(Jamal Ara)
গতবার কলকাতায় বাড়ি গিয়ে, আমাদের গ্যারাজে বাক্সবন্দী পুরোনো বইগুলো ঝেড়ে মুছে, কিছু রেখে, কিছু ফেলে গুছিয়ে নেওয়ার প্রকল্প যখন বেশ অনেকটা সাফল্যের মুখ দেখছে, তখন সেই ছোটবেলার, পুরোনো বই এর মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছোট্ট বই। বাচ্চাদের জন্য লেখা, নাম ‘ওয়াচিং বার্ডস’— পাখি দেখার, পাখি চেনার গল্প। লেখক জামাল আরা। (Jamal Ara)
জেগে উঠল ছোটবেলার স্মৃতি। কিন্তু তখনও বইয়ের লেখক কে ঠিক মনে করতে পারছিলাম না, ছোটবেলার স্কুলের বইয়ের অনেক লেখকদের সাথে ঠিক তেমন করে চেনাশোনা হয়নি, যতটা হয়েছিল তাঁদের লেখা বা ছবির সাথে। ঠিক তেমনই জামাল আরা কে, আলাদা করে মনে পড়ল না। (Jamal Ara)
আরও পড়ুন: একটা চড়ুই স্মৃতির ভিতর ‘এক্কা দোক্কা খেলছে’
পাখি সকল আমার বড্ড প্রিয়, এখনও কেও যদি জিজ্ঞেস করে “তোমার কী হতে ইচ্ছে করে?” প্রশ্নকর্তার প্রশ্ন শেষ করার আগেই, “পাখি, পাখি ই ই!” বলে চিৎকার জুড়তে পারি। তাই ধুলো ঝেড়ে পড়তে বসলাম। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মনে হল, এ তো শুধু পাখির গল্প নয়, এক, দুই, তিন জীবনের কাহিনি। (Jamal Ara)
আজ ১৪ নভেম্বর, ২০২৫। গত পরশু, ১২ই নভেম্বর, সেলিম আলির জন্মদিন ছিল।

ভারতের বার্ডম্যান এর জন্মদিনে, কলকাতায় ফেলে আসা পুরোনো “ওয়াচিং বার্ডস” বইটার কথা মনে পরে গেল।
এখানে শীতের প্রথম বরফ পড়েছে দু’দিন আগে, তারপর সূর্য ঝলমলে দিন এসেছে আজ। গাছের পাতা প্রায় সব উড়ে গেছে, শুধু খালি ডালপালা দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বেরোতেই কানে এল পাখিরা ডাকছে—স্থানীয় সব পাখি, যেন উৎসবে গান গাইছে। দেখতে পাচ্ছি, তারা খালি এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে উড়ছে, সোনালি আলোয় কিচিরমিচির করছে সব। (Jamal Ara)

আজ তো তারা সবাই ব্যস্ত, দারুণ আনন্দ তাদের— পুরুষ কার্ডিনালের (Red Cardinal) লাল পালক ঝলমল করছে, একটা ডালে বসে গান গেয়ে চলেছে তার মেয়ে বন্ধুকে আকৃষ্ট করার তাগিদে, ব্লু জে (Blue Jay) নীল ডানা মেলে খেলা করছে, ডার্ক-আইড জুনকোর (Dark-eyed Junco) ছোট্ট দল, খাবার খুঁজতে লাফাচ্ছে মাটিতে, আর ক্যারোলাইনা চিকডিরা (Carolina chickadee) ‘চিক-ডি-ডি’ ডেকে উড়ে যাচ্ছে। (Jamal Ara)

হঠাৎ মনে হল, জামাল আরা যেন এখানেই হেঁটে বেড়াচ্ছেন— হাতে একটা দূরবীন আর নোটবুক, চোখে অদম্য কৌতূহল। এই হেমন্তের ছবিটা— হলুদ-কমলা পাতার ছিটেফোঁটার মাঝে পাখির ঝাঁক, শীতের প্রথম আলো— যেন জামালের জীবনকে ছুঁয়ে যায়। আবার আমেরিকার কোনও এক হেমন্তের দিনে হয়তো এই ইলিনয়ের কোনও শান্ত নদীর ধারে জন জেমস অডুবন, founding father of American birding, পাখি এঁকেছেন। আর আছেন সর্বজন প্রিয় সেলিম আলি, যাঁর জন্মদিন ছিল বলেই না জামাল আরার কথা মনে পড়ল! দুই মহাদেশের মাঝে একটা সেতু, পাখির ডানার মতো— ভারতের ছোট নাগপুর থেকে আমেরিকার ইলিনয়ের নদীপথ, জঙ্গল, সব একই আকাশের নিচে। (Jamal Ara)

