীক্ষক তার কাছে টিকিট দেখতে চান। টিকিট তো নেই, অকপট সারল্যে নানু জানায় তাকে। চেকারের পরের প্রশ্ন, বাবার নাম কী?
সেটা তো বলা যাবে না, কারণ বাবাকে সব্বাই চেনে! বাবার নাম বললেই সোজা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সব বলে দেবে। অধৈর্য টিকিট চেকার বলে ওঠেন, আমাকে বলবে না? বেশ তাহলে পুলিশ ডাকছি, যা বলার পুলিশকেই বোলো। বলে, অন্য একদল যাত্রীর টিকিট দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আর সেই সুযোগে নিরঞ্জন ধাঁ।
এদিকে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে স্থাপিত ক্যালকাটা সিটি স্কুলের হেডেমাস্টার উমেশ চন্দ্র দত্ত বিপিনবাবুর বিশিষ্ট বন্ধু। তিনি চিঠি দিলেন, নিরঞ্জন স্কুলে আসা বন্ধ করেছে কেন? সে কি অসুস্থ? চিঠি পড়ে বিপিনবাবু ছেলেকে ডেকে তাঁর সামনে বসতে বললেন।
– তুমি স্কুলে যাও না?
– না।
– কেন?
– স্কুল একটা জেলখানা।
– স্কুলে না গিয়ে সারা দিন করো কী?
– শেয়ালদায় যাই, ট্রেন দেখি।
তাঁর মতো সত্যনিষ্ঠ, নিয়মানুবর্তী মানুষের ছেলে স্কুল পালিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়, এটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না বিপিন পাল। বদরাগীও ছিলেন খানিকটা। নানুকে সেদিন এক প্রস্থ উত্তম মধ্যম ধোলাই দিয়েছিলেন বিপিনবাবু।

ট্রেনে চড়ে পালানোর স্বপ্ন তবু নানুর মন থেকে মোছে না। ভাবতে থাকে, টিকিট কাটার টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়! বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না, সেই সুযোগও এসে গেল। জন্মের পর থেকে নানুকে দেখতে আসতে পারেননি তার এক বর্ধমানের পিসি। তিনি এলেন, মুখ দেখে অনেক আদর করলেন এবং নানুর হাতে ধরালেন চকচকে দুটি টাকা!
পরের দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর শেয়ালদা নয়, উল্টোদিকে হাওড়া স্টেশনের পথ ধরল নানু, কারণ সে শুনেছে দূরে যাওয়ার সব ট্রেন ছাড়ে হাওড়া স্টেশন থেকে। লাইন দিয়ে কাউন্টারে পৌঁছে একটা টাকা বাড়িয়ে দিতেই প্রশ্ন, কোথাকার টিকিট?
এ প্রশ্নের উত্তর তো সে তৈরি করে আসেনি! কোনও জায়গারই নাম বলতে পারছে না সে, হঠাৎ মনে পড়ল, বর্ধমান। পিসি তো এসেছে বর্ধমান থেকে! বর্ধমানের টিকিটের সঙ্গে ফেরত পাওয়া গেল বেশ কিছু পয়সাও। মহানন্দে ট্রেনে ওঠে নানু, ট্রেন ছাড়ে, অবাক হয়ে জানলা দিয়ে সে দেখতে থাকে, দেখতেই থাকে পিছন দিকে দৌড়ে যাওয়া দৃশ্যপট। ট্রেন মাঝে মাঝে থামে, কিছু লোক ওঠে, নামেও কেউ কেউ, ট্রেন আবার দৌড়য়।
ট্রেনে চড়ে পালানোর স্বপ্ন তবু নানুর মন থেকে মোছে না। ভাবতে থাকে, টিকিট কাটার টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়! বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না, সেই সুযোগও এসে গেল। জন্মের পর থেকে নানুকে দেখতে আসতে পারেননি তার এক বর্ধমানের পিসি। তিনি এলেন, মুখ দেখে অনেক আদর করলেন এবং নানুর হাতে ধরালেন চকচকে দুটি টাকা!
একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই নানু দেখে, প্রায় সবাই হুড়মুড়িয়ে নেমে যাচ্ছে! বর্ধমান তো আসেনি এখনও, সবাই নেমে গেল কেন? এক সহযাত্রীকে প্রশ্ন করে নানু জানতে পারে, এ হল শ্রীরামপুর। এখানকার মাহেশে এখন রথের মেলা চলছে, সবাই যাচ্ছে সেই মেলায়। মেলার নাম শুনেই নানুও নেমে পড়ে তৎক্ষণাৎ এবং খাওয়া আর শোওয়ার অবাধ আয়োজন পেয়ে দিন তিনেক সেই মেলার মাঠেই কাটিয়ে দেয়। মেলা শেষ হতেই নানুকে বার করে দেওয়া হয় সেই মেলার মাঠ থেকে। খানিকক্ষণ পরে খিদে পেতেই নানু বোঝে, এবার আর বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তখনও হাতে থাকা পয়সায় ফিরতি টিকিট কিনে নানু হাওড়ায় এসে নামে। কিন্তু এবার চিন্তা, বাড়ি গিয়ে সে বলবেটা কী! বাড়ির যত কাছাকাছি পৌঁছয় নানু, ততই চিন্তা বাড়তে থাকে।
পাড়ায় ঢুকতেই নানু দেখে সবাই অবাক, কেউ কেউ ছুটে গেল তার বাড়ির দিকে। খবর পেয়েই উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলেন বিপিন চন্দ্র পাল, নানুকে বুকে জড়িয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় চলে গিয়েছিলি? গলায় যথেষ্ট নাটকীয়তা এনে নানু শুধু বলল, রক্ত… রক্ত…। ততক্ষণে তার চোখ গোল গোল ঘুরছে।
নানুকে আর বিশেষ কিছু বলতে হল না। সকলে সাব্যস্ত করলেন, নিশ্চয়ই কোনও কাপালিক তুলে নিয়ে গিয়েছিল! কিন্তু বাবার বিচলিত অবস্থা দেখে নানুর মনে হল, তাঁর কাছে সত্যিটা খুলে বলাই ভালো। সব শুনে বিপিনবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, নানুকে আর স্কুলে যেতে হবে না। সে বাড়িতেই পড়াশোনা শিখবে এবং তিনি নিজে যখন যেখানে যাবেন, সঙ্গে নানুকেও নিয়ে যাবেন। নানুর ভ্রমণের শখ তাতে অনেকটা মিটছিল, কিন্তু ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ অ্যান্ড ফরেন ইউনিটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের স্কলারশিপ নিয়ে বিপিন পাল গেলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউ ম্যাঞ্চেস্টার কলেজ। নানুর সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই উঠল না।
[ক্রমশ]
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।