ট্রামের মধ্যে ছিনিয়ে নেওয়া এক জাতিবিদ্বেষী ইউরোপীয়ের রিভলভার নিরঞ্জনের থেকে নিয়ে সেদিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন যিনি, সেই উল্লাসকর দত্ত তখন যুগান্তর দলের সদস্য এবং অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কয়েক দিন পর এক সন্ধেয় দুই বন্ধুর সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়ে উল্লাসকর রিভলভার সমেত ধরা পড়েন এবং আলিপুর বোমা মামলার অভিযুক্ত হিসেবে তিন বন্ধুই অভিযুক্ত হন। নিরঞ্জনেরও সেই সন্ধেয় তাঁদের সঙ্গে নাটক দেখতে যাওয়ার কথা, টিকিটের টাকা জোগাড় করে উঠতে পারেননি বলেই যাওয়া হয়নি। নিরঞ্জনের বন্ধুই শুধু নন উল্লাসকর, দুজনের পরিবারের মধ্যে সম্পর্কও বেশ নিবিড়। তাই উল্লাসকর গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুরো রিভলভার কাণ্ড আর গোপন রইল না বিপিন পালের কাছে। তিনি বুঝলেন, যে খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছে, পুলিসের কাছে তা পৌঁছতে বিশেষ সময় লাগবে না। বিপ্লবীদের সঙ্গে ছেলের মেলামেশা মোটেই ভাল লাগছিল না তাঁর, এখন ছেলের কারাবাসের সম্ভাবনায় আরও বিচিলিত হয়ে পড়লেন তিনি। এরই মধ্যে বিচারে উল্লাসকর দত্তর (Ullaskar Datta) ফাঁসির আদেশ হল এবং আপিলের পর তাঁর শাস্তি হল দ্বীপান্তর।
ঠিক এই সময়েই ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে লন্ডনে প্রচার করার জন্য পণ্ডিত শ্যামজি কৃষ্ণভার্মার (Shyamji Krishna Varma) আমন্ত্রণ এল বিপিন পালের কাছে। ইউরোপে ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের অগ্নিপুরুষ শ্যামজি নিজে অবশ্য তখন লন্ডন ছেড়ে প্যারিসে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং প্যারিস থেকেই তিনি চালান তাঁর তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধী পত্রিকা ‘দ্য ইন্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট’ (The Indian Sociologist magazine)। শ্যামজি চান, বিপিনবাবু নিয়মিত লিখে এবং বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে লন্ডনে পড়তে যাওয়া ভারতীয় ছাত্র এবং আগ্রহী ইউরোপীয়দের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করুন এবং স্বাধীনতার দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করুন। বিপিন পাল সানন্দে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং সবাইকে চমকে দিয়ে ঘোষণা করলেন, ছেলে নিরঞ্জনও এ যাত্রায় তাঁর সঙ্গে যাবে (Niranjan Pal in London)।

স্কুলে যায় না, পড়াশোনায় কোনও আগ্রহই নেই, তাকে নিয়ে লন্ডন? ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাই আপত্তি তুলেছিলেন। কী করবে নানু সেখানে গিয়ে? মদ-সিগারেট খেতে শিখে আরও বড় আপদ হয়ে ওঠা ছাড়া! বিপিন পাল গম্ভীর হয়ে বললেন, এক স্কটম্যানের রিভলভার কেড়ে নেওয়া দিয়ে শুরু করেছে। এরপর এই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলে আরও যে সব কাণ্ড করবে তাতে তো জেলে পচে মরতে হবে। সেইজন্যেই ওকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া দরকার।
শেষ পর্যন্ত খিদিরপুর ডক থেকে লন্ডনগামী জাহাজ এস এস গোলকোণ্ডার ফার্স্ট ক্লাসে নিরঞ্জন (Niranjan Pal) ছাড়াও বিপিন পালের সহযাত্রী হলেন আরও দু-জন। প্রথম জন ডাক্তার সুন্দরী মোহন দাসের বড় ছেলে প্রেমানন্দ, যে বৃত্তি নিয়ে কেমিস্ট্রি পড়তে যাচ্ছে আমেরিকায়। দ্বিতীয় জন উল্লাসকর দত্তর ভাই সুখসাগর (Sukhsagar Datta), যার বাবাও বিপ্লবীদের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন লন্ডন।