জামাল আরার গল্পটা অনেকদিন আমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ১৯২৩ সালে বিহারের পাটনা শহরের কাছে, বারহ এ একটা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। মেয়েরা তখন স্কুলে যেত না বেশি, তাই ক্লাস টেনের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হল। কিন্তু পাখির প্রতি ভালবাসা তাঁকে শিখিয়ে দিল সব। ছোটনাগপুরের পাহাড়ি জঙ্গলে, যাকে এখন ঝাড়খণ্ড বলি, তিনি সেখানে দিনরাত ঘুরে বেড়াতেন। শুধু একটা নোটবুক আর দূরবীন নিয়ে। পাখিরা কীভাবে বাসা বাঁধে, খাবার খোঁজে, কখন কীভাবে গান গায়, ঋতু বদলায়— সব লিখে রাখতেন। এক হাজারের বেশি প্রজাতির পাখির নোট! “অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক”(Adjutant Stork) নামের একটা বড় সারস পাখির কথা লিখেছিলেন: “তার বড় শরীর, টাক মাথা আর চামড়ার গলা দেখলে সুন্দর লাগে না, কিন্তু উড়তে তার চাইতে ভাল কেউ নেই।” (Jamal Ara)

পাখিরা কীভাবে বাসা বাঁধে, খাবার খোঁজে, ঋতু বদলায়— সব লিখে রাখতেন। এক হাজারের বেশি প্রজাতির পাখির নোট! এরকম গবেষণামূলক পাখিদের কথা লিখে পাঠাতেন বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির (BNHS) মতো বড় বড় সায়েন্স জার্নালে। এই সোসাইটির মাধ্যমে তিনি ভারতীয় পাখি অধ্যয়নের জগতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন এবং তাঁর গবেষণা প্রকাশ হতে থাকে, যার ফলে সলিম আলির মতো মহান ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং কাজ করার সুযোগ ঘটে। (Jamal Ara)
তাদের প্রথম সাক্ষাৎ সঠিক কোন বছরে হয় তার কোথাও উল্লেখ নেই, কিন্তু BNHS-এর মতো প্ল্যাটফর্মে দুজনের যোগাযোগ এবং অংশগ্রহণের কারণেই এই পাখিদের নিয়ে কাজের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডিগ্রি না থাকলেও তাঁর লেখা ছাপা হত। ‘ওয়াচিং বার্ডস’ বইটা বাচ্চাদের জন্য লিখেছিলেন, যার তেরোটা সংস্করণ বেরিয়েছে। এই বইয়ের চিত্রকল্প করেছিলেন BNHS-এর সঙ্গে যুক্ত বিখ্যাত চিত্রকর জে.পি. ইরানি— যাঁর অংশগ্রহণের ফলে বইটি আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এছাড়া রেডিওতে পাখির প্রোগ্রাম করতেন, গল্প লিখতেন, অনুবাদ করতেন। (Jamal Ara)

কিন্তু জামাল আরার পারিবারিক জীবন ছিল দুঃখের। জোর করে বিয়ে হয়েছিল তুতো ভাই হামদি বে’র সাথে, একটা মেয়ে হয়েছিল মধুকা। বিয়ে ভেঙে যায়। আরেক তুতো ভাই সামি আহমেদের সাহায্যে চলত জীবন। সামি পাখি দেখাতে নিয়ে যেতেন জঙ্গলে। কিন্তু ১৯৬৬ সালে স্বামির মৃত্যু হলে সব শেষ। মেয়ের বিয়ে হল, তিনি একা হয়ে গেলেন। ১৯৮৮ সালে বোনের অসুস্থতা নিয়ে আরও ভেঙে পড়েন, একদিন হঠাৎ সব লেখা-টেখা পুড়িয়ে ফেলেন। ১৯৯৫ সালে নিঃশব্দে চলে যান পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। কেউ খবরও রাখেনি। (Jamal Ara)
এই জামাল আরার গল্পটা ফিরিয়ে এনেছেন গবেষক রাজা কাজমি। ২০১৮ সালে তিনি খুঁজে পান জামালের কথা, আর লিখেছেন ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অফ ইন্ডিয়ান অর্নিথলজি’— একটা অধ্যায়, ‘উইমেন ইন দ্য ওয়াইল্ড’ বইতে, যার সম্পাদিকা অনিতা মানি। এই বই ২০২৩ সালে বেরিয়েছে। রাজা কাজমির লেখায় তাঁর দুঃখের গল্প এমনভাবে বলা, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। (Jamal Ara)

