১৯৪১ সালে পৃথিবীর বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানিগুলোর একটি ছিল জার্মানির আইজি ফারবেন। এখন যে ওষুধ কোম্পানিগুলোর নাম বিশ্বসুদ্ধ প্রায় সব শিক্ষিত মানুষই জানে – যেমন, বেয়ার, হেক্সট ইত্যাদি – এরকম ৬টি কোম্পানি নিয়ে তৈরি হয়েছিল বহুজাতিক আইজি ফারবেন – একইসঙ্গে ওষুধ এবং রাসায়নিক তৈরির সংস্থা। ১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকে যখন ধীরে ধীরে জার্মানির ভাগ্য ও ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক হিসেবে হিটলারের উত্থান ঘটছে, সেসময়ে হিটলারের নির্বাচনী প্রচারে অর্থের সবচেয়ে বৃহৎ জোগানদার ছিল এই কোম্পানি। যে বছর হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন অর্থাৎ ১৯৩৩-এ আইজি ফারবেন ব্যক্তিগতভাবে হিটলারকে এবং তাঁর নাৎসি পার্টিকে ৪০০,০০০ মার্ক অর্থ সাহায্য করে। পরের বছর ১৯৩৪-এ হিটলার ফুয়েরার হবার পরে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।
আউশভিৎস জার্মানির সবচেয়ে বড়, কুখ্যাত এবং আতঙ্কজনক কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। আইজি ফারবেন-এর গোড়ার দিকের উদ্দেশ্য ছিল ওখানে একটি দানবাকৃতি আইজি ফারবেন কমপ্লেক্স তৈরি করার যেখানে ইউরোপ এবং বিশ্বকে অধিকারের যে পরিকল্পনা হিটলারের রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সিন্থেটিক পেট্রল এবং রবারের উৎপাদন করা যাতে যুদ্ধ চলাকালীন কোনও সময়েই এ দুটির অভাব না ঘটে। এবং এ কোম্পানিটির গুরুত্ব এতটাই ছিল যে শুধুমাত্র এজন্যই আইজি ফারবেন-আউশভিৎস শাখাও তৈরি হয়।
তো এ হেন আইজি ফারবেনের ম্যানেজার অটো অ্যামব্রস এবং আউশভিৎসের কমান্ডারের মধ্যে ১৯৪২ সালে যেসব বার্তার বিনিময় হয়েছিল তাতে যে কোন সুস্থ মানুষের গা ঘুলিয়ে উঠবে। আমি সংক্ষিপ্ত আকারে রাখছি –
“আমাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য যে নতুন ওষুধ বেরিয়েছে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যদি আপনারা কিছু সংখ্যক বন্দী সরবরাহ করতে পারেন আমরা সেটা বিশেষভাবে করে মনে রাখব।”
“আমরা আপনাদের উত্তরে ইতিবাচক অবস্থান জানাচ্ছি। কিন্তু এক একজন মহিলা বন্দীর জন্য ২০০ মার্ক আমাদের কাছে অতি বেশি মনে হচ্ছে। আমরা প্রস্তাব রাখছি মহিলাদের দাম ১৭০ মার্কের বেশি করা সম্ভব নয়। যদি এটা আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে মহিলাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। আমাদের মোটামুটি ১৫০ জন মহিলা প্রয়োজন।”
“আমাদের মধ্যে যে চুক্তি হল সেটা আমরা নিশ্চিত করছি। আমাদের জন্য যতটা সম্ভব সুস্থ দেহের ১৫০ জন মহিলা তৈরি রাখুন।”
“১৫০ জন মহিলাকে আমরা পেয়েছি। তাদের ক্ষতবিক্ষত (macerated) অবস্থা সত্ত্বেও এদেরকে পরীক্ষার জন্য সন্তোষ জনক বলেই মনে হচ্ছে।”
“পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হয়েছে। যাদের ওপরে পরীক্ষা করা হয়েছে তারা সবাই মারা গেছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে শিগগিরই নতুন সাপ্লাই-এর জন্য যোগাযোগ করব।”