লন্ডনে পৌঁছতেই চারিং ক্রস স্টেশনে ‘বিপিন পাল জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর (Savarkar) ও তাঁর অনুগামীরা। সাভারকর তখন শ্যামজি কৃষ্ণভার্মার অনুদানে শিবাজি স্কলারশিপ নিয়ে গ্রেজ ইনে আইন পড়ছেন এবং থাকেন শ্যামজিরই ইন্ডিয়া হাউসে (India House)। শুধু থাকেনই না, শ্যামজি লন্ডন ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তিনিই ইন্ডিয়া হাউস চালানোর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এই ইন্ডিয়া হাউসকে কিন্তু লন্ডনের কারলিউ স্ট্রিটে এখনকার ভারতীয় দূতাবাস ইন্ডিয়া হাউসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। শ্যামজির চালু করা ৬৫ নম্বর ক্রমওয়েল অ্যাভিনিউয়ের এই ছাত্রাবাসে এক পাউন্ডে সারা সপ্তাহের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। শ্যামজি আবার কিছু কিছু ছাত্রের জলপানির ব্যবস্থাও করেন। প্রতি রবিবার ইন্ডিয়া হাউসে ভারতের ভবিষ্যৎ, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যে সভা ডাকেন সাভারকর। আলোচনা অবশ্য নামেই, আসলে বক্তা তিনি একাই। উদ্দেশ্য, যে শ-চারেক ভারতীয় ছাত্র তখন লন্ডনে থেকে পড়াশোনা করছেন তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, স্বরাজের ভাবনায় তাদের প্রাণিত করা, পারলে দলে টানা এবং সশস্ত্র আন্দোলনই যে স্বাধীনতার একমাত্র পথ সে কথা বোঝানো। তখনকার ভারতীয় ছাত্ররা প্রায় সকলেই সাভারকরের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, দুই বিশিষ্ট ব্যতিক্রম শুধু কেমব্রিজের ছাত্র জওহরলাল নেহরু (Jawaharlal Nehru) এবং এফআরসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া বিধান চন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy)।

বিপিন পাল তখনও সাভারকরের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিলেন না। তিনি নিজে উঠলেন সিনক্লেয়ার রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে, কিন্তু ইন্ডিয়া হাউসে নিরঞ্জন আর সুখসাগরের থাকার ব্যবস্থা মেনে নিলেন। দুই তরুণ ভারতীয়কে হাতে পেয়ে মোটেই সময় নষ্ট করেননি সাভারকর। আইরিশ বিপ্লবীদের কাছ থেকে পাওয়া বোমা বানানোর এক অত্যন্ত কার্যকরী ফর্মুলা সাইক্লোস্টাইল করে ডাকে চেনাশোনা সমস্ত বিপ্লবীদের ঠিকানায় পাঠনোর কাজ দেওয়া হল নিরঞ্জনকে। নিরঞ্জনও নিষ্ঠা ভরে সে কাজ শুরু করে দিলেন। নিরঞ্জন তখন সাভারকরের অতি অনুগত ভক্ত।
কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য স্বাধীনতা অর্জনে সাভারকরের পথ সম্পর্কে বিশদে খবর পেতে থাকলেন বিপিন পাল। কংগ্রেসের ‘চরমপন্থী’ নেতা হিসেবে তাঁর যাবতীয় পরিচিতি সত্ত্বেও আদতে তিনি অহিংস আন্দোলনের পথিক। পরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যখন কংগ্রেসের দিকদর্শক হয়ে উঠবেন, তাঁর সঙ্গেও বিভিন্ন বিষয়ে বিপিনবাবুর তীব্র মতান্তর ঘটবে। কিন্তু সাভারকরের বোমা-বন্দুক এবং হত্যার রাজনীতির সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য তো একেবারে মৌলিক। তাছাড়া, যে বিপ্লবী রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ছেলেকে তিনি সঙ্গে নিয়ে এলেন, লন্ডনে এসে সেই রাজনীতিরই একেবারে আঁতুড়ঘরে ছেলেকে কিনা পৌঁছে দিয়ছেন তিনি!
