(Stray Dogs)
শ্যামা আন্টি ছিলেন আশির দশকের এক ডগ-লাভার। প্রত্যহ পনেরো-কুড়িটি পথকুকুরের পাত পড়ত তাঁর বাড়িতে। তিনি চাকরি করতেন। বেতনের বেশিরভাগ চলে যেত ওই সারমেয় প্রতিপালনে। কুকুরদের সঙ্গে ওঁর হৃদ্যতা আমাদের কোয়ার্টার্সের অনেক লোকের অসহ্য লাগত। বাড়িতে কুকুর পুষলে অসুবিধা নেই। কিন্তু রাস্তার কুকুরদের পরিচর্যা করলেই নাকি জলাতঙ্ক রোগ ছড়ায়। (Stray Dogs)
শ্যামা আন্টি আমাদের ছোটদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। মাঝে মাঝে ওঁর রাস্তার কুকুরদের দেখাশোনা, খাওয়ানোতে আমরাও জুটে যেতাম। আন্টির কাছে শুনেছিলাম মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডব যখন অগ্রসর হয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গী হয়েছিল একটি কুকুর। দ্রৌপদী প্রথমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পর একে একে চার পাণ্ডব প্রাণ ত্যাগ করতে থাকেন। যুধিষ্ঠির শেষে সশরীরে স্বর্গে প্রবেশ করেন। ওই কুকুরটি আসলে ধর্মরাজ স্বয়ং। কেবল মহাভারত নয়, ভারতীয় পুরাণেও কুকুরদের কথা আছে। (Stray Dogs)
ভগবান শিবের যে কালভৈরব রূপ, তাঁর বাহন শবন নামে একটি কালো কুকুর। কাশীধাম রক্ষা করে এই শবন। এমন অনেক গল্প শ্যামা আন্টি আমাদের বলতেন। তবে পরবর্তী কালে ভারতীয় ইতিহাস আর নৃতত্ত্বের পাতাতেও যে কুকুরদের পাওয়া যায়, তা আমরা জেনেছিলাম। এমনকি, সাড়ে চার হাজার বছর আগে মহেঞ্জদারো সভ্যতায় কুকুর যে ছিল তার প্রমাণ মিলেছে কুকুরের খুলি উদ্ধারের মাধ্যমে। ভারতীয় উপমহাদেশের যে বিশেষ কুকুর ‘পারিয়া’, যে-নাম ব্রিটিশরা দিয়েছিল তামিলনাড়ুর বাদক জনজাতি ‘পইরা’র সঙ্গে মিলিয়ে, সেই কুকুর স্বাস্থ্যের দিক থেকে নানা বিদেশি জাতের কুকুদের থেকে শ্রেয়তর, রোগহীন এবং শক্তিশালী। (Stray Dogs)

তাদের খাড়া কান, হাড়ের স্বাস্থ্য বেশ ভাল, গায়ে গন্ধ কম এবং অল্প খাবারেই তারা পুষ্ট হয়। এদের গায়ের রং বেশিরভাগ খয়েরির নানা মাত্রা। কিন্তু এত হাজার বছর ধরে তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকলেও দুঃখজনক ভাবে এদের বসবাস আজও দেশের রাস্তায়। আর রাস্তায় বাস করে বলে তারা যেন কোথাও কল্কে পায় না। ফুটপাথে থাকা ভারতীয় শ্রমিক, ভিখিরি, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ, যৌনকর্মী, রূপান্তরকামীদের মতো ভারতীয় রাস্তার কুকুরও একটা শ্রেণি যারা অন্যের ঘৃণার শিকার। ব্রিটিশরা ভারতে বিদেশি জাতের কুকুর বিক্রির ব্যবসা শক্তিশালী করবে বলে আমাদের নিজেদের দেশে বসবাসকারী সারমেয়দের ঘৃণ্য বানিয়ে দিয়েছিল। তার জের আজও চলছে। (Stray Dogs)
এখনও ভারতে বিত্তের প্রতীক বিদেশি জাতের কুকুর আর যত অযত্ন ‘পারিয়া‘দের প্রতি। যার জন্য এদের মৃত্যুর হার বেশি গাড়ি ও রেল দুর্ঘটনায়, অনাহারে, দূষিত পানীয় জলে, সাপের কামড় এবং মানুষের অত্যাচারে। শুধু কী তাই! ভারতীয় সিনেমায় কুকুর যেখানে চরিত্র যেমন- ‘মুকাবলা’ (১৯৪২), ‘তেরি ম্যাহেরবানিয়া’ (১৯৮৫), ‘হাম আপকে হ্যায় কন’ (১৯৯৪) কিংবা সাম্প্রতিক ‘৭৭৭ চার্লি’ (২০২২)- সবেতেই তো চরিত্রে একটি বিদেশি কুকুর। বাংলা ছবিও ব্যতিক্রম নয়। কেবল ‘পারিয়া’ (২০২৪) ছবিটিতে প্রকৃতপক্ষে পথকুকুরদের দেখানো হয়েছিল। সাহিত্যেও তাই। বাংলা সাহিত্যে এক তারাপদ রায় ছাড়া ক্রমাগত পথকুকুরদের কথা এমন ভাবে আর কারও লেখায় পাওয়া যায় কি? (Stray Dogs)
“গত ৮ নভেম্বরে ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয় আবার নতুন একটি রায়ে আদেশ দিয়েছে যে স্কুল, হাসপাতাল, পরিবহনস্থান এবং ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে পথকুকুরদের শুধু সরিয়ে ফেলতে নয়, একেবারে শহরছাড়া করে দূরান্তে রেখে আসতে!”
এদিকে ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের একটি সাম্প্রতিক আদেশে এই প্রশ্ন আবার উঠে এল, যে পৃথিবী নামক গ্রহটি শুধুমাত্র মানুষের নাকি অন্যান্য জীবসম্প্রদায়েরও? কয়েক মাস আগের একটি আদেশ অনুসারে রাজধানী দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সমস্ত রাস্তার কুকুর তুলে নিয়ে যেতে হবে অন্য কোনও জায়গায়। সব কুকুরকে খাঁচাবন্দী রাখতে হবে এবং এই সব কুকুর কোনওদিনই সেই তথাকথিত ‘শেল্টার’গুলি থেকে আর ছাড়া পাবে না। (Stray Dogs)