ঘুমের নতুন ওষুধ ছাড়াও আউশভিৎসের সাথে আইজি ফারবেনের আরেকটি স্বার্থ যুক্ত ছিল। সেসময়ে কীটনাশক হিসেবে জাইক্লোন বি মতান্তরে সাইক্লোন বি তথা সায়ানাইডযুক্ত অতি বিষাক্ত এক রাসায়নিক যৌগের পরীক্ষা চলছে। এটাই পরে গ্যাস চেম্বারের গ্যাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে গ্যাসের ব্যবহারিক ক্ষমতা সম্পর্কে হাতেকলমে ফলাফল জানার জন্যও আউশভিৎসের প্রয়োজন ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন জাইক্লোন বি-র আগে ১৯৩৬ সালে “টাবুন” নামে একটি গ্যাস (রাসায়নিক নাম – ইথাইল ডাইমিথাইলঅ্যামিডোসায়ানোফসফেট) তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৩৮-এ আবিষ্কৃত হল “সারিন” নামে আরেকটি বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস যার রাসায়নিক নাম – আইসোপ্রোপিল মিথেনফ্লুরোফসফোনেট। ১৯৪৪ সালে তৈরি হয়েছিল “সোমান” (রাসায়নিক নাম – পিনাকোলিল মিথাইলফসফোনোফ্লুরিডেট)। ১৯৪৪ সালেই আবিষ্কৃত আর একটি মারাত্মক গ্যাস ফসজিন (কার্বোনিল ডাইক্লোরাইড) ৪০ জন বন্দীর ওপরে প্রয়োগ করে দেখা হয়। এর ফলে অন্তত ৪ জন বন্দী ফুসফুসে জল জমে যাবার ফলে মারা যায়। এক শিউরে ওঠা বিবরণ পাওয়া যায়। “বন্দীদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল ৩০ মিনিট গ্যাস চেম্বারে থাকতে। দশ মিনিট পরে ক্যাম্পের কমান্ডার দুজন বন্দীর ফুসফুস ফেটে যাওয়ার শব্দ (হাততালি দেবার মতো) শুনতে পায়। ওদের মুখ, নাক এবং কান দিয়ে দিয়ে গলগল করে বাদামি ফেনা বেরিয়ে আসছিল।”
সমসাময়িক কালে, ১৯৩৭ থেকে, জাপান রাসায়নিক যুদ্ধের জন্য বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস তৈরি করতে শুরু করে এবং মানুষের শরীরে তার ফলাফল নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়।
১৯৪৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানির পরাজয়ের পরে মানুষের ইতিহাসে তখনও পর্যন্ত জঘন্যতম যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের জন্য নাৎসী সদর দপ্তর নুরেমবার্গ শহরেই বিচার শুরু হয়। মোট ১২টি ট্রায়াল বা বিচার হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমটিই ছিল “নুরেমবার্গ মেডিক্যাল ট্রায়াল” যা শুরু হয়েছিল ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৪৬ এবং শেষ হয় ২০শে আগস্ট, ১৯৪৭।
মানুষের ওপরে যেসব অভাবনীয় পরীক্ষা চালানো হয়েছিল
এখানে যে বিষয়টি পরিস্কারভাবে বোঝা দরকার তা হল নাৎসি জার্মানিতে দু’ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল। একটি ঘটেছিল প্রধানত সামাজিক ক্ষেত্রে – লোকচক্ষুর সামনে, আরেক ধরনের ঘটনা ঘটেছিল লোকচক্ষুর আড়ালে, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে। দ্বিতীয় বিষয়টিই বেশি আলোচিত। কারণ সোভিয়েত মুক্তি ফৌজ ও আমেরিকান বাহিনী ক্যাম্পগুলোর দখল নেবার পরে বীভৎসতার প্রান্তসীমায় পৌঁছনো এবং অত্যাচার সহ্য করেও যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের বয়ান উদ্ধার করে। যদিও ক্যাম্পের কার্যকলাপের প্রায় সমস্ত দলিলই ফ্যাসিস্ট বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে ধ্বংস করে ফেলেছিল, বন্দীদের বয়ানের ভিত্তিতেই এক বছর বাদে বিচার শুরু হয়।
কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল বলার আগে একজন ডাক্তারের নাম আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে। নাম ডঃ জোসেফ মেঙ্গেল। “নাৎসি রেসিয়াল হাইজিন” বা জাতিগত পরিচ্ছন্নতার হিংস্রতম কার্যকলাপ এবং পরীক্ষা চালানোর জন্য এই ডাক্তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং কুখ্যাতি অর্জিন করে। কুখ্যাতি অর্জনের আরেকটা কারণ ছিল আউশভিৎস এবং বির্কেনাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যমজদের ওপরে ভয়ঙ্করতম পরীক্ষা চালানো। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে ইউজেনিক্স বা বিশুদ্ধ আর্য রক্তের মধ্যে প্রজননের উদ্দেশ্যে ৪০০,০০০ জার্মানকে জোর করে নির্বীজকরণ করা হয়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল ইউজেনিক্সের শুরু কিংবা নির্বীজকরণ প্রক্রিয়ার জনক কিন্তু জার্মানি নয়। ১৯০৭ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে মুক্ত গণতন্ত্রের দেশ খোদ আমেরিকাতে ৪০,০০০ আমেরিকাবাসীর নির্বীজকরণ করা হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল মানসিক রোগী এবং সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। মনে রাখতে হবে, রেসিয়াল হাইজিন এবং ইউজেনিক্সের জন্ম এবং বিকাশও আমেরিকায়। পরে নাৎসি জার্মানি এটাকে রাষ্ট্রিকভাবে গ্রহণ করে।
সেসময়ের জার্মানিতে একটি স্কুলপাঠ্য বইয়ের ক্যাপশনসহ ছবি ছিল “তুমিও এ বোঝা বহন করছ। সতর্কবাণী হিসেবে বইয়ে লেখা ছিল – “জন্মগতভাবে অসুস্থ একজন মানুষের জন্য ৬০ বছর বয়সসীমা অবধি এক জার্মান নাগরিককে গড়ে ৫০,০০০ রাইখসমার্ক (মার্ক) বোঝা হিসেবে বহন করতে হয়।”
“অনার্য”-মুক্ত জার্মানি গড়ে তোলার জন্য অন্য জাতের “অশুদ্ধ” রক্তের মানুষদের জন্য সম্পূর্ণ নিঃশেষিকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার প্রধান বলি ছিল – মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, সাইকটিক (বিশেষ করে স্কিৎসোফ্রেনিক বা উন্মাদ), মৃগী রোগী, বার্ধক্যজনিত কারণে অশক্ত এবং বিভিন্ন স্নায়ু রোগে ভোগা মানুষেরা, পার্কিনসনিজমের রোগী, ডাউন্স সিন্ড্রোমের রোগী, কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, জিপসি বা রোমা, ইহুদি এবং অনার্য যেকোন গোত্রের মানুষ। জোসেফ মেঙ্গেল এক্ষেত্রে খুব কার্যকরী এবং দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মূলত যমজ সন্তানদের ওপরে পরীক্ষা চালাতেন। এরকম একটি ছবি দিচ্ছি নীচে। এখানে উল্লেখ করা দরকার মেয়েদের বন্ধ্যাকরণের জন্য জরায়ু এবং গর্ভাশয়ে আয়োডিন, বেরিয়াম ইত্যাদির বিভিন্ন যৌগ সহ নানারকমের হাবিজাবি দিয়ে পরীক্ষা চালানো হত। আউশভিৎস ক্যাম্পে একদিনে ১০০০ নারীকেও বন্ধ্যা করার ইতিহাস আছে।