জামালের লেখা, আর যে, পি, ইরানির আঁকা বইটা যখন পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল জামাল আমার কাছে এসে বসলেন। সেই ছোট্ট বইটা থেকে শুরু করে, ইন্টারনেটে খুঁজতে থাকলাম জামাল আরা কে। জানলাম তাঁর রহস্যময় জীবনের কথা।(Jamal Ara)
বার্ড ম্যান সালিম আলি বলেছিলেন, জামাল আরা ছিলেন পাখির জগতের এক আলো। পরশুর জন্মদিনে তাঁর কথা মনে পড়ার সাথেই জামালের গল্পটা যেন আরও কাছে এল। ভারতের একামবদ্বিতীয়ম “বার্ড ম্যান” সলিম আলি নিজে তাঁকে ‘বার্ডওম্যান’ বলে ডেকেছিলেন। (Jamal Ara)

এবারে কল্পনা করুন একটা ছোট গ্রাম, সেই গ্রামে থাকি আমরা সবাই। আমার মতো একটা মেয়ে, বিহারের এক গ্রামে, হেমন্তের সকালে উঠে স্কেচবুক নিয়ে হেঁটে বেড়ায়। হেমন্তের ছবিটা যেন জীবন্ত— পাতাহীন গাছের ডালে পাখিরা লাফাচ্ছে, সূর্যের আলোয় তাদের ডানা চিকচিক করছে, আর ঘাসে ঘাসে, মাটিতে লুটিয়ে পড়া রঙিন পাতায় হিমের ছোঁয়া। (Jamal Ara)
একই জনপথ ধরে সলিম আলি চলেছেন, ভারতের পথে পথে ঘুরে নাম দিচ্ছেন প্রত্যেকটা পাখির। আরেকটু এগিয়ে সেই রাস্তা ধরে আমেরিকার জন জেমস অডুবন ইলিনয়ের হেমন্তের নদীতীরে বসে পাখির ছবি আঁকছেন— তাঁর বড় বই ‘দ্য বার্ডস অফ আমেরিকা’তে ৪০০-এর বেশি পাখির রঙিন পালক যেন উড়ছে। (Jamal Ara)

আমাদের ছোটনাগপুরের মেয়েটা আঁকে আর লিখে রাখে তার নোটবইতে, “একটা গোসাঁই পাখি খালি ডালে”, অডুবনের নজর কাড়ে এক উড়ন্ত স্টর্ক (সারস পাখি)— যেন অডুবনের আমেরিকান অটম থেকে ভারতের হেমন্তের মাঝে সেতু। আর কিছু দূরে দূরবীন এ চোখ রেখে সেলিম আলি নাম রাখছেন উঁচু পাথরে বসা এক নতুন পাখির। (Jamal Ara)
হঠাৎ পাওয়া দু’আনার মতন, পুরোনো বইতে ফিরে পেলাম ছোটনাগপুরের পাখিদের গল্প: দেখলাম ময়ূরের নাচ বৃষ্টিতে, শুনতে পেলাম প্যাঁচার ডাক রাতের অন্ধকারে, আর হেমন্তের শেষবেলায় খালি ডালে ছোট ছোট পাখিদের মনের আনন্দে লাফিয়ে বেড়ানো। (Jamal Ara)

এই আমাদের ছোট্ট গ্রাম, একমাত্র নির্ভার। ভালোবাসতে থাকব সব মহাদেশের পাখিকে।
ছোটি সি পঞ্ছি ছোট্ট ঠোঁটে রে
মিষ্টি ফুলের মধু লুটে রে
ঝিরিঝিরি ঝোরা
তিরিতিরি নাচে রে
তিরিতিরি নাচে রে
তিরিতিরি নাচে

এক পথিকৃতের জন্মদিনে জামাল আরা ও ফিরে এলেন, রহস্য নয়, আলো হয়ে— তুষার নামার পর সূর্যের মতো উঠে এসেছেন। জেমস ওডুবন, সেলিম আলি ও জামাল আরা রা আমাদের শেখান, প্রকৃতিকে ভালবাসতে, রক্ষক হতে, এক আকাশ, দুই মহাদেশ জুড়ে। (Jamal Ara)
চিত্রঋণ- লেখিকা
ব্যবহৃত গানটি সাগিনা মাহাতো ছবির, অনুপ ঘোষাল এর গাওয়া
মৌসুমীর জন্ম কলকাতায় হলেও গত তিন দশক ধরে নিউ ইয়র্কই তাঁর বাসস্থান এবং কর্মস্থান। এক্কেবারে বিশুদ্ধ ক্যালইয়র্কার। শুঁটকি মাছ থেকে চন্ডীপাঠ, Grateful Deads থেকে সুপ্রীতি ঘোষ আর এই diasporic dichotomy-র জাগলিংয়ে হাত পাকাতে পাকাতেই দিন কাবার। ভালোবাসেন বই পড়তে, ছবি আঁকতে, রান্না করতে, আড্ডা মারতে আর ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে। তবে সবচেয়ে ভালোবাসেন সক্কলকে নিয়ে জমিয়ে বাঁচতে!