এতে সারা ভারত জুড়ে প্রতিবাদের এক রোল উঠেছিল। যে-দিল্লি শহর মিছিল-মিটিঙে বেশ অনীহা বোধ করে, গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে স্বতঃস্ফূর্ত লোকসমাবেশ হয়েছে বলতে জেসিকা হত্যা মামলা (১৯৯৯), আন্না হাজারের অনশন (২০১১) আর দিল্লি গণধর্ষণ (২০১২)-এর সময়, সেই শহরে বহু মানুষ কোনও প্ল্যাকার্ড আর পতাকা ছাড়া কুকুর বিষয়ে ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের আদেশের বিরূদ্ধে কিছু ঘণ্টার মধ্যেই ইন্ডিয়া গেট আর রাষ্ট্রপতি ভবনের মাঝের সড়ক কর্তব্যপথ-এ কাতারে জমা হয়েছিল। (Stray Dogs)
সকলের একটাই দাবী দিল্লি ও সংলগ্ন গাজিয়াবাদ, ফরিদাবাদ আর গুরুগ্রামের যেসব সারমেয় সরিয়ে ফেলার রায় উচ্চতম ন্যায়ালয় দিয়েছে তা অমানবিক শুধু নয়, অবৈজ্ঞানিকও বটে। কারণ, দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লাখ লাখ কুকুর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে, খাঁচার ব্যবস্থা করে, আহার-চিকিৎসা দিয়ে প্রতিপালনের যা খরচ তা তো আকাশছোঁয়া। এমন কাজ প্রকৃতপক্ষে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আদৌ কোনও সরকারের পক্ষে সম্ভব? প্রতিবাদ এত জোরদার হয়েছিল যে গত ১১ আগস্ট রায়দানের পর ১৪ আগস্টই আরেকটি নতুন বেঞ্চে মামলা সরিয়ে নিয়ে পূর্বতন রায়ে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। (Stray Dogs)

তারপর অন্য আরেকটি রায়ে উচ্চতম ন্যায়ালয় বলে যদিও-বা বন্ধ্যাকরণের জন্য দূরে নিয়ে যেতে হয় তাহলেও সেই সব পথকুকুরদের পুনরায় আগের জায়গায় থিতু করতে হবে। কিন্তু গত ৮ নভেম্বরে ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয় আবার নতুন একটি রায়ে আদেশ দিয়েছে যে স্কুল, হাসপাতাল, পরিবহনস্থান এবং ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে পথকুকুরদের শুধু সরিয়ে ফেলতে নয়, একেবারে শহরছাড়া করে দূরান্তে রেখে আসতে! (Stray Dogs)
“মানুষ সহানুভূতির বিভাগে ভাল ফল করতে ব্যর্থ হয় বার বার। আমাদের ছোটবেলার শ্যামা আন্টিকে কোয়ার্টার্সের বহু লোক জনান্তিকে নাম দিয়েছিল ‘কুত্তালি’!”
কথা হল, এ কোন সমস্যার সমাধান হল? ভারতীয় আইনে প্রথম থেকে পথকুকুরদের জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা আছে। বহু রাজ্যে পুরসভা ভোটে পথকুকুরদের জন্মনিয়ন্ত্রণ নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে বিজ্ঞাপিত হয়। সরকার যদি সেগুলির বিজ্ঞানসম্মত সুরাহা না করে তবে রাস্তার কুকুরদের রাস্তা থেকে সরিয়ে, খাঁচাবন্দী করে রাখলে নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কি কিছু প্রকাশ পায়? আমরা জানি এই সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। আমাদের কোথাও মনে হয় পোষ্য বুঝি বাড়িতেই থাকা বাঞ্ছনীয় আর রাস্তার প্রাণী কখনও পোষ্য হতে পারে না। (Stray Dogs)