সকাল ৬টায় শুরু হত যমজদের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা। কী কী করা হত ওদেরকে নিয়ে? (১) জোর করে উলঙ্গ করে ফেলে কয়েক ঘন্টা ধরে ওদের দেহের অ্যানাটমির বিভিন্ন মাপ নেওয়া হত। এ্র থেকে জিনগত পার্থক্য বোঝার চেষ্টা চলতো। (২) এক যমজের দেহের রক্ত আরেকজনের দেহে দেওয়া হত ব্লাড গ্রুপ না মিলিয়েই। এর ফলে প্রায়ই মৃত্যু ঘটত। (৩) নীল চোখের প্রতিলিপি তৈরির জন্য চোখে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেওয়া হত। এতে চোখের অস্বাভাবিক যন্ত্রণা, এমনকি অন্ধত্বও ঘটত। (৪) বিভিন্ন ধরনের রহস্যজনক ইনজেকশন দেওয়া হত মেরুদন্ডে। শরীরে প্রবেশ করানো হত টাইফাস এবং টিবির জীবাণু। এরপরে এদের মেরে ফেলে শবব্যবচ্ছেদ করা হত – বিভিন্ন দেহযন্ত্রে এইসবের কীরকম প্রভাব পড়ে দেখার জন্য। (৫) অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই অ্যম্পুটেশন, কিডনি বা অন্য দেহাংশ কেটে নেওয়া, খোজা করে দেওয়ার মতো অপারেশনগুলো করা হত। (৬) কোনও কোনও যমজের হৃদপিণ্ড বাইরে থেকে ছুঁচ বিদ্ধ করে ফেনল (কার্বলিক অ্যাসিড) বা ক্লোরোফর্ম ইনজেকশন দেওয়া হত হৃদপিণ্ডে। এতে তৎক্ষণাৎ রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যু হত। এবার ফলাফল দেখার জন্য করা হত শবব্যবচ্ছেদ। (৭) কৃত্রিমভাবে গ্যাংগ্রিন তৈরি করার জন্য হাতে পায়ে শক্ত বাঁধন দেওয়া হত। যমজদের একজন মারা গেলে অন্য জনকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হতো। ১৪ জোড়া যমজকে মেরেছিলেন মেঙ্গেল। সারারাত ধরে তাদের শবব্যবচ্ছেদ করেছিলেন।
রাভেন্সব্রুক কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আর একধরনের পরীক্ষা চলত যাকে বলা হত “হেটেরোপ্লাস্টিক ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন”। গোটা গোটা অঙ্গ, যেমন কাঁধ বা হাত বা পা, জীবন্ত বন্দীদের দেহ থেকে কেটে নেওয়া হত এবং হোহেনলাইচেন-এর SS Hospital-এ পাঠিয়ে দেওয়া হতো অন্য বন্দীর ওপরে ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ব্যর্থ চেষ্টার জন্য। তারপরে সাধারণত অঙ্গহীন হতভাগ্য বন্দীটিকে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হত।
কী নিদারুণ রসিকতা! “চ্যারিটেবল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ফর দ্য সিক” বলে একটি কোম্পানি এই মৃত্যু গহ্বর থেকে দেহ থেকে ছিন্ন শির ডঃ হ্যালারভর্ডেন নামে এক নিউরো-প্যাথলজিস্টের কাছে পৌঁছে দিতো। ডঃ হ্যালারভর্ডেনের ব্যক্তিগত বয়ানে এরকম ৫০০টি ছিন্ন মস্তক পাবার কথা জানা গেছে। এক একবারে ১৫০ থেকে ২৫০টি করে মাথা “চ্যারিটেবল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ফর দ্য সিক” বহন করে নিয়ে যেত।
(পরবর্তী ও শেষ পর্ব আগামীকাল)
পেশায় ডাক্তার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। বর্তমান ঠিকানা রায়গঞ্জ।