(Rathindranath Tagore)
ক্র্যাফটসম্যান ভাবতেন নিজেকে। শিল্পী নয়। নীরবে কাজ করে যাওয়া, এই ছিল তাঁর ব্রত। জীবন থেকে ছিল না কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। শান্ত, নিরহংকারী শিল্পীর কাছে কর্মই ছিল মহান। জীবনের প্রতি আবেদন নয়, নিবেদনে বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে বাবার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিলেও তার মধ্যেই নিজের জন্য গড়েছেন অন্যরকম পথ। নিভৃতে কাজ করতে পছন্দ করতেন। নেপথ্যচারী মানুষটির জীবন ছিল নানা রঙে আঁকা। তবে সেই রং কখনোই তাঁর কাজকে ছাড়িয়ে যায়নি। বরং তাঁর অন্তরকে ঘিরে রেখেছে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্তরালকেই বেছেছিলেন তিনি। আর এই অন্তরালে থেকেই সাধনা করেছেন শিল্পের। (Rathindranath Tagore)
কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৮৮ সালের ২৭শে নভেম্বর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৃণালিনী দেবীর এই জ্যেষ্ঠপুত্রকে নিয়ে এল মহাস্ট লিখেছিলেন “তাঁর অভিজাতসুলভ, শান্ত মুখশ্রীর অন্তরালে ছিল শিল্পীর হৃদয়। কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করার সময়-সুযোগ তিনি কদাচিত পেয়েছেন।” এই নিয়ে কোনও দুঃখ বা ক্ষোভ ছিল না রথীন্দ্রনাথের। বরং যাবতীয় আক্ষেপকে চালিত করেছিলেন শিল্প-সাধনার পথে। (Rathindranath Tagore)
এমন শিল্পী-হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন বলেই তাঁর কলম বরাবর সহজ, অকপট ও সাবলীল থেকেছে। পিতৃস্মৃতিতে অবলীলায় লিখেছিলেন “বাড়ির মধ্যে আমারই রং কালো, চেহারায় বুদ্ধির পরিচয় ছিল না, স্বভাব অত্যন্ত কুনো, শরীর দুর্বল, মনস্তত্ত্বে যাকে বলে হীনম্মন্যতা তা যেন ছেলেবেলা থেকে আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। বড় হয়েও তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছি এমনটা বলতে পারি না।” পিতার ইচ্ছেপূরণে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। আবার এই ত্যাগের ভেতরে তিনি নিজের জীবনদ্বীপটি জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সেই আলোয় আলোকিত করেছিলেন নিজের শিল্পী-সত্ত্বাকে। অভিব্যক্তি, প্রাণতত্ত্বের মতো বিজ্ঞানভিত্তিক রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর কলম, সাধনার পরিচয় দিয়েছে। (Rathindranath Tagore)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়তে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। বিজ্ঞান-সাধনা ও শিল্প ভাবনার অনবদ্য মিশ্রণ ছিল তাঁর আদর্শের অংশ।

ধৈর্যশীল, উদ্ভাবনী ভাবনাসম্পন্ন ডিজাইনার ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়কাল ছিল বড় আশ্চর্যের। আবার পরিবর্তনশীলও। শহরের কলকারখানার হাতছানিতে গ্রামীণ শিল্প-ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে তখন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন, “শিল্পীকে মজুরে পরিণত করা হচ্ছে।” রথীন্দ্রনাথ সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের শিল্প-স্থাপত্য এবং পরিবেশ ভাবনার হাল ধরেন। এর সূত্রপাত হয়েছিল মূলত বাবার দেওয়া দায়িত্ব পালনের হাত ধরে। কিন্তু সেখানেও নিজের ভাবনা এবং প্রয়োগবিদ্যার ছাপ রেখেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে মিশেছিল শিল্পের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা। (Rathindranath Tagore)
কলকাতার জোড়াসাঁকোয় যখন রবীন্দ্রনাথ মারা যান, দ্বারকানাথ ঠাকুরের গৃহের প্রবেশদ্বার জনসমাগমে ফেটে পড়ছে, নানা মতপার্থক্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে রথীন্দ্রনাথকে। স্ত্রী প্রতিমা দেবীও সঙ্গে নেই। অসুস্থ হয়ে শান্তিনিকেতনে রয়েছেন। রথীন্দ্রনাথ নিজেও অসুস্থ ছিলেন। এমন শোকাহত অথচ জটিল সময়েও ধৈর্যহারা হননি রথীন্দ্রনাথ। বাবার শেষকৃত্যের আদেশ দিয়েই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সেরে ফেলেন প্রস্তুতি। বাবার দেখানো পথে এগিয়েই গড়ে তোলেন সংগ্রহশালা। (Rathindranath Tagore)