আমাদের এই মনস্তত্ত্বে ঘৃণাভাব, শ্রেণিবিভাজন এবং এক প্রকারের আতঙ্ক মিশে থাকে। আমরা বিদেশী কুকুর বাড়িতে পালন করি কিন্তু দেশের রাস্তায় দেশজ যেসব কুকুরের বসবাস সেগুলিকে হয় ভয় করি না হয় ঘৃণা। এবং সেই ঘৃণা কখনও যাঁরা সেইসব কুকুরদের খাবার দেন, শোবার ব্যবস্থা করে দেন, দরকারে চিকিৎসা করান, তাঁদের ওপরও বর্ষিত হয়। (Stray Dogs)
বাড়িতে যে-সারমেয়টি পালিত হচ্ছে তার প্রতি স্নেহ আর পথকুকুরটিকে যিনি রাস্তাতেই পালন করেন সেই স্নেহ যে আলাদা বা ছোট-বড় কিছু নয়, তা আমরা বুঝতে চাই না। সরকার যেখানে খাঁচাবন্দী করা ছাড়া আর কোনও কর্তব্য পথকুকুরদের ব্যাপারে পালন করছে না তখন কিছু মানুষ ভালোবেসে সেই সব সারমেয়গুলির প্রতিপালনের দায়িত্ব নিলে অসুবিধা কোথায়? কামড়ানোর ভয়? জলাতঙ্ক রোগগ্রস্ত হওয়ার ভয়? মশা আর বিড়ালের থেকেও মানুষের প্রাণঘাতি রোগ ছড়াতে পারে। তবে কি তাদেরও শহরের প্রান্তে বন্দী করে রাখা সম্ভব? জলাতঙ্ক রোগ ছড়াতে পারে বাদুড়, শেয়াল এমনকি বেজির কামড় থেকেও। সমস্যা নির্মূলের জন্য আসলে প্রয়োজন পাড়ায় পাড়ায় ‘সেন্সিটাইজ়েশন ক্যাম্পেন’ (সংবেদনশীলতার অভিযান) আর ব্যাপক টিকাকরণ। (Stray Dogs)

কুকুরদের মেরে ধরে আটকে রেখে সমস্যার সমাধান হয়? তাতে তাদের হিংস্র হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ন্যায়ালয় এবং রাষ্ট্র যেমন চিন্তিত হবে জলাতঙ্কে আক্রান্ত অকালমৃতদের প্রতি তেমন যে-মানুষগুলোর ওই পথকুকুরদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তাঁদের মনে এমন আদেশের কী প্রভাব পড়তে পারে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। আর যে-শহরের যে-রাস্তায় কুকুরগুলির বসবাস করে জায়গাটি কি তাদেরও নয়? তারা কি সেই বৃহত্তর জীবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়? আর তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষগুলিও কেন-বা ঘৃণিত হবেন? প্রভুভক্তি ছাড়াও একটি কুকুর কত মানুষের একাকীত্ব কাটায়, নানা বিপদ থেকে রক্ষা করে, কত মানুষের জীবনে এনে দেয় নিঃশর্ত উষ্ণতা- সেগুলির কী কোনও মূল্য নেই? (Stray Dogs)
যাঁরা পথকুকুরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন আর যাঁরা পথকুকুরদের প্রতি স্নেহপরবশ- এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটা পারস্পরিক সমঝোতা এখন ভীষণ প্রয়োজন। আর বিজ্ঞানসম্মতভাবে রাস্তার কুকুরদের জন্মনিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত টিকাকরণ, দত্তক নেওয়া ও পথেই তাদের পরিচর্যা করা সমাজ ও রাষ্ট্রের আশু কর্তব্য। সাবধানের যেমন মার নেই, সহানুভূতিরও তেমন শ্রেণিবিভাজন হয় না। তবে মানুষ সহানুভূতির বিভাগে ভাল ফল করতে ব্যর্থ হয় বার বার। আমাদের ছোটবেলার শ্যামা আন্টিকে কোয়ার্টার্সের বহু লোক জনান্তিকে নাম দিয়েছিল ‘কুত্তালি’! (Stray Dogs)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ভাস্কর মজুমদার লেখেন মূলত প্রবন্ধ, উত্তরসম্পাদকীয় নিবন্ধ, কলাম ও ছোটগল্প। যৌনসংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক মানুষ, স্কুলশিক্ষা, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, নৃত্য ও সিনেমা তাঁর বেশিরভাগ লেখার বিষয়। অনুবাদকর্মের সঙ্গেও তিনি বহু বছর যুক্ত। সম্প্রতি কলকাতা দূরদর্শনের পক্ষ থেকে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে।
