(Food Choices)
অন্নদামঙ্গল কাব্যে ঈশ্বরী পাটনি অন্নপূর্ণার কাছে বর চেয়েছিল, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। কোনও রাজভোগ নয়, পরমান্ন নয়, শুধু দুধেভাতে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বুঝদার ছিলেন, তাঁদের সুখের জন্য পাঁচতারা মেনুর দরকার ছিল না, একবাটি গরম ভাত আর দুধেই তাঁরা তৃপ্তি আর নির্ভরতা খুঁজে পেতেন। (Food Choices)
চতুর্দশ শতকের প্রাকৃত পৈঙ্গল গ্রন্থে আরও পেছনে গেলে বাঙালির পেটের আসল ইতিহাস পাওয়া যায় এই পদটিতে:
ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা
মৌইলি মচ্ছা নলিতা গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা(ই) পুনবন্তা।
আরও পড়ুন: রূপলাল হাউস: ভাঙা কার্নিশে হলুদ শাড়ি আর অন্দরে জৌলুশের মরিচা
অর্থাৎ, যে নারী কলাপাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরলা মাছ আর পাটশাক পরিবেশন করে স্বামীকে খাওয়ায়, সেই স্বামী ভাগ্যবান। এই ছিল বাঙালির প্রথম মেনু কার্ড। সরল, স্নিগ্ধ কিন্তু পরিতৃপ্ত। (Food Choices)

তবে শুধু দুধেভাতে তো আর সারাজীবন চলে না। বৈচিত্র্য চাই। সেই বৈচিত্র্যের পথ দেখালেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, কিন্তু রান্নাকে ঘরের কোণে বন্দী রাখেননি। তাঁর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ ছয় খণ্ডের বিশাল গ্রন্থ, যেন বাঙালি রান্নাঘরের বাইবেল। প্রজ্ঞাসুন্দরী বললেন, রান্নার জন্য লাখ টাকা খরচ করতে হয় না। সাধারণ উপকরণেই অসাধারণ খাবার হয়। দুধ থেকে ছানা, ছানা থেকে সন্দেশ। শাকে একটু মশলার খেলা আর তাতেই নতুন স্বাদ। তিনি বাঙালি গৃহিণীদের দেখালেন, রান্না একটা শিল্প। বলা যায় গত শতাব্দীর গোড়ায় বাঙালি খেতে শিখল, আসলে বলা উচিত রান্না শিখল। তারপর থেকে এই একশো বছরে বাঙালির রান্নায় কী ঘটেছে, তার হিসেব রাখা মুশকিল। একশো বছরে বাঙালির থালা বদলেছে, কিন্তু ক্ষুধার ভাষা বদলায়নি। যা পাল্টেছে, তা হল রুচি আর রেসিপি। (Food Choices)
ধনেপাতার কথাই ধরুন। পঞ্চাশ বছর আগেও ধনেপাতা অনেক বাঙালির ব্ল্যাকলিস্টে ছিল। ধনেপাতা নাকি উত্তর ভারতের তরকারিতে দেওয়ার চল ছিল, কিন্তু বাংলায়? ও বাবা, এ কী গন্ধ! ওই গন্ধ বাঙালির নাকে সইবে না বলে অনেকে নাক সিঁটকাত। আর আজ সবখানেই ধনেপাতার জয়, জয়কার। প্রতিটি রান্নারই পরিণতি ধনেপাতায়- ইলিশের ঝোল, খাসির কালিয়া, মুগডাল কিংবা লাউ-চিংড়ি সবশেষে চুলার আগুন নিভে এলে এক চিমটি ধনেপাতা কুচি ঝরে পড়ে তরকারির উপরে, যেন কোনও সুরভিত আশীর্বাদ। উত্তর ভারতের ধনেপাতা আমাদের খাবারে ঢুকে পড়া মানে হল স্বাদের ভৌগোলিক আমদানি। এগুলো কেবল স্বাদ নয়, ঐতিহ্যগত প্রতিরোধ ভেঙে নতুন রুচির আনাগোনা। (Food Choices)

এবার আসি টমেটোর প্রসঙ্গে। মেক্সিকো থেকে পশ্চিমের দেশ হয়ে এসেছিল এই সবজি আমাদের দেশে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কেউ চিনত না। আমাদের ছোটবেলায় নাম ছিল বিলিতি বেগুন। বিলিতি মানেই সন্দেহজনক। শুধু চাটনি বানানো হত, আর কোনও কাজ ছিল না। আর এখন, ঘরের রাঁধুনী হোক কিংবা বিয়ে বাড়ির বাবুর্চি, সবাই যেন এক গোপন শপথ নিয়েছে, প্রতিটি রান্নায় টমেটো দিতে হবে, না হলে টমেটো কেচাপ। এক ধরনের স্বাদের কমিউনিজম চলছে রান্নাঘরে। সব তরকারির রঙ এক, স্বাদও প্রায় এক। টমেটো এখন বাঙালির রন্ধনশালার একনায়ক। আলু দিয়ে পটল? টমেটো দিন। মাছের ঝোল? টমেটো দিন। এমনকি ডাল? হ্যাঁ, তাতেও টমেটো! আমাদের জিভ এখন বোঝেই না- আলু খাচ্ছে না বেগুন, সব কিছুতে টমেটোর একচেটিয়া লাল রাজত্ব। (Food Choices)