“বিশ্বভারতীর সচল পর্বে প্রয়োগ শিল্পী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনা যায়। চামড়ার ট্যানিং করে তার ওপর ছবি ও নকশা মিলিয়ে নানা রঙে সাজিয়ে দৈনন্দিন শিল্প গড়ে তুলেছিলেন।”
শিল্প-সাধনার এক অনন্য ক্ষেত্র ছিল রথীন্দ্রনাথের মন। যে কাজ করেছেন, হৃদয় দিয়ে তা পূর্ণ করেছেন। হতাশা, অবসাদ যে একেবারে গ্রাস করেনি তা নয়। একবার বলেছিলেন “জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের, কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।” অন্তর্মুখী, অভিমানী রথীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন “আমার নিজস্ব জীবন আমি কোনকালে যাপন করিনি।” ইলিনয়তে কৃষিবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে পড়াশোনা শেষ করেও বিদেশে থেকে যাননি বাবার কথায়। ফিরে এসে তাঁর অর্জিত বিদ্যা নিজেদের জমিদারির কাজে সবেমাত্র ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। বাবার ডাকে সেসব ছেড়ে আবার ফিরতে হয় শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী গড়ে তোলার কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথকে। বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য ছিলেন তিনি। (Rathindranath Tagore)
শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের পরিকল্পনার উদ্যোগী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। তবে বিদ্যালয়ের পরিবেশ-নির্মাণ ভাবনার মূল রূপকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ভাবনাকে নিজের শিল্পসাধনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ও সুরেন কর। গৃহস্থাপত্যের সঙ্গে তাঁরা মিলিয়ে দেন উদ্যান-স্থাপত্য। তার সঙ্গে যুক্ত করেন প্রতিস্থাপন-শিল্প। এক কথায় শিল্প আন্দোলনের ছোঁয়া লাগে শান্তিনিকেতনে। কবিগুরুর যাবতীয় ভাবনায় নিজের শিল্পীসত্ত্বার জাদুকাঠি ছুঁইয়ে ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ১৯১৫ থেকে ১৯১৬ সাল নাগাদ এর শুরু হয়। জোড়াসাঁকোয় বিচিত্রা ক্লাব শিল্প আন্দোলন দিয়ে সূত্রপাত হয় মূলত। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ একসঙ্গে শিল্প-সাধনা করেছেন। এঁদের উদ্যোগে শিল্পপ্রযুক্তির এক রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিল। (Rathindranath Tagore)

বিশ্বভারতীর সচল পর্বে প্রয়োগ শিল্পী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনা যায়। চামড়ার ট্যানিং করে তার ওপর ছবি ও নকশা মিলিয়ে নানা রঙে সাজিয়ে দৈনন্দিন শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। চামড়া-শিল্পকে বিবরণের প্রযুক্তির সঙ্গে প্রথমবার যুক্ত করলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্থানীয় কারুশিল্পীরা উপকৃত হয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে জন্ম নেওয়া অজস্র ডিজাইন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যাঁর রূপকার ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। কাঠের কাজ করতে বড় ভালবাসতেন। (Rathindranath Tagore)
নিজের হাতে কাজ করতেন। আসবাবপত্র নির্মাণে তাঁর নিবিড় মনোযোগ ছিল চোখে পড়ার মতো। শান্তিনিকেতনে স্ত্রী প্রতিমা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে বিচিত্রা কারুসংঘ গড়ে তুলেছিলেন। কাঠের কাজ, পটারি, সিরামিক, গালা শিল্প, সব মিলিয়ে এক নতুন ধরণের ল্যান্ডস্কেপ ইন্টেরিয়র সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথাগত শিল্প ও লোকশিল্প মিলে জন্ম নেয় এক নতুন শিল্পরীতির। আসবাবপত্রে জ্যামিতিক ছাদের সঙ্গে ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর এক অসাধারণ রূপের মিশ্রণ ঘটালেন। উদয়নের বসার, শোওয়ার, খাওয়ার ঘরে আজও তার প্রমাণ রয়েছে। (Rathindranath Tagore)