শেষ পর্যন্ত খিদিরপুর ডক থেকে লন্ডনগামী জাহাজ এস এস গোলকোণ্ডার ফার্স্ট ক্লাসে নিরঞ্জন (Niranjan Pal) ছাড়াও বিপিন পালের সহযাত্রী হলেন আরও দু-জন। প্রথম জন ডাক্তার সুন্দরী মোহন দাসের বড় ছেলে প্রেমানন্দ, যে বৃত্তি নিয়ে কেমিস্ট্রি পড়তে যাচ্ছে আমেরিকায়। দ্বিতীয় জন উল্লাসকর দত্তর ভাই সুখসাগর (Sukhsagar Datta), যার বাবাও বিপ্লবীদের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন লন্ডন।
উদভ্রান্তের মতো বিপিনবাবু ছুটলেন ইন্ডিয়া হাউসে। নিরঞ্জনকে ডেকে বললেন, ভেবে দেখেছিস, কোন পথে চলেছিস? স্বাধীনতার নয়, এটা মরণের পথ। এই খুনোখুনির রাজনীতির রাস্তায় আমি তোকে যেতে দিতে পারি না। এখনই এই জায়গা ছেড়ে চল আমার সঙ্গে।
নিরঞ্জন সে কথা কানেও তুললেন না। বললেন, আমি বুঝেছি, দেশের স্বাধীনতা শুধু এই পথেই আসতে পারে। এটাই একমাত্র পথ। ঠিক করে নিয়েছি, আমি এই পথেই চলব। দেশের জন্যে যদি মরতেও হয়, তাতে দুঃখ নেই। বিস্মিত, বিপন্ন বিপিন পাল (Bipin Chandra Pal) কোনওমতে বললেন, আমি তোর বাবা। আমি বারণ করছি। আমার কাছে রেখে তোকে ঠিক পথে নিয়ে যেতে চাইছি। তুই আমার কথা শুনবি না!
বাবার চোখে চোখ রেখে একরোখা নিরঞ্জন উত্তর দিলেন, তোমার বাবাও তো তোমাকে ব্রাহ্ম হতে নিষেধ করেছিলেন। অনুনয় করেছিলেন, ভয় দেখিয়েছিলেন। তুমিও তো তাঁর কথা শোননি। বাগ্মী বিপিন পাল বাকরুদ্ধ হয়ে ইন্ডিয়া হাউস থেকে ফিরে গেলেন সিনক্লেয়ার রোডের বাড়িতে। তারপর থেকে বাবা-ছেলের সম্পর্ক স্তব্ধ। একদিন হঠাৎই নিরঞ্জন খবর পেলেন, বিপিন পাল অসুস্থ, কোথাও যাচ্ছেন না। যোগাযোগ করলেন, বাবার সেক্রেটারি ইভার সঙ্গে। শুনলেন, সেদিন ফিরে আসার পর থেকে বিপিন পাল আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছেন। এখন অসুস্থ, সম্পূর্ণ ঘরবন্দী হয়ে থাকেন, ডাক্তারও দেখাবেন না।
ইন্ডিয়া হাউস থেকে তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে বাবার কাছে ফিরে গেলেন নিরঞ্জন। বিপিন পাল তাঁকে বললেন, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার কিংস কলেজে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্যে তৈরি হও।
এন্ট্রান্সের জন্যে তৈরি হতে শুরু করলেন বটে নিরঞ্জন, কিন্তু ইন্ডিয়া হাউস বা সাভারকরের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে নয়। গোপনে সাভারকরের সঙ্গে যোগাযোগ দিব্যি বহাল রেখে গেলেন নিরঞ্জন। সাভারকর তখন এক ব্রিটিশ রাজপুরুষের হত্যা পরিকল্পনায় মগ্ন। নিরঞ্জনকে সেই পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন তিনি।
[ক্রমশ]
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।