“আটার রুটি সম্ভবত এই শতাব্দীর গোড়ায় চুপিচুপি ঘরে ঢুকেছিল। একসময় চালের বাড়ন্ত হওয়াতে অনেক বাড়িতে রুটির চল শুরু হয়েছিল কিন্তু চাল সহজলভ্য হওয়ার পরও রুটির প্রতি বাঙালির ভালোবাসা কমেনি।”
তারপর এল নুডলস, দুই মিনিটে রান্না, যেন ব্যস্ত জীবনের ঠা, ঠা রোদে একপশলা বৃষ্টি। বাঙালির অলসতার যে খ্যাতি ছিল, নুডুলস এসে তাতে সিলমোহর লাগিয়ে দিল। একদিন যে বাঙালি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মাছের ঝোল সিদ্ধ করত, চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখত, সে এখন দুই মিনিটে নুডলস সেদ্ধ করে মনে করে রাঁধুনী জীবনের নির্বাণ পেয়ে গেছে। মিস্টার নুডুলস, মামা, ম্যাগি- নাম পাল্টেছে, কিন্তু মোহ এক। দুপুরে, বিকেলে, রাতে যেকোনও সময়ে নুডলস। বাঙালির হাজার বছরের রান্নার ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে এই জিনিসটা রান্না ঘরের প্রধান অতিথির আসন দখল করে নিয়েছে। (Food Choices)
নুডলস এর মতো রুটিও এখন প্রতিদিনের সঙ্গী। এমন নয় যে আমরা রুটি চিনতাম না। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর বইতে রুটি বানানোর পদ্ধতি আছে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, শরীর খারাপ হলে ডাক্তার রুটি খেতে বলত। বাঙালি, মুখ গোমড়া করে রুটি খেত। ভাত ছাড়া যে পেট ভরে না! বাঙালি চিরকাল ভাতের ভক্ত। আটার রুটি সম্ভবত এই শতাব্দীর গোড়ায় চুপিচুপি ঘরে ঢুকেছিল। একসময় চালের বাড়ন্ত হওয়াতে অনেক বাড়িতে রুটির চল শুরু হয়েছিল কিন্তু চাল সহজলভ্য হওয়ার পরও রুটির প্রতি বাঙালির ভালোবাসা কমেনি। (Food Choices)
বিংশ শতাব্দীর প্রথম আর দ্বিতীয় ভাগের মাঝামাঝি আরেকটা বড় বদল এসেছিল বাঙালির পান খাওয়ার অভ্যাসে। একসময় খাওয়ার শেষে একটা সুগন্ধি পান মুখে না দিলে যেন খাওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সেই পানের আয়োজনও ছিল এক শিল্প। দিদা, ঠাকুমারা খাওয়ার পর বারান্দায় বসতেন, সামনে খোলা পানের ডিবে, চকচকে পিতল বা রুপার। ভিতরে কাঁচা বা পাকা সুপারি, খয়ের, এলাচ, কখনও একটু শুকনো কমলালেবুর খোসা। ধীরে, ধীরে পাতা মেলে, এক এক করে উপকরণ সাজিয়ে, শেষে গুটিয়ে আটকানো, পুরো প্রক্রিয়াটা দেখেও আনন্দ হত। পানও ছিল কত রকমের। বাংলা পান- একটু ঝাল, জিভে কামড় দেয়। মিঠাপান-আলাদা সুগন্ধ আর স্বাদ, যেন মিষ্টির দোকানের গন্ধ। সাঁচি পান- সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা, অভিজাত। তারপর এল মাঘাই পান- যার নাম শুনলেই বোঝা যেত, বাড়িতে আজ কোনও বিশেষ অতিথি আসছে। আজকের দোকানের হরেক রকম মশলা মেশানো দশ, বিশ টাকার পানে সে গন্ধ, সে ধীরতা, সে ভালবাসা খুঁজে পাওয়া যায় না। (Food Choices)

চিনা খাবারের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অনেক পরের ঘটনা। সত্তর-আশির দশকে ঢাকা-চট্টগ্রামে প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট দেখা গেলেও মফস্বল শহরে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আসে সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে। সেখানে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট মানেই ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শুনছ নাকি? শুনেছেন নাকি? অমুক জায়গায় একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট খুলেছে! এইভাবে খবর ছড়িয়ে যেত বাজারে, স্কুলে, পাড়ায় আর বেডরুমে। (Food Choices)
“এইসব রান্নার ভিতর দিয়েই এক নতুন বাঙালি তৈরি হয়েছে-যে ফ্রাইড রাইস খায়, তবু ইলিশের জন্য মন কেমন করে, ধনেপাতার গন্ধে সুখ পায় আর নুডুলস খেতে খেতে ভাবে, আহা! আজ যদি পাটিসাপটা খেতে পেতাম!”