১৯২৭ সালের পর থেকে রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের সচিব ছিলেন। ১৯২৮ সালে, শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ভবন শ্রীনিকেতনে আসে। এই সময় থেকেই বয়ন শিল্পে তার নিজস্ব পরিচয় গড়ে নিতে শুরু করে শান্তিনিকেতন।
শ্রীনিকেতনে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগেই প্রথমবার ১০টি পাওয়ারলুম ও কয়েকটি প্রিপারেটরি মেশিন আসে। মণীন্দ্রচন্দ্র সেনকে জাপান থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়। ধীরে ধীরে তাঁত শিল্পের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে শ্রীনিকেতন। ১৯৩৭ সালে তাঁতশালায় এগারোটি হস্তচালিত তাঁত, পাঁচটি সুইডিশ তাঁত ও দশটি পাওয়ারলুম চলত। ছত্রিশটি গ্রামে তাঁতিরা কাজ শুরু করেছিলেন। এইসব উৎপাদিত সামগ্রীর বিপণনের ক্ষেত্রটিও দেখতেন রথীন্দ্রনাথ। তাঁর উদ্যোগে আসবাব শিল্পের বিক্রির পরিমাণও বেড়েছিল। রবীন্দ্রনাথই শান্তিনিকেতনে প্রথম কারুশিল্প প্রসারণ ও গ্রামীণ শিল্পের সম্প্রসারণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাকে বাস্তবায়িত করেন রথীন্দ্রনাথ। কারুশিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদনের সঠিক প্রয়োগ তার মান বাড়ায়। রথীন্দ্রনাথের উদ্যোগের সঙ্গে মিশে ছিল প্রযুক্তির ব্যবহার। সব মিলিয়ে বয়ন শিল্পকে আশ্চর্য রূপদান করেছিল শান্তিনিকেতন। (Rathindranath Tagore)

শুধুমাত্র শিল্পের সৃষ্টি নয় তার প্রয়োগের উপরেও যথেষ্ট জোর দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। শিল্প সাধনার ক্ষেত্রটিতে বহু মানুষকে যুক্ত করেছিলেন। তিনি নিজে যথেষ্ট প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন। আবলুস কাঠ থেকে গাম্ভার, নানা ধরণের কাঠ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ ছিলেন। জ্যামিতিক তল, স্থাপত্যের আভিজাত্য, সব মিলিয়ে কাঠের শিল্পের এক অন্যরকম ধারা গড়ে তুলেছিলেন। বিংশ শতকের এই বিশেষ সময়কালটিতে তিনি প্রয়োগশিল্পের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। (Rathindranath Tagore)
রবীন্দ্রনাথের ভাবনার আরেকটি ক্ষেত্রকেও নিজের শিল্প ভাবনায় সাজিয়ে তুলেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। বৈজ্ঞানিক শিল্পদৃষ্টির সঙ্গে পরিবেশ ভাবনার মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্য, পরিবেশভাবনা অন্তর দিয়ে অনুভব করতেন রথীন্দ্রনাথ। স্বাভাবিক, সহজাত আগ্রহ থেকেই বাকি কাজটুকু করেছিলেন। ছেলের এই আগ্রহের কথা জানতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। রথীন্দ্রনাথ তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। বাবার তৈরি বিভিন্ন স্থাপত্যের প্রতি রথীন্দ্রনাথের অনুসন্ধিৎসু মন আগ্রহী হয়ে রয়েছে। দিদিমা রাজলক্ষ্মী দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন “বাবার বাড়ি কতদূর এগিয়েছে?” ছেলের এই আগ্রহকে রবীন্দ্রনাথও গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য করেছিলেন। (Rathindranath Tagore)
“নীরব কিন্তু সচল প্রয়োগশিল্পী। রথীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা তাই বরাবর প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সময়ের শিল্প, স্থাপত্য ও পরিবেশভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেও রথীন্দ্রনাথ আলোকোজ্জ্বল সৃষ্টির ধারক হিসেবেই বিবেচিত হবেন।”
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে বাবার মনের মতো করে শিলাইদহের তিনতলার ছাদঘর তৈরি করেছিলেন। বাবা-ছেলের মধ্যে ইকোলজিক্যাল স্থাপত্যের মতবিনিময় হয়ে গিয়েছে ততদিনে। জোড়াসাঁকোর ছাদঘরের অভিনব ইকোলজিক আর্কিটেকচারের ভাবনা তাই আদরের ছেলে রথীকেই জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্থাপত্য গড়ে তোলার সময় তার ভেতর দিয়ে আলোবাতাস চলাচলের দিকটি, বরাবর লক্ষ্য রাখতেন রথীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর ছাতঘরে তাই আলো-বাতাস, রাতের নক্ষত্র, দিনের আলো সবুজের সমারোহের যাতায়াত ছিল অবাধ, এই নকশা বাবা-ছেলে দু’জনেই অন্তর থেকে অনুমোদন করেছিলেন। (Rathindranath Tagore)
শান্তিনিকেতনের রাঙামাটি ও নীল আকাশের বন্ধুত্বের সাড়ে তিন তলার বহু ছাদবিশিষ্ট ঘরের সারি উঠল। শান্তিনিকেতনের শিল্পভাবনার সঙ্গে সবুজের সেতু গড়ে তোলেন রথীন্দ্রনাথ। পরিবেশ হলও যথাযথ। তৈরি হয়েছিল এক সচল, সজীব, সবুজ সংস্কৃতি। (Rathindranath Tagore)

১৯১৯ সালের জুলাই মাস থেকে বিশ্বভারতীর উত্তর বিভাগে রথীন্দ্রনাথ জেনেটিক্স পড়ানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তেজে চন্দ্র সেনের সঙ্গে আশ্রমের প্রকৃতিবিদ্যা পাঠে তিনি ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। প্রথমবার বিশ্বভারতীতে পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়। উত্তরায়ণের বাগানে ছাত্র-শিক্ষকের সামনে এক সবুজ জগত খুলে যায়। গুহাঘরের কাছে আম, সবেদা, পেয়ারা গাছের লতাবিতান দেখা যায়, সবই রথীন্দ্রনাথের সবুজ পরীক্ষাগারের ফসল। (Rathindranath Tagore)
প্রকৃতিবিদ্যাকেও শিল্পের মতো করেই চর্চা করেছেন রথীন্দ্রনাথ। তাঁর বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, শৈল্পিক মনন ও দক্ষতা বাগান-স্থাপত্য নির্মাণ ও পরিবেশবিন্যাসের কাজ বিস্তৃত করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে তাঁর এই কর্মযজ্ঞ একটি আদর্শ রূপে স্থাপিত হয়েছিল। রুক্ষ, কঠিন মাটি থেকে জীববিদ্যার প্রখর অনুভবে প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈচিত্র্য গড়ে তুলেছিলেন। ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে শিল্প-স্থাপত্য ও পরিবেশভাবনাকে এইভাবে মিশিয়ে দেওয়া নেহাত সহজ কাজ ছিল না। (Rathindranath Tagore)
আরও পড়ুন: অবগুণ্ঠিতা, নারী জাগরণের প্রতীক: অবলা বসু
যদিও এর সূত্রপাত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা থেকে, যা বরাবর সজীব এবং ঐতিহ্যবাহী ছিল। কিন্তু তাকে আকারায়িত করা সহজ ছিল না। এই কঠিন কাজটিই করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। শুধু কাজ করেছিলেন বললে কম বলা হয়, বাবার দেখানো পথে তিনি নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সৃজনশীল ভাবনা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। শিল্পসাধনাকে রীতিমতো উদ্যাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্রবধূ অর্থাৎ রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীকে একটি চিঠিতে স্টুডিওর পরিকল্পনা লিখেছিলেন। আড়াল থেকে তা জানতে পেরেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ১৯৩০ সালে নিজের উদ্যোগে তাঁর রূপায়ণ ঘটান। চিত্রভানু ও গুহাঘর তৈরি করেন শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ভাবনা, স্থাপত্য এবং শিল্পক্ষেত্র অনুধাবন করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি যে নাম অবশ্যম্ভাবীরূপে চলে আসে তা রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (Rathindranath Tagore)
নীরব কিন্তু সচল প্রয়োগশিল্পী। রথীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা তাই বরাবর প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সময়ের শিল্প, স্থাপত্য ও পরিবেশভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেও রথীন্দ্রনাথ আলোকোজ্জ্বল সৃষ্টির ধারক হিসেবেই বিবেচিত হবেন।
তথ্যসূত্র:-
১. পিতৃ স্মৃতি:- রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. প্রাণতত্ত্ব:- রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. জন্মশতবর্ষ পূর্তি-শ্রদ্ধার্ঘ্য, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে প্রকাশিত)
৪. রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর:-প্রযুক্তি-শিল্পসাধক, অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বসত্ব সংরক্ষিত