মফস্বলে চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোর নামের শেষে থাকত অচেনা সব চীনা শব্দ যেগুলোর মানে কেউ জানত না, কিন্তু শুনলেই যেন এক রহস্যের গন্ধ পাওয়া যেত। ভেতরের পরিবেশ ছিল আলো-আঁধারি তাতে রহস্যময়তা আরও বেড়ে যেত। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলে সয়া সস, ভিনিগার, আর ভাজা রসুনের গন্ধ। মেনুতে লেখা থাকত- চিকেন ফ্রাইড রাইস, চাউমিন, চিলি চিকেন, মেইন কোর্সের আগে সুপ। দাম? তখনকার হিসেবে বেশ চড়া। সেখানে যাওয়া মানে ছিল এক বিশেষ উপলক্ষ। হয় পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট, না হয় জন্মদিন। সাধারণ দিনে চাইনিজ খাওয়া ছিল বিলাসিতা। (Food Choices)
এখন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট প্রতিটা পাড়ায়। বাড়িতে অতিথি এলে অর্ডার দিয়ে ফ্রাইড রাইস আনো। শুক্রবার সন্ধ্যায় পরিবার নিয়ে চাইনিজে যাওয়া এখন আর বিশেষ কিছু নয়। এটা প্রতিদিনের অংশ। চাইনিজ খাবার এখন আর বিদেশি নয়, রহস্যময়ও নয়। এটা এখন আমাদের খাদ্যতালিকার স্থায়ী সদস্য। (Food Choices)

এখন সব কিছু সহজ। সব কিছু হাতের মুঠোয়। অ্যাপে ক্লিক, আধঘণ্টায় ডেলিভারি। কিন্তু সেই রোমাঞ্চ, সেই কৌতূহল, সেই প্রথমবারের স্বাদ-সেটা আর নেই। দাদী যখন পান সাজাতেন, তখন সময় ছিল। মায়ের রান্না শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম, তখন অপেক্ষার মূল্য ছিল। যখন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যেতাম, তখন সেটা ছিল উৎসব। এখন সব কিছু তাড়াতাড়ি, সব কিছু দ্রুত। দুই মিনিটে নুডলস, দশ মিনিটে ডেলিভারি। (Food Choices)
এইসব রান্নার ভিতর দিয়েই এক নতুন বাঙালি তৈরি হয়েছে-যে ফ্রাইড রাইস খায়, তবু ইলিশের জন্য মন কেমন করে, ধনেপাতার গন্ধে সুখ পায় আর নুডুলস খেতে খেতে ভাবে, আহা! আজ যদি পাটিসাপটা খেতে পেতাম! (Food Choices)
একশো বছরে বাঙালির খাবারের ইতিহাস মানে-সারল্য থেকে জটিলতার, দেশজ থেকে বিশ্বজনীনতার, ধৈর্য থেকে দুই মিনিট এর অভিযাত্রা। ঈশ্বরী পাটনি চাইতেন তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। আজ সেই সন্তান চায় চিকেন চিজ বার্গার। তবু টেবিলে এক বাটি সাদা ভাত আর কালোজিরা দিয়ে ইলিশ মাছের পাতলা ঝোল এলে, বাঙালি নিঃশব্দে স্বীকার করে-সব রন্ধন-আগ্রাসনের মাঝেও, তার হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে এখনও মাছ-ভাতই প্রিয়তম। (Food Choices)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলাদেশের ঢাকার বাসিন্দা ও বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠক। তথ্য বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়